মুজিবুল হাসান চৌধুরী

  ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

চাষাবাদ

চারা রোপণ ও রিলে পদ্ধতিতে পাটচাষ

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি। এটি শ্রমশক্তির ৪০ ভাগ জোগান দিয়ে থাকে। বিবিএস রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের জিডিপিতে এর অবদান ১১.২২ শতাংশ। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্যদূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় এ খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল হলো পাট। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে ১৫ দশমিক ২ লাখ টন পাট উৎপন্ন হয়। পাট প্রাকৃতিক তন্তু হিসেবে আমাদের জন্য আশীর্বাদ।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে ১ হেক্টর জমিতে চাষকৃত পাট ১০০ দিনে প্রায় ১৫ টন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে ও প্রায় ১২ টন অক্সিজেন পরিবেশে নির্গত করে। এসডিজি লক্ষ্য ২ এবং টার্গেট ২.৩ অর্জনের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষির উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করা প্রয়োজন। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ২০২১-৪১ অনুযায়ী আগামী দুই দশকের মধ্যে কৃষি উৎপাদনের বাণিজ্যিকীকরণকে বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। বিপরীতে কৃষিজমি বার্ষিক প্রায় শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে। কৃষি গবেষকদের মতে, অনুভূমিক (এলাকা সম্প্রসারণ) এবং উল্লম্ব (ফলন বৃদ্ধি) সম্প্রসারণ পদ্ধতির মাধ্যমে ফসলের উৎপাদনশীল আরো বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

আমাদের দেশে অন্যতম প্রচলিত শস্যবিন্যাস হচ্ছে বোরো-পতিত-রোপা আমন। বোরো-পতিত-রোপা আমন শস্যবিন্যাসের আওতাধীন ২৩,০৬,০০৫ হেক্টর মাঝারি উঁচু জমি ৮০-৯০ দিন বোরো ও রোপা আমন ধানের মাঝে এলাকা ভেদে এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত পতিত থাকে। ওই সময় বিজেআরআই উদ্ভাবিত উন্নত শস্যবিন্যাস বোরো-পাট-রোপা আমন; বোরো/পাট-রোপা আমন; বোরো-রোপা পাট-রোপা আমন; প্রতিস্থাপন করে ক্রপিং সিস্টেমের উন্নয়নের মাধ্যমে আঁশের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। কারণ পাট জাতীয় আঁশ ফসল সাধারণত ১২০ দিন বা ৪ মাস বয়সে সংগ্রহ করা হয় আর পাট বা কেনাফ ফসল বোরোর সঙ্গে ২০-২৫ দিন রিলে আবাদ করে ১১০-১২০ দিনের ফসল কাটা সম্ভব হবে। এ ছাড়া ৩০-৩৫ দিনের চারা রোপণের মাধ্যমেও পাট ও কেনাফ আবাদ করা যায়। সে ক্ষেত্রে রিলে ও চারা রোপণের মাধ্যমে এই বিশাল পতিত জমিতে পাটকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে দেশের শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি করা সম্ভব।

ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, নেত্রকোনা, গাইবান্ধা, নওগাঁ, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, রংপুর, যশোর, বগুড়া, জামালপুর, শেরপুর ইত্যাদি জেলার ফসলি জমির ৩৫-৭০ শতাংশ বোরো-পতিত-রোপা আমন শস্যবিন্যাস বিস্তৃত। ওই অঞ্চলের শস্য নিবিড়তাও কম। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় নিম্নমানের। অর্থাৎ এ অঞ্চলের বোরো-পতিত-রোপা আমন শস্যবিন্যাসে পাট ফসল অন্তর্ভুক্ত করলে ফসলের উৎপাদনশীলতা ও নিবিড়তা বৃদ্ধি পাবে। মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাই এ অঞ্চলের মানুষের দরিদ্রতা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে।

এ ছাড়া একই জমিতে ফসলের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের জুট ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগের অধীনে কৃষকের প্রচলিত শস্যবিন্যাস বোরো-পাট-রোপা আমনের বিকল্প চার ফসলি উন্নত শস্যবিন্যাস বোরো/পাট-রোপা আমান/সরিষা (বিকল্প শস্যবিন্যাস-১) এবং বোরো-রোপা পাট-রোপা আমান/সরিষার (বিকল্প শস্যবিন্যাস-২) তুলনামূলক শস্যবিন্যাসভিত্তিক ফলন, আয় ও ব্যয় পরীক্ষা করা হয়। ধানভিত্তিক চার ফসলি শস্যবিন্যাসে বোরোর সঙ্গে রিলে এবং রোপা পাট পদ্ধতিতে সফলভাবে চাষ করা সম্ভব হয়েছে। ওই শস্যবিন্যাসের চারটি ফসল মিলে ধানের সমতুল্য ফলন প্রতি হেক্টরে বিকল্প শস্যবিন্যাস-১-এ পাওয়া যায় ১৮ দশমিক শূন্য টন ও বিকল্প শস্যবিন্যাস-২-এ পাওয়া যায় ১৯ দশমিক ৬৬ টন। অন্যদিকে কৃষকের বোরো-পাট-রোপা আমন শস্যবিন্যাসের তিন ফসল মিলে ধানের সমতুল্য ফলন প্রতি হেক্টরে ১৬.৪৫ টন। কৃষক অনুসৃত তিন ফসলভিত্তিক শস্যবিন্যাসের চেয়ে প্রতি হেক্টরে বছরে আয় ও মুনাফা বোরো/পাট-রোপা আমান/সরিষা শস্যবিন্যাসে এ ৮-৯ শতাংশ এবং বোরো-রোপা পাট-রোপা আমান/সরিষা শস্যবিন্যাসে ২০-২২ শতাংশ বেশি পাওয়া যায়। নগদ খরচের ভিত্তিতে রিলে ও রোপা পাট পদ্ধতি অনুসৃত শস্যবিন্যাসে এমবিসিআর ২.৫-এর বেশি রেকর্ড করা হয়। সামগ্রিক ফলন এবং অর্থনৈতিক সুবিধার ভিত্তিতে কৃষক অনুসৃত তিন ফসলি শস্যবিন্যাসের চেয়ে চার ফসলি উন্নত শস্যবিন্যাস অনুসরণ করে বেশি লাভ করা সম্ভব।

এখন আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, উৎপাদন বাড়িয়ে কী লাভ? প্রকৃতপক্ষে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে পাটের অবদান ত্বরান্বিত করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এই প্রাকৃতিক তন্তুর রয়েছে নানামুখী ব্যবহার। পাট থেকে তৈরি হচ্ছে বস্তা, চট, জিও ব্যাগ, ওল, হ্যান্ডমেইড পেপার, পাল্প, প্রসাধনী, জুতা, টিস্যু বক্স, পর্দা, জুটিন, স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ নানা পণ্য। প্রতি বছর বাংলাদেশ পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আয় করে। পাট থেকে তৈরি পণ্য পরিবেশের জন্য ভালো, কারণ এটি সহজে মাটিতে মিশে যায় অর্থাৎ জৈব পচনশীল। পাটের আঁশে ৬০-৬৫ শতাংশ সেলুলোজ থাকে, সেই সেলুলোজকে কাজে লাগিয়ে পাট ও পাটজাতীয় আঁশ থেকে মাইক্রোক্রিস্টালাইন তৈরি করা হচ্ছে, যেটি ওষুধশিল্পে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া পাটকাঠি থেকে অ্যাকটিভ্যাটেড কার্বন এক্সট্রাকশন করে প্রিন্টার ও ফটোকপির কালি উৎপাদন করার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতির খসড়ায় ২০৪১ সালের মধ্যে জ্বালানির ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। পাটশিল্পে উৎপন্ন পাটের বর্জ্য ব্যবহার করে জ্বালানি তৈরি করা হচ্ছে, যা আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে কাজ করবে। শুধু আঁশ হিসেবে নয় পুষ্টির চাহিদা পূরণেও পাট ভূমিকা রাখছে। শাক হিসেবেও পাটের অনেক জনপ্রিয়তা রয়েছে এবং পাটের পাতা থেকে তৈরি হচ্ছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ চা। বিজেআরআই মেস্তা-২ (সবজি মেস্তা-১) এটি চুকুর হিসেবে সারা দেশে পরিচিত। এর মাংসল বৃতি (শাঁস) কনফেকশনারি খাদ্যসামগ্রী যেমন : জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, চা ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। চুকুরের পাতা ও ফলে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, কেরোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-সি ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান থাকে।

এলডিসি থেকে ২০২৬ বাংলাদেশের চূড়ান্তভাবে উত্তরণ হবে। এলডিসি থেকে চূড়ান্তভাবে বের হওয়ার পর বাংলাদেশের রপ্তানি বহুমুখীকরণ একটা চ্যালেঞ্জ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় প্রতি বছর ২.৭ বিলিয়ন ডলার কমার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ ১২ শতাংশ কর সুবিধা হারাবে ইউরোপীয় বাজারে, ৬.৭ শতাংশ বাড়তি ট্যারিফ গুনতে হবে রপ্তানির ক্ষেত্রে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য পরবর্তী সময়গুলোতে জিএসপি প্লাস সুবিধা আদায়, উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বা এফটিএ (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট), দ্বিপক্ষীয় বা আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তির বাস্তবায়ন, প্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি বা পিটিএ (প্রিফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট), বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়ানোসহ দক্ষ শ্রমিক শক্তি তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। পাট ও পাটজাত পণ্য এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, যার জন্য দরকার প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা। বাংলাদেশের যে ৫টি পণ্য থেকে রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে তার মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্য অন্যতম। আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক থেকে। একটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। রপ্তানি পণ্য ও বাজারে বৈচিত্র্যায়ণ আনতে হবে। রপ্তানি পণ্যকে সম্প্রসারণ ও উৎসাহীকরণের জন্য ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার বর্ষপণ্য ঘোষণা করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালকে ‘পাট বর্ষপণ্য’ ঘোষণা করা হয়েছে, যা পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি সম্পসারণে ভূমিকা রাখবে ও উদ্বুদ্ধ করবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাটকে কৃষিপণ্য ঘোষণ করায় অন্যান্য কৃষি ফসলের মতো অল্পসুদে ঋণ সুবিধা ভোগ করবেন পাটচাষিরাও। পতিত জমিতে পাট অন্তর্ভুক্তি, রোপা ও রিলে পদ্ধতির মাধ্যমে শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি প্রেক্ষিত পরিকল্পনার লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্য ৩ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণে প্রাকৃতিক তন্তু পাটের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। যথাযথ পরিকল্পনা, আধুনিকীকরণ, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে এই খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানি বহুমুখীকরণের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে, যা ২০৩১ সালে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ, ২০৪১ সালে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পথকে প্রশস্ত করবে।

লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা

জুট ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগ, বিজেআরআই, ঢাকা-১২০৭

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close