এস এম মুকুল

  ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

কৃষিই ভবিষ্যৎ কৃষিই ভরসা

কৃষি মানে এখন আর শুধু ধান, পাট আর কিছু শস্য উৎপাদনে সীমাবদ্ধ নেই। কৃষিতে সারা বছর ফলানো হয় সবজি, ফল, মাছ চাষ, গবাদিপশু পালন এমনকি কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনাও হচ্ছে। তবে কৃষির অন্যতম সাফল্য হলো- দেশে ধান উৎপাদনে এসেছে বিপ্লব। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের পেশা কৃষির উন্নয়ন ঘটাতে পারলেই দেশের উন্নতি করা সম্ভব। তবে তার মতে কৃষি মানে শুধু ফলন বৃদ্ধি করা নয়- কৃষকের হাতে তার ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রদান এবং আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে কৃষকদের উৎপাদনে আগ্রহী করে তোলাই হবে সফলতার দাওয়াই। তিনি কৃষিতে দক্ষতা অর্জন এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের আবশ্যকতা বুঝতে পেরে নিজের ছেলেকে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজে না পাঠিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত কৃষক তৈরি করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। দেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি কৃষির সম্ভাবনার কথা বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। ২৬ মার্চ ১৯৭৫ জনসম্মুখে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া শেষ ভাষণে সোনার বাংলা গড়ার ডাক দিয়ে তিনি বলেন, ‘ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত নাই। আমি ভিক্ষুক জাতির নেতা হতে চাই না। আমি চাই বাংলাদেশের কৃষক ভাইদের কাছে, যারা সত্যিকারের কাজ করে। যারা প্যান্ট পরা-কাপড় পরা ভদ্রলোক তাদের কাছেও চাই- জমিতে যেতে হবে। ডাবল ফসল করুন। তাহলে কারো কাছে ভিক্ষুকের মতো হাত পাততে হবে না।’ কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। কৃষি আমাদের সমৃদ্ধির অন্যতম উৎস। কাজেই কৃষিই বাংলাদেশের একমাত্র ভরসা এবং ভবিষ্যৎ। দেশ-বিদেশের গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোও বলছে- বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করতে হলে কৃষিতে মনোযোগ দিতে হবে। কৃষিই পথ দেখাবে আমাদের।

কৃষি মানে এখন আর শুধু ধান, পাট আর কিছু শস্য উৎপাদনে সীমাবদ্ধ নেই। কৃষিতে সারা বছর ফলানো হয় সবজি, ফল, মাছ চাষ, গবাদিপশু পালন এমনকি কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনাও হচ্ছে। তবে কৃষির অন্যতম সাফল্য হলো- দেশে ধান উৎপাদনে এসেছে বিপ্লব। দেশে স্বাধীনতার আগে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান আমলে উৎপাদন স্বল্পতার কারণে বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানি করে রেশনে দেওয়া হতো। ৭১-এর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, এ দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। বাংলাদেশে বর্তমান জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি। স্বাধীনতার পর ৪১ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হতো, এখনো সেই একই পরিমাণ ধান উৎপাদিত হলে, এই দ্বিগুণ জনসংখ্যার অবস্থাটা কী হতো ভাবা যায়! ১৯৭০ সালে দেশে চাল উৎপাদিত হয়েছিল প্রায় এক কোটি টনের মতো। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণার সফলতার কারণে নতুন নতুন উন্নত জাতের ধান আবিষ্কার হয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তন, বিরূপ আবহাওয়া, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খড়া, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস পেরিয়ে কৃষিই বাংলাদেশের অন্যতম চালিকাশক্তি। পরিবেশের প্রতিকূলতা পেরিয়ে হারিকেন আর ক্যাটরিনার যুগে বাংলাদেশে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ধান উৎপাদনে এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত ব্রি-২৭, ব্রি-২৮ এবং ব্রি-২৯ এর দ্বারা ধান উৎপাদনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। উদ্ভাবন করেছে বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধান। এভাবে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।

বর্তমানে লবণাক্ত সহিষ্ণু ধান আবিষ্কারের ফলে লবণাক্ত জমিতেও বাম্পার ফলন হতে শুরু করেছে। এ জাতের ধানের চাহিদা চীন, ভারত, ইরাক, সিয়েরালিওন, ঘানা, গাম্বিয়া, মিয়ানমার, ভুটান, নেপাল প্রভৃতি দেশেও ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট হাইব্রিডসহ ৪৫টি উচ্চফলনশীল ধান উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে ১টি রোপা আউশ, ৪টি বোনা আউশ, ২০টি রোপা আমন, ১১টি বোরো এবং রোপা আমনের অনুরূপ উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে দেশে যেসব ধান উৎপাদিত হচ্ছে তার ৮০ ভাগ ধানই এসব উন্নত জাতের। ফসলের আগাছা নির্মূল, ধান কাটা, মাড়াই ও ঝাড়ার কাজ, বীজ বপন, সার ও কীটনাশক ছিটানো প্রভৃতি কাজের জন্য ব্রির গবেষণা বিভাগের নেতৃত্বে প্রায় ২০ প্রকার আধুনিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছে। শস্য, সবজি, ডাল, মসলা, ফলসহ বিভিন্ন ফসলের ২৬০টি জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘বারি’। প্রতিষ্ঠানটি ধান ছাড়া অন্য ১০৩টি ফসলের উন্নত জাত উদ্ভাবন, মৌলবীজ উৎপাদন, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও হস্তান্তর করেছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি তিন শতাধিক কৃষিপ্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছে।

আমাদের দেশে কৃষকের জ্ঞানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না বলেই অনেক সম্ভাবনা মাঠে মারা যায়। কোনো সূত্র বা পরীক্ষার সুযোগ ছাড়াই যুগের তালে এই কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলা কৃষক। আমরা জানি ঝিনাইদহের সাধারণ কৃষক হরিপদ কাপালির অবিস্মরণীয় ধান আবিষ্কার দেশজুড়ে সুনাম কুড়িয়েছে। এজন্য হরিপদ কাপালি পেয়েছেন চ্যানেল আই কৃষিপদক। আরো বলা যেতে পারে রাজশাহীর নাটোরের খোলাবাড়িয়ার ভেষজ কৃষক আফাজ পাগলার কথা। বাড়ির পাশে ঘৃতকুমারীর গাছ রোপণ করে বদলে দিয়েছেন তার গ্রামের নাম ঔষধি গ্রাম। জানা গেছে দেশে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ঔষধি কাঁচামালের স্থানীয় বাজার, যার অধিকাংশই আসে গ্রাম থেকে।

কৃষিবিদদের মতে, দেশে আবাদযোগ্য পতিত জমিসহ উপকূল ও হাওর অঞ্চলের জলাবদ্ধ এক ফসলি জমিকে দুই বা তিন ফসলি জমিতে পরিণত করতে পারলে বছরে ৫০ লাখ টন বাড়তি খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব। মতানুযায়ী, দেশের বিস্তীর্ণ জলাবদ্ধ এলাকা চাষের আওতায় আনার পাশাপাশি জলবায়ু সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করা গেলে বছরে আরো পাঁচ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হবে। কৃষিবিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, প্লটের মতো দেশের ৮২ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে ধান, গমসহ অন্যান্য শস্যের উৎপাদন বাড়াতে পারলে দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে চাষযোগ্য পতিত ৩ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর এবং চলতি পতিত ৪ লাখ ৭ হেক্টর জমি চাষের আওতায় আসছে না। কৃষি বিভাগের গবেষণায় বলা হয়, শুধু সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে এক ফসলি প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমিকে দুই বা তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরিত করা যাবে। এছাড়া অস্থায়ী অনাবাসীদের মালিকানাধীন বৃহত্তর সিলেট, নোয়াখালী, বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলে পতিত থাকা প্রায় ৭০ ভাগ জমির ৫০ শতাংশে বোরো, আউশ ও আমন ধানের চাষ করা যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, উৎপাদন বাড়ানো লক্ষ্যে পরিত্যক্ত ও পতিত প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমি ফসল চাষের আওতায় আনা হয়েছে। উপকূলীয় ১৪ জেলার আবাদযোগ্য ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৮১ হেক্টর চলতি পতিত জমি চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গবেষকদের ধারণা, কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ত ও সুষ্ঠু ব্যবহার করা সম্ভব হলে উৎপাদন ৩০ শতাংশ বাড়বে।

তবে আবিষ্কার-উদ্ভাবনের কথা বললে আমার দেশের কৃষকের কথাও বলতে হবে। কৃষিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন গ্রাম বাংলার কৃষক। কৃষকরা স্বভাবগতভাবে প্রাকৃতির উদ্ভাবক। তারা অসীম সৃজনীক্ষমতার অধিকারী। খাঁটি ও সাদা মনের মানুষ। কৃষকরাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক। কবি বলেছেন, সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা। কী বন্যা, কী খরা, কত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ধুয়ে মুছে নিয়ে গেছে স্বপ্ন মিশ্রিত ঘাম ঝরানো সোনার ফসল। তবু দমে যায়নি বাংলার কৃষক। কোনো বিপর্যয়ই তাদের দমাতে পারেনি। বন্যার পর দেখা যায় বন্যার জল সরতে না সরতেই নতুন ফসল বোনার জন্য আবারও মাঠে নামে কৃষক। খরার সময় খেতে পানি দেয় ঘাম ঝরানো পরিশ্রমে। ফসল রক্ষায় তারা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে মসজিদে, মন্দিরে। নিঃস্ব, শূন্য অবস্থান থেকেও বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলার কৃষক। ফলিয়েছে সোনার ফসল। হাড়ভাঙা পরিশ্রমে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম নেই। এক মণ ধান বেচে একটি ইলিশ খাওয়ার সাধ্য নেই। তবু তারা অভিযোগহীন। নিজেদের অভাব, অনটন, দুর্গতি ভুলে তারা নতুন করে কাজে নামেন। তাই অকৃত্রিম ভালোবাসা আর দেশপ্রেমে কৃষকের জুড়ি নেই। তারপরও কৃষকের মূল্যায়ন হয় না। এই কৃষকরাই রক্ষা করছে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। বাংলার কৃষক তোমাদের লাল সালাম।

লেখক : সাংবাদিক ও কৃষি-অর্থনীতি বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close