সাকিবুল হাছান

  ০৭ জুন, ২০২৩

মুক্তমত

ছয় দফার মধ্যেই স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল

১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের লাহোরে বিরোধী দলের একটি সম্মেলনে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য তার ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন। এই ছয় দফা কর্মসূচি বাঙালির ‘মুক্তির সনদ’ হিসেবে পরিচিত।

প্রতি বছর ৭ জুনকে বাংলাদেশে ‘৬ দফা দিবস’ পালন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়। এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ ১১ জন বাঙালি নিহত হন। ছয় দফা মূলত স্বাধীনতার এক দফা ছিল। ছয় দফার মধ্যেই স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল।

১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাঙালি স্বাধীন হয়েছে। আমরা ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিয়মে এই দেশ পেয়েছি। কিন্তু বাঙালির স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়েছে অনেক আগে। ১৯৪৭-এর দেশভাগ থেকে শুরু করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিরা সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারত না। প্রথম থেকেই পূর্ব বাংলার ওপর পশ্চিম অংশের এক ধরনের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ কায়েম হয়। বাংলার মাটিকে স্বাধীন করার বীজ বপন হয় বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৬৬ সালের ছয় দফার দাবির মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত ছয় দফা দাবি বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তিস্তম্ভ স্বরূপ।

স্বায়ত্তশাসনের আড়ালেই মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার নীলনকশা তৈরি হয়। পূর্ব পাকিস্তানের ছয় দফা কর্মসূচি বাঙালিদের ওপর দীর্ঘদিনের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের শিকড়ে আঘাত করে। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, তারা যদি ছয় দফা দাবি মেনে নেন, তাহলে পূর্ব পাকিস্তান আর তাদের সঙ্গে থাকবে না।

ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য- পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল বা যৌথরাষ্ট্র এবং ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই ফেডারেশন বা যৌথরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। পরে এই ছয় দফা দাবিকে কেন্দ্র করে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার করা হয়। পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তান নয়, মূলত স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জনগণের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সোপান ছিল ছয় দফা দাবি। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে দাবি মানেই ছিল ঘোরতর অপরাধ, ছয় দফাকে তারা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান আলাদা করার প্রচেষ্টা বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, অত্যাচার করে বন্ধ করতে চেয়েছে, দাবিতে রাখতে চেয়েছে দাবি উত্থাপনকারী শেখ মুজিবুর রহমান। আসলে তাদের মূল লক্ষ্যই ছিল নিজ স্বার্থ। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ছয় দফা দাবি আমাদের বাঁচার দাবি। তার ভাষ্যে বলতে গেলে, ‘আমরা পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাস করি, তবে আমাদের ন্যায্য দাবিও চাই, অন্যকে দিতেও চাই। কলোনি বা বাজার হিসেবে বাস করতে চাই না। নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার চাই।’

ছয় দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন।

৬ দফার দাবিসমূহ : এক : শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি-

লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে।

দুই : কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা- কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা শুধু মাত্র দুটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে- দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট বিষয়গুলো অঙ্গ রাজ্যগুলোতে ন্যস্ত করা উচিত।

তিন : মুদ্রা ও অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা- মুদ্রার ব্যাপারে দুটির যেকোনো একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারে। (ক) সমগ্র দেশের জন্য দুটি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে। অথবা (খ) বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্য শুধু একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে।

চার : রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা- ফেডারেশনের অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনোরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গরাষ্ট্রীয় রাজস্বর একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে।

পাঁচ : বৈদেশিক বাণিজ্যবিষয়ক ক্ষমত- যৌথরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্য যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে, সেই অঙ্গরাজ্যের সরকার যাতে স্বীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে তার পৃথক হিসাব রাখতে পারে, সংবিধানে সেরূপ বিধান থাকতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হবে, সংবিধান নির্দেশিত বিধি অনুযায়ী নির্ধারিত অনুপাতের ভিত্তিতে অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে তা আদায় করা হবে। সংবিধান নির্দেশিত বিধানানুযায়ী দেশের বৈদেশিক নীতির কাঠামোর মধ্যে, যার দায়িত্ব থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে, বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কে চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক সরকারগুলোর হাতে থাকবে।

ছয় : আঞ্চলিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা- আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীন আধাসামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।

১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি সংগৃহীত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকাণ্ডসংবলিত ছয় দফা কর্মসূচির একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। যার নাম ছিল ছয় দফা : আমাদের বাঁচার দাবি। ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধীদলীয় সম্মেলনে ছয় দফা পেশ করেন। ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গে মিল রেখে। ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব।

লেখক : সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close