ইমরান ইমন

  ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩

মুক্তমত

ঘটিবাটি নয়, উপহার হোক বই

সম্প্রতি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপহার হিসেবে প্লেট দেওয়ার চিত্র নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠেছে। নেটিজেনরা এ নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করছেন। লেখক, গবেষক ও দৈনিক ফেনী সম্পাদক আরিফ রিজভী আক্ষেপ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ওই ছবি পোস্ট দিয়ে লিখেন, ‘থালা-বাসন বন্ধ হবে কবে’। তার এ মন্তব্য যৌক্তিক।

শিক্ষার্থীদের উপহার হিসেবে প্লেট, মগ, বাটি, গ্লাস দেওয়ার সংস্কৃতি এদেশে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত। কিন্তু কালের বিবর্তনে সংস্কৃতির পালাবদল ঘটে, সময়ে সময়ে অনেক কিছুইর পরিবর্তন সাধিত হয়। কিন্তু আমরা আমাদের অকার্যকর সংস্কৃতিকে কতটুকু কার্যকর সংস্কৃতিতে রূপান্তর করতে পেরেছি- সে প্রশ্ন এখন আর না ওঠে পারে না। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে উপহার হিসেবে আমাদের মতো এ রকম ঘটিবাটির মতো ক্রোকারিজসামগ্রী দেওয়ার সংস্কৃতি পৃথিবীর আর কোথাও নেই। পৃথিবীর সব সভ্য ও উন্নত দেশে শিক্ষার্থীদের উপহার হিসেবে বই এবং শিক্ষা সহায়কসামগ্রী দেওয়া হয়। যাতে সেই শিক্ষার্থী এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়, তার শিক্ষাজীবনের কোনো না কোনো অংশে এটা কাজে লাগে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে এখনো শিক্ষার্থীদের উপহার হিসেবে ঘটিবাটির মতো ক্রোকারিজসামগ্রী দেওয়া হয়। অথচ শিক্ষার্থীদের উপহার হিসেবে প্লেট, গ্লাস, মগ, ঘটিবাটির মতো ক্রোকারিজসামগ্রী দেওয়া বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক অধিদপ্তর (মাউশি)। ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক অধিদপ্তর (মাউশি) কর্তৃক এ প্রজ্ঞাপন জারি হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের উপহার হিসেবে কোনো ধরনের ক্রোকারিজসামগ্রী দেওয়া যাবে না। এটি শিক্ষার্থীদের শিখন-শেখানো কার্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এর পরিবর্তে বয়স উপযোগী মানসম্মত বই অথবা শিক্ষা সহায়ক উপকরণ দিতে হবে।

উপহার হিসেবে ক্রোকারিজসামগ্রী দেওয়ার বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা থাকলেও এবং এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হলেও এখনো অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেটির তোয়াক্কা করছে না। এখনো দেখা যায়, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের উপহার হিসেবে ক্রোকারিজসামগ্রী দেয়- যেটি সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতেও দেখা যায় না। তাই সরকারি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেটি মানা হচ্ছে না।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উদাসীনতার প্রশ্নও না ওঠে পারে না। এমনিতেই বর্তমান প্রজন্মের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস হারাতে বসেছে। বর্তমান প্রজন্ম বই পড়া কী জিনিস সেটা এখন ভুলে গেছে। অথচ সমৃদ্ধ জাতি গঠনে বই পড়ার গুরুত্বপূর্ণ অনস্বীকার্য। বই পড়ার গুরুত্ব প্রসঙ্গে আমাদের জ্ঞানী-গুণিরা অনেক কথাই বলেছেন। দেকার্ত বলেছেন, ‘ভালো বই পড়া মানে গত শতাব্দীর মহৎ লোকের সঙ্গে আলাপ করা।’ অস্কার ওয়াইল্ড বলেছেন, ‘একজন মানুষ ভবিষ্যতে কী হবেন সেটি অন্য কিছু দিয়ে বোঝা না গেলেও তার পড়া বইয়ের ধরন দেখে তা অনেকাংশেই বোঝা যায়।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেওয়া সাঁকো।’ ওমর খৈয়াম বলেছেন, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে- বই, সে তো অনন্ত যৌবনা।’ মহামতি নেপোলিয়ন বই পড়ার গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল।’

জীবনের জন্য, জীবনের সফলতার জন্য এবং মানবসভ্যতার বিকাশের জন্য প্রয়োজন বই। বই পড়লে জীবনের পরতে পরতে এর প্রভাব লক্ষ করা যায়। বই পড়ার উপকারিতা তথা বই পড়লে আমাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হয়, সেগুলো হলো- বই পাঠকের মানসিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, অধ্যয়ন ডিমেন্সিয়া ও আলজেইমার নামের এই রোগ দুটিকে হ্রাস, এমনকি প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে। মস্তিষ্ককে সচল রাখলে তা কখনোই তার ক্ষমতা হারাবে না। মস্তিষ্ককে শরীরের একটি সাধারণ পেশি হিসেবে বিবেচনা করে বই পড়া চর্চার মাধ্যমে নিয়মিত ব্যায়াম করলে তা শক্তিশালী ও সজীব থাকে।

বই পড়লে মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয়। জনাথন সুইফট বলেছেন, ‘বই হচ্ছে মস্তিষ্কের সন্তান।’ গবেষকরা বলেন, বই পড়লে মস্তিষ্কের জটিল কোষগুলো উদ্দীপিত হয় এবং স্নায়ুগুলো উজ্জীবিত হতে থাকে। পড়ার সময় পাঠকের মস্তিষ্ক ভিন্ন জগতে বিচরণ করে এবং পঠিতব্য বিষয়ের প্রতি সে মনোনিবেশ করতে পারে। এভাবে বইয়ের মাধ্যমে মস্তিষ্কের নানাবিধ বিচরণের কারণে পাঠকের মানসিক চর্চা বৃদ্ধি পায়।

বই পড়লে শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয় এবং শব্দচয়ন ও বাক্য বিন্যাসের অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। যত বেশি বই পড়া হয়, তত বেশি শব্দভাণ্ডারে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ যোগ হতে থাকে। ফলে বই পড়া শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধিতে অনেক বেশি সাহায্য করে। নতুন কোনো ভাষা শিখতেও বই পড়ার বিকল্প নেই। এটি খুব দ্রুত নতুন যেকোনো ভাষাকে আয়ত্ত করতে সহায়তা করে। বই পড়ার মাধ্যমে অনেক অজানা শব্দ আয়ত্ত করা যায়, যা পাঠকের প্রাত্যহিক কথোপকথনে কাজে লাগে।

বর্তমানে যে একটা সৃজনশীলতাবিমুখ, মেরুদণ্ডহীন প্রজন্ম গড়ে উঠছে সেদিকে কারো নজর নেই। প্রজন্ম নিয়ে, প্রজন্মের এমন দৈন্যদশা নিয়ে যেন ভাবার কেউ নেই! অথচ তরুণ প্রজন্ম হলো একটা দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ। তরুণ প্রজন্মের বেড়ে ওঠা, পরিচর্যার ওপর নির্ভর করে একটা দেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপহার হিসেবে প্লেট, গ্লাস, মগ, ঘটিবাটির মতো ক্রোকারিজসামগ্রী দেওয়ার সংস্কৃতি চিরতরে বন্ধ হোক। আর বই হোক উপহারের উপকরণ। কেবল বই দিয়েই প্রজন্মের মাঝে একটি বড় বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়া সম্ভব।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close