ড. আশেক মাহমুদ

  ১০ মার্চ, ২০২৪

বিশ্লেষণ

কর ব্যবস্থাপনায় সংকট উত্তরণে করণীয়

বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় কর আদায় সম্পর্কিত একটি তথ্য প্রকাশিত হয়। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আয়োজিত প্রাক-বাজেট আলোচনায় বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি প্রকাশ করে, দেশের ৮৭ শতাংশ ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্ত কর দেন না; তবে দেশে ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্তদের মধ্যে আয়কর প্রদানকারীর সংখ্যা হবে ৯-১০ লাখ; অথচ এই সংখ্যা হওয়ার কথা ছিল ৭৮ লাখ ৩২ হাজার। ৭৮ লাখের মধ্যে যখন ৬৮ লাখ ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্ত কর ফাঁকি দেয়, তখন এ বিষয়টিকে হালকা করে দেখা সম্ভব নয়।

কেন এ বিষয়টি উদ্বিগ্নতার? কারণ এনবিআর যত টাকার রাজস্ব আদায় করছে, তার অর্ধেকের বেশি অর্থ সরকারকে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ করতে হচ্ছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রজেক্টের জন্য বিদেশি ঋণের পরিমাণ যেমন বাড়ছে, ঋণ পরিশোধের বিদেশি চাপও বেড়ে গেছে। এতে করে বিভিন্ন প্রজেক্টের উন্নয়নমূলক অভিযাত্রা অব্যাহত আছে ঠিকই, কিন্তু ঋণের চাপের বোঝা বহন করা আরো কঠিন হয়ে গেছে। ঋণের চাপ কমানোর জন্য রাজস্ব আদায়ের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে উপনীত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

এটা সহজেই অনুমেয়, জিডিপি বৃদ্ধি পেলে ঋণের ওপর চাপ কমে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। অথচ গত ১০ বছরে জিডিপি বেড়েছে ৪ গুণ, কিন্তু রাজস্ব আদায় বেড়েছে মাত্র আড়াই গুণ। কর-জিডিপি অনুপাতের এই বেহাল দশা প্রমাণ করছে, এনবিআর রাজস্ব আদায়ের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিকে এখনো জনবান্ধব করতে পারেনি। কর বা রাজস্ব আদায় পদ্ধতিতে নবায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও আশানুরূপ ফল আসেনি। এর অন্যতম কারণ হলো কর আদায়ের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি এখনো শ্রেণি নিরপেক্ষ হয়নি। বরং যে শ্রেণি অধিক মাত্রায় কর দিতে বাধ্য, তাদের ওপর নমনীয়তা প্রদর্শন আগের মতোই রয়ে গেছে।

উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, এ পর্যন্ত দেড় লাখের বেশি কোম্পানি যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্ম নিবন্ধিত হয়েছে। কোম্পানি আইন অনুযায়ী, এসব কোম্পানি ও ফার্ম বার্ষিক রিটার্ন জমা দিতে বাধ্য। অথচ চলতি অর্থবছরে দেড় লাখের মধ্যে মাত্র ২৬ হাজার কোম্পানি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) বার্ষিক রিটার্ন জমা দিয়েছে। বাকি ১ লাখ ২৪ হাজার কোম্পানি যে কোম্পানি আইনকে অবজ্ঞা করে রিটার্ন জমা দেয়নি, সে ব্যাপারে এনবিআর কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা আমাদের কাছে অজ্ঞাত রয়ে গেছে। এনবিআরের পক্ষ থেকে এমন নমনীয়তার কারণ কী আর কর ফাঁকি দেওয়া কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে করণীয় কী- এ ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি অত্যাবশ্যক হলেও কেন জানি নিষ্ক্রিয়তাই চোখে পড়ছে।

কর ব্যবস্থাপনাকে নৈতিক মানদ-ে দাঁড় করাতে হলে জবাবদিহির স্পষ্ট নিয়মনীতি থাকা যেমন বাঞ্ছনীয়, তেমনি এর প্রয়োগ কীভাবে হবে তার রূপরেখা থাকা দরকার। প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান চারটি চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করতে হয়।

এক. ধনীদের কর প্রদানে অনীহা।

দুই. রাজস্ব আদায়কারীদের সঙ্গে ধনিক প্রতিষ্ঠানের অনৈতিক লেনদেন।

তিন. অসমন্বিত রাজস্ব নীতি।

চার. এনবিআরকে গতিশীল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার ব্যর্থতা।

এক. ধনীদের কর প্রদানে অনীহা : ধনিক শ্রেণির সাধারণ একটা চরিত্র হলো (ব্যতিক্রম বাদে), তাদের ধনের পরিমাণ যত, আকাঙ্ক্ষা আর চাহিদার পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্বায়নের এই যুগে ধনিক শ্রেণি তাদের ধনকে নিজ দেশে রাখার চেয়ে দেশের বাইরে পাঠানোকে অধিক গুরুত্ব দেয়। এটা বিশ্বায়িত ভোগবাদের প্রকাশ। সে কারণে, পুঁজি পাচারের পরিমাণ মাত্রাধিক বেড়ে গেছে। আমাদের দেশের ধনীদের বেশির ভাগ অর্থসম্পদ এখন বিদেশের মাটিতে সঞ্চালিত হয় বেশি। এতে করে দেশের শিল্পায়ন কমে যায় আর বিদেশি পণ্যের ওপর আমাদের নির্ভরতা বেড়ে যায়। শিল্পায়ন হ্রাসের এমন পরিস্থিতিতে রপ্তানিমুখী অর্থনীতি দুর্বল হয়।

দুই. অনৈতিক লেনদেন : কর ব্যবস্থাপনাকে জনবান্ধব ও রাষ্ট্রবান্ধব করতে হলে দীর্ঘদিন ধরে চালু থাকা ধনিক শ্রেণির সঙ্গে কর আদায়কারীদের অনৈতিক লেনদেন বন্ধ করা অত্যাবশ্যক। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক নিয়োগে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহির জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিকাঠামো। ‘প্রাতিষ্ঠানিক লেনদেন মনিটরিং সেল’ গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রতিষ্ঠানকে আলাদা ক্ষমতা দিতে হবে। এতে করে রাজস্ব আদায়ের বিষয়াদি আইনি ব্যবস্থাতে নিষ্পত্তি হবে। অনৈতিক লেনদেনের কারণে রাজস্ব আদায়কারী এবং রাজস্ব প্রদানকারী উভয়ে আসামি হতে পারে। সমস্যা হলো, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারে আসামিদের শাস্তির আওতায় আনা কঠিন হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সেল, এনবিআর এবং বিচার বিভাগের প্রায়োগিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

তিন. অসমন্বিত রাজস্ব নীতি : এখনো কর প্রদানকে ব্যক্তি স্বাধীনতার আওতায় রাখা হয়েছে। যারা আয়কর প্রদান করছে, তারাই বরং অনেক বেশি হয়রানির শিকার। যেহেতু আয়কর প্রদানকারীদের তথ্য এনবিআরের কাছে নথিভুক্ত আছে। ফলে যারা আয়কর দিচ্ছে না, তারাই বেশি মাত্রায় বহাল তবিয়তে আছে। এমনও দেখা গেছে, যারা নিয়মিত আয়কর দেয়, তাদের ভ্যাটও (মূল্য সংযোজন কর) দিতে হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আদায়ের জন্য স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস বা ইএফডি সিস্টেম চালু করেছে। তবু এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ প্রশ্নের সম্মুখীন। সঠিক তদারকির অভাবজনিত কারণে দেখা যায়, ভ্যাট আদায়ের জন্য যে ইসিআর মেশিনের রসিদ দেওয়া হয়, তা অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় না। এতে করে ভ্যাটের নামে কোনো কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভোক্তাদের পকেট কাটছে। আরো উল্লেখ্য, অধিকাংশ পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কর্তনের নিয়ম থাকায় ভোক্তা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। সেই অসন্তোষের কারণে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সরকারকে ভ্যাট প্রদান করতে কারসাজির পন্থা অবলম্বন করে। সব ক্ষেত্রে ইএফডি সিস্টেম চালু না করা ব্যবসায়িক শ্রেণি সেই সুযোগ নিতে পারছে। এমতাবস্থায় রাজস্ব আদায়ের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

চার. গতিশীলতা হ্রাসের কারণ ও করণীয় : এরূপ অব্যবস্থাপনা উত্তরণে এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সংস্কার অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। মূল্য সংযোজন কর আদায়ের জন্য স্বয়ংক্রিয় ইএফডি সিস্টেম চালু করলেও তার সর্বত্র ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তবে মূসক বা ভ্যাটের হার কমিয়ে আদায়ের পরিমাণ বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। তবে আয়কর আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে উল্লেখযোগ্য সংস্কার আনতে না পারলে ভারসাম্য আনা কঠিন হয়ে পড়বে। ওপরে উল্লিখিত যে ৮৭ শতাংশ ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্ত (৬৮ লাখ) কর দেন না, তাদের কাছ থেকে কর আদায়ের পদ্ধতি বের করতে হবে। বাংলাদেশ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীর সংখ্যা (টিআইএন) বর্তমানে প্রায় ৮৮ লাখে দাঁড়িয়েছে অথচ কর দিচ্ছে মাত্র ১৮ লাখ; যার মধ্যে ১০ লাখ সরকারি চাকরিজীবী ও অন্যান্য চাকরিতে নিয়োজিত। এ থেকে বোঝা যায়, করপোরেট কর আদায়ের হার খুবই কম। করপোরেট কর আদায়ের জন্য ইএফডি সিস্টেমের মতো নতুন কোনো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু করা যায় কি না, সে বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে না দেখলে ধনিক শ্রেণি কর ফাঁকির সুযোগ আরো বেশি মাত্রায় নিতে থাকবে।

যেহেতু করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সবকিছুর লেনদেন ব্যবসায়িক সিস্টেমে চলে, সে কারণে করপোরেট কর আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দিতে হবে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের সব হিসাব সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এনবিআরকে দাখিল করবে। এনবিআর সেই হিসাবের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের দাখিলকৃত হিসাবের মধ্যে সমন্বয় করবে। আর সেই আলোকে কর আদায় নিশ্চিত করবে। শুধু তা-ই নয়, অন্যান্য করের সঙ্গে সঙ্গে করপোরেট কর আদায়ের বার্ষিক প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি থাকবে। বার্ষিক আয়কর প্রদানকারীদের এনআইডি কার্ডের মতো কর কার্ড দিতে হবে। একটা হবে সাধারণ কর কার্ড; আরেকটি হবে করপোরেট কর কার্ড। সাধারণ কর কার্ডধারীদের জন্য প্রণোদনা হিসেবে ভ্যাটের হার কম থাকবে (হতে পারে ৫ শতাংশ কম); করপোরেট কর কার্ডধারীদের জন্য ভিন্নভাবে প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখতে পারে। তবে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি ও আয়ের মান বিচার করে করমুক্ত আয়সীমা আর করের হার পুনর্নির্ধারণের প্রয়োজন রয়েছে। আয়সীমা বাড়িয়ে করের মাত্রা কমিয়ে আনলে আদায়ের হার আরো বৃদ্ধি পাবে- এই চিন্তার আলোকে সংস্কার আনতে হবে। অল্প আয়ের নাগরিকদের ওপর করের অল্প চাপ আর অধিক আয়ের ওপর অধিক চাপ- এই সূত্রের সঠিক প্রয়োগে দেশের অর্থনীতিতে গতি আসবে, কমে আসবে দেশি-বিদেশি ঋণের ওপর সরকারি নির্ভরশীলতা। এতে করে কর্মসংস্থান বাড়বে, বাড়বে রপ্তানিমুখী অর্থনীতি। অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টির সুযোগ সৃষ্টি হবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close