মো. জিল্লুর রহমান

  ১০ মার্চ, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

গণতন্ত্র রক্ষা বনাম গণহত্যায় আমেরিকার দ্বৈতনীতি

সাম্প্রতিক ইতিহাসে একই সঙ্গে বিশ্বের দুই প্রান্তে দুটি বড় আকারের যুদ্ধের নজির নেই। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হয়, যা এখনো চলছে। অন্যদিকে গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে নির্মূলের লক্ষ্যে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে ৩০ হাজারের অধিক মানুষকে হত্যা ও ৭০ হাজারের অধিক মানুষকে গুরুতর আহত করেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে দুদেশের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর মধ্যে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইউক্রেনের শক্তির যে ঘাটতি, তা পূরণে যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্র দেশগুলো এগিয়ে এসেছে। বিপরীতে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে হামাসের যে কথিত যুদ্ধ তার মূল্য দিতে হচ্ছে গাজার নিরীহ, নিরপরাধ ও বেসামরিক বাসিন্দাদের। এ ক্ষেত্রে অধিকৃত পশ্চিমতীরের ফিলিস্তিনি সরকার, আরব লীগ বা অন্য কোনো দেশ গাজার বাসিন্দাদের সুরক্ষা নিশ্চিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না কিংবা রাখছে না। এদিকে আগ্রাসী ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য মিত্রদের বড় আকারের সামরিক সহায়তা দেওয়ার কাজ থেমে নেই। বিশ্লেষকদের অভিমত, ইউক্রেন বছরের পর বছর রাশিয়ার হামলা ঠেকাতে সক্ষম। কিন্তু গাজার ২৩ লাখ মানুষের বেশির ভাগই ক্ষুধার্ত, আহত, অসুস্থ ও নিহত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। ইতিমধ্যে এই জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশের বেশি বাস্তুচ্যুত হয়ে অনিশ্চিত জীবনযাপন করছেন। ইসরায়েলি ট্যাংক ও বিমান গাজার বেশির ভাগ দালান মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের দুই প্রান্তের যুদ্ধে ইউক্রেনীয়রা গণহত্যার শিকার হচ্ছে বলে দাবি জানানো হলেও, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র গাজায় গণহত্যার অভিযোগকে কার্যত উড়িয়ে দিয়েছে।

আমেরিকা একদিকে রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে ইউক্রেনের গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করছে, অন্যদিকে গাজায় ইসরায়েলকে গণহত্যার লাইসেন্স দিয়ে নিরীহ নিরাপদ মানুষকে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। ইরাকে মারণাস্ত্র থাকার মিথ্যা অভিযোগে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা আমেরিকা বাগদাদকে হুমকি হিসেবে তুলে ধরে দেশটিতে হামলায় চালিয়ে ২০ লাখ মানুষ হত্যা করে এবং দেশটি দখল করে নেয়। অথচ এর কোনো বিচার হয়নি। ভিয়েতনাম যুদ্ধেও আমেরিকা একই কাজ করে শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করে নেয়। রাশিয়ার পাশে থাকা ইউক্রেন মস্কোর জন্য সত্যিকারার্থেই হুমকি সৃষ্টি করা সত্ত্বেও পশ্চিমারা বলছে একটি সার্বভৌম দেশে হামলা অগ্রহণযোগ্য। রাশিয়া শুধু সামরিক অবস্থানে হামলা করলেও সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণহত্যার বিষয়গুলো তদন্ত শুরু করেছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত বা আইসিসি। অথচ ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনে যুদ্ধাপরাধ প্রমাণ হওয়ার পরও কোনো রাখঢাক নেই কথিত মানবাধিকারের ধ্বজাধারীদের মুখে।

গত ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার অজুহাতে ইসরায়েল পাঁচ মাস ধরে গাজা ভূখণ্ডের ওপর নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালাচ্ছে। ইসরায়েল আত্মরক্ষার নাম করে ফিলিস্তিনের গাজায় যা করছে, তা কোনো সাধারণ যুদ্ধ নয় বরং পরিকল্পিত গণহত্যা। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ইসরায়েল আন্তর্জাতিক কোনো আইনের তোয়াক্কা করছে না। সেখানে শিশুসহ হাজার হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা, বাড়িঘর গুঁড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া, হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রে হামলা করে নির্বিচারে হত্যা, খাবার সরবরাহে বাধাদান জাতিগত নিধনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। গাজার এমন কোনো স্থাপনা নেই, যা আক্রান্ত হয়নি কিংবা অক্ষত আছে। সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, হামাসের সব অবকাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পুরো গাজা শহর এবং গাজা উপত্যকার উত্তর অংশে হামলা চালাবে।

অন্যদিকে, রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধে এ পর্যন্ত ৩১ হাজার সেনা মারা গেছে বলে সম্প্রতি প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদেমির জেলেনস্কি নিজেই এত বড়সংখ্যক সেনা মৃত্যুর সংখ্যাটি স্বীকার করেছেন। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ তৃতীয় বছরে পড়ার পর জেলেনস্কি এই হিসাব দিলেন। তাহলে আহত কিংবা সারাজীবনের জন্য পঙ্গু সেনার সংখ্যাটি অবশ্যই এর বেশি বা কয়েক গুণ হতে পারে এটা সহজেই অনুমেয়। এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তার পরও দেশটির প্রায় এক-চতুর্থাংশ ভূখণ্ড রাশিয়ার দখলে চলে গেছে। যুদ্ধের শুরু থেকে বাইডেন প্রশাসন এ পর্যন্ত ইউক্রেনে ১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা পাঠিয়েছে। গত ১২ জানুয়ারি, ২০২৪ তারিখ প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায় যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট কংগ্রেস অনুমোদন না দেওয়ায় ইউক্রেনে মার্কিন সহায়তা প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে যদি এই ইস্যুতে কংগ্রেস তার অবস্থান পরিবর্তন করে, শুধু তাহলেই ফের প্রদান করা সম্ভব হবে সহায়তা। বাইডেন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মিত্র দেশে সামরিক সহায়তা বাবদ ১০ হাজার কোটি ডলার চেয়ে কংগ্রেসে গত ডিসেম্বরে একটি বিল পাঠিয়েছিল। এই প্যাকেজের মধ্যে ইউক্রেনের জন্য বরাদ্দ ছিল ৬ হাজার কোটি ডলার। কিন্তু সেই বিলটি আটকে দিয়েছে কংগ্রেস। ডিসেম্বরের শেষ দিকে অবশ্য কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে নিজের প্রেসিডেনশিয়াল ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে ইউক্রেনে ২৫ কোটি ডলারের একটি সহায়তা প্যাকেজ পাঠিয়েছিলেন বাইডেন, কিন্তু সেজন্য তিনি কংগ্রেসে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন।

অথচ হামাসের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সাহায্যে দ্রুত এগিয়ে এসেছে। বিমানে করে অস্ত্র পাঠিয়েছে ও ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন থাকা রণতরীকে উপকূলের কাছাকাছি এনে রেখেছে। এ ছাড়া সমর্থন জানাতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উড়ে যান তেল আবিবে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে আস্থাভাজন বন্ধুরাষ্ট্র ইসরায়েল। ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের মাত্রাটাও তাই বেশি। তবে ইসরায়েরের সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া ইসরায়েল ১৯৪৬ থেকে ২০২৩ সালের পর্যন্ত প্রায় ২৬৩ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহায্য পাওয়া মিসরের চেয়ে ১ দশমিক ৭ গুণ বেশি। মিসর গত ৭৭ বছরে ১৫১.৯০ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। ২০২৩ সালেও মার্কিন সামরিক তহবিল পাওয়ায় শীর্ষে ইসরায়েল, ৩.৮০ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে দেশটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইসরায়েলকে সামরিক ও প্রতিরক্ষা সহায়তা হিসেবে ১২৪ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। গত বছর ইসরায়েলকে দেওয়া ৩.৮০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তার মধ্যে অর্ধ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য। ওয়াশিংটন বলেছে, হামাসের বিরুদ্ধে সর্বশেষ যুদ্ধে ব্যবহৃত ইসরায়েলি অস্ত্রের ঘাটতি তারা পূরণ করে দেবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েল সবচেয়ে বেশি মার্কিন সামরিক সহায়তা পেয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসের নীতিনির্ধারণ বিষয়ে সংস্থা কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের তথ্য থেকে জানা যায়, আজ পর্যন্ত ইসরায়েলকে দ্বিপক্ষীয় সহায়তা ও সামরিক অর্থায়ন বাবদ যুক্তরাষ্ট্র ১৫,৮০০ কোটি ডলার দিয়েছে। গত বছর মার্কিন সামরিক অর্থায়নে ইসরায়েলের জন্য বরাদ্দ ৩৮০ কোটি ডলার, যা সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনের সময় স্বাক্ষরিত একটি ১০ বছরমেয়াদি চুক্তির অংশ। এ অনুসারে, ২০১৯ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলকে ৩,৮০০ কোটি ডলার সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ওয়াশিংটন। এদিকে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে জো বাইডেন প্রশাসন ও মার্কিন কংগ্রেস ইউক্রেনের জন্য ৭,৫০০ কোটি ডলারেরও বেশি সহায়তা দিয়েছে। জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিয়েল ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার্ল্ড ইকোনমি অনুসারে এ অর্থের মাঝে মানবিক, আর্থিক ও সামরিক সহায়তা অন্তর্ভুক্ত। যার প্রায় ৬০ শতাংশ সামরিক-সম্পর্কিত। এর মধ্যে রয়েছে অস্ত্র ও নিরাপত্তা সহায়তা।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বেশ কয়েকবার গাজায় স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নিলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা ও ভেটোর কারণে প্রত্যেকটি পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়েছে। আরব লিগ এ ঘটনাকে ফিলিস্তিনিদের গণহত্যায় ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে। কয়েক দিন আগে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা ঠেকানোর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে এবং আদালতের আদেশের পর কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো তা এক মাসের মধ্যে আইসিজেতে জানাতে ইসরায়েলের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সারা বিশ্বে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠলেও তাতে ইসরায়েল ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র আমেরিকা বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করছে না। ইসরায়েল নারী-শিশুসহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর যে নারকীয় গণহত্যা চালাচ্ছে, তা যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদেশগুলোর প্রশ্রয়ের কারণেই হচ্ছে। পশ্চিমা বেশির ভাগ গণমাধ্যমও একই নীতি অনুসরণ করছে। তাদের সহযোগী ও পুঁথি পড়ানো মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইসরায়েলের বর্বরতা দেখেও না দেখার ভান করছে, তাদের বিবেক বুদ্ধি ও তথাকথিত মানবাধিকারের আসল রূপ এখন উন্মোচিত হচ্ছে! তাদের বিবেক এখন গণহত্যার জয়গানে বিভোর, তথাকথিত মানবাধিকারের বয়ান তাদের কাছে বুলি আওড়ান পুঁথি ছাড়া আর কিছুই নয়! আমেরিকা ও তার মিত্ররা যে পরিমাণ সহায়তা ইউক্রেনকে দিয়েছে, সেই পরিমাণের সিকিভাগ সহায়তা যদি হামাস পেত, তবে ইসরায়েল নামক অবৈধ রাষ্ট্রটি মানচিত্র থেকে সম্পূর্ণ মুছে যেত। আমেরিকা একদিকে ইউক্রেনে গণতন্ত্র রক্ষার মায়াকান্না করছে, অন্যদিকে গাজায় গণহত্যার সহযোগী হিসেবে কাজ করছে- এটাই আমেরিকার মুখোশধারী দ্বিমুখী চরিত্রের আসল বৈশিষ্ট্য।

লেখক : ব্যাংকার ও কালাম লেখক

[email protected],

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close