সৈয়দ মো. জাহেদুল ইসলাম

  ২৬ জানুয়ারি, ২০২৩

পর্যালোচনা

বহুমাত্রিক সামরিক উত্তেজনায় ইরানের উত্থান

ড্রোন ও ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে মধ্য এশিয়ার দেশ ইরান এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। যুক্তরাষ্ট্রের বারবার আরোপিত নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি দিয়ে সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করে চলেছে পারস্য উপসাগরীয় এ দেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ঠিক এ মুহূর্তে ইরানকে নিয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর অন্যতম কারণ হিসেবে রাশিয়াকে ইরানের প্রদত্ত সামরিক সহায়তার কথা উল্লেখ করা হয়। সম্প্রতি ইউক্রেনে ভূপাতিত হওয়া রাশিয়ান ড্রোন পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় এর সিংহভাগ যন্ত্রাংশ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তৈরি। মার্কিন প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রাংশ দ্বারা নির্মিত ইরানি ড্রোন দিয়ে ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। এই চতুর্মুখী উত্তেজনার মাঝে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে ইরান। শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ গতিসম্পন্ন হাইপারসনিক ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে এরই মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করছে তেহরান। সেই সঙ্গে মস্কো এবং বেইজিংয়ের সঙ্গে এর সখ্যা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ওয়াশিংটন ও কিয়েভের জন্য। একদিকে দেখা যায়, ইউক্রেনকে রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র। আবার সেই মার্কিন যন্ত্রাংশে নির্মিত ইরানি ড্রোনে মস্কোর হামলার শিকার হচ্ছে কিয়েভ। এ ক্ষেত্রে চরম দুশ্চিন্তা ও উদ্বিগ্নতা দেখা দিয়েছে ওয়াশিংটনেও।

এ অবস্থায় ইউক্রেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোটের (ন্যাটো) চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তেহরান। ইউরেশিয়ান সেন্টার ও হরমোজ প্রণালির নিকটবর্তী হওয়ায় ভূ-কৌশলগতভাবে শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে ইরান। রাষ্ট্রীয়ভাবে এর নাম ইসলামি প্রজাতন্ত্রী ইরান, যা এককেন্দ্রিক খোমেনিবাদী রাষ্ট্রপতিশাসিত একটি দেশ। ইরানের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসি এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনি। পশ্চিম এশিয়ার এই দেশটি খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ। এর বৃহৎ সীমান্তজুড়ে রয়েছে কাস্পিয়ান সাগর, পারস্য ও ওমান উপসাগর। সেই সঙ্গে সীমান্তবর্তী দেশগুলো হলো আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইরাক। সামরিক শক্তিসম্পন্ন সীমান্তবর্তী একাধিক রাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন শক্তির প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার জন্য রাইসি প্রশাসন অবিরত কাজ করে চলেছে। প্রথাগত সেনাবাহিনীর পাশাপাশি দক্ষতাসম্পন্ন বৈপ্লবিক সুরক্ষা বাহিনীও রয়েছে ইরানের। তিনদিকে বিস্তৃত পাহাড়, একদিকে সুবিশাল সমুদ্র এবং ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তির কারণে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে ইরানে হামলা চালানো প্রায় অসম্ভবই বলা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ কর্তৃক সাম্প্রতিক প্রকাশিত তথ্য মতে স্বল্প ও মাঝারি পাল্লায় আক্রমণে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। গণমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী কয়েক বছর ধরে তেহরান অবিরত ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরানি শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো সাহাব ১, সাহাব ২, সাহাব ৩, কিয়াম ১, ফাতেহ ১ ও জুলফাগার। গণমাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এসব ক্ষেপণাস্ত্র ৩০০ থেকে ২০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রম করে যেকোনো লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ চালাতে পারে। এই ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি দিয়ে ইরান সীমান্তবর্তী তুরস্কের পাশাপাশি চীন, রাশিয়া কিংবা ভারতেও আঘাত করতে পারবে বলে মনে করা হয়। শুধু আক্রমণে শক্তি অর্জনই নয়, পাশাপাশি প্রতিরোধেও তীব্র সক্ষমতা ধারণ করেছে তেহরান। ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা আস্তিয়ানি বলেন, ‘বভার ৩৭৩ ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নত সংস্করণ ৩০০ কিলোমিটার দূরের ছয়টি লক্ষ্যবস্তুতে একসঙ্গে আঘাত হানতে পারবে। সেই সঙ্গে বোমারু বিমান ধ্বংস কিংবা পঞ্চম প্রজন্মের জঙ্গি বিমানেও হামলা চালাতে পারবে এই ক্ষেপণাস্ত্র।’

ইরানের এই সক্ষমতা অর্জন ক্রমাগত দুশ্চিন্তায় ফেলছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের। গণমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সম্প্রতি রাশিয়ার হামলার পর ইউক্রেনে ভূপাতিত হওয়া ইরানের তৈরি ড্রোন শাহেদণ্ড১৩৬-এর ৫২টি যন্ত্রাংশের ৪০টি উপাদান তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। অন্যান্য যন্ত্রাংশও তৈরি করা হয় সামরিক শক্তিসম্পন্ন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোতে। স্বয়ং হোয়াইট হাউস এ বিষয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছে। কনফ্লিক্ট আরমান্যান্ট রিসার্চের ডেপুটি ডিরেক্টর অব অপারেশনের মতে, ইউক্রেনে রাশিয়ার ব্যবহৃত ইরানি ড্রোনের ৮০ শতাংশের বেশি উপাদান তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোতে। ইউক্রেনে বারবার ইরানি ড্রোন ব্যবহার করে রাশিয়ার হামলার পরও তা প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্র তার তৈরি প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র প্যাট্রিয়ট এবং গ্রে-ইগল ড্রোন সরবরাহ করতে গড়িমসি করছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্যাট্রিয়ট কিংবা গ্রে-ইগলের ব্যবস্থাপনা অনেক ব্যয়বহুল বলে যুক্তরাষ্ট্র তা প্রদানে বিলম্ব করছে। সিএসআইএসের তথ্য মতে, গ্রে-ইগল ২৯ হাজার ফুট উঁচুতে একটানা ২৫ ঘণ্টা পর্যন্ত উড়তে পারে। সেই সঙ্গে আলো-আঁধার উভয় অবস্থায় লক্ষ্যবস্তুকে শনাক্ত করার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে মার্কিন এই ড্রোনের। সরাসরি মার্কিন সহায়তায় ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করা গেলেও তা আদৌ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রও মনে করে, ইউক্রেনকে এই ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা ড্রোন সহায়তা প্রদান করলে তা ওয়াশিংটন-মস্কো সংঘাতে রূপ নেবে। পাশাপাশি মার্কিন এই ড্রোন কোনোভাবে রাশিয়ায় ভূপাতিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি সহজেই মস্কো প্রশাসনের হস্তগত হবে বলে মনে করা হয়।

তবে প্যাট্রিয়ট ব্যাটারি সিস্টেম নিয়ে সিএসআইএসের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের নিরাপত্তা দেওয়া গেলেও সমগ্র ইউক্রেনকে নিরাপদ করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে এই সামরিক সহায়তা প্রদান করলে রাশিয়াও ছাড় দেবে বলে মনে হয় না। সিএসআইএস, সিএনএন, আইআইএসএসের মতো সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রাশিয়া আন্তমহাদেশীয় ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভিলের উন্মোচন করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মিনিটম্যান যুদ্ধবিমান থেকেও শক্তিশালী। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র?্যাটেজিক স্টাডিজের তথ্যানুযায়ী, মার্কিন এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে নেদারল্যান্ডস, জাপান, জার্মানি, ইসরায়েল, সৌদি আরব, কুয়েত, তাইওয়ান, গ্রিস, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, রোমানিয়া, সুইডেন, পোল্যান্ড এবং বাহরাইনে। এসব দেশের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের সামরিক নিরাপত্তার জন্যই প্যাট্রিয়টের ব্যবহার করা হয়। মার্কিন এই প্যাট্রিয়ট সিস্টেমের অপারেশনে ৯০ জন্য দক্ষ সেনার প্রয়োজন হয়। তাই ইউক্রেনকে শুধু প্যাট্রিয়ট সরবরাহ করলেই হবে না, সরাসরি সে দেশের সেনাবাহিনীকেও এর ব্যবহারবিধি নিয়ে পূর্ণ প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের।

মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এরই মধ্যে ব্যাপক সামরিক সহায়তা প্রদান করতে হয়েছে। একদিকে অনুগত রাষ্ট্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং অন্যদিকে নিজেদের বহিঃশক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এখনই হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্বশক্তি হওয়ার দৌড়ে চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়ার পথ আগলে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা মার্কিনিদের জন্য দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। পাশাপাশি আন্তমহাদেশীয় নতুন শক্তির উত্থানের ফলে এই অবস্থার ক্রমাবনতি হচ্ছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন রুখে দেওয়া, তাইওয়ানে চীনের সম্ভাব্য আক্রমণ রোধ করা, মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের একাধিপত্য ধরে রাখতে ওয়াশিংটন প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। বিগত বছরে আফগানিস্তানে মার্কিনিদের দীর্ঘ দুই দশকের দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়েছে তালিবান। বিভিন্ন রাজনীতি বিশ্লেষক এবং অর্থনীতিবিদদের মতে, একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলো থেকেও মার্কিন এই আধিপত্যের নিঃশেষ হতে পারে। এমনটা হলে বিশ্বরাজনীতিতে নতুন মেরূকরণ হতে আর বেশি সময় লাগবে না। পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিশ্বশক্তি হওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা এরই মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের ছোট দেশগুলোও থেমে নেয় নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও স্বকীয়তা রক্ষার দৌড়ে। বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত চতুর্মুখী উত্তেজনার সৃষ্টি করে চলেছে, যেখানে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। তথাপি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বকীয়তার রক্ষায় কিছু রাষ্ট্র বৃহৎ শক্তির অনধিকার প্রবেশের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এভাবেই সব সহিংসতা ও দখলদারিত্বের অবসান হোক। সংশয়, দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের ঊর্ধ্বে গিয়ে পৃথিবীটা মানুষের হোক।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close