মুহাম্মদ ফয়সাল করিম

  ০২ অক্টোবর, ২০২২

অভিমত

সাংস্কৃতিক বিবর্তনে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ

বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষ তাদের দৈহিক বৃত্তি পূরণের পাশাপাশি যখন থেকে মানসিক বৃত্তির দিকে দৃষ্টিপাত করেছে তখন থেকেই ‘বিনোদন’ শব্দটি তাদের জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে বিষয়গুলো মানুষকে রোবোটিক জীবনযাপন থেকে পৃথক রেখেছে তাদের মধ্যে বিনোদন অন্যতম। মানুষের প্রয়োজনেই মানুষ বিনোদনের বিভিন্ন উপায়, মাধ্যম উদ্ভাবন করেছে। বিনোদনের উপায়গুলো দেশ, কাল, জাতি, ধর্ম, বয়স ও লিঙ্গভেদে ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য একই। একসময় অঞ্চলভিত্তিক বিনোদনের যে ব্যবস্থাগুলো ছিল তারই আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে বর্তমানের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলো।

বিনোদন শুধু নিছক বিনোদন নয় বরং এর সঙ্গে যুক্ত হয় কিছু গুণগত দিক। তাদের মধ্যে নৈতিক ও শিক্ষামূলক দিক যেমন রয়েছে তেমনি ক্ষেত্রবিশেষে যুক্তি হয় অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটও। আবার বিনোদনের সঙ্গে কোনো দেশের সংস্কৃতির এনালজিক্যাল সম্পর্ক রয়েছে। কোনো দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির একটি বড় নিয়ামক হলো সেই দেশের বিনোদনের পদ্ধতিগুলো, যা ওই দেশের জনগণের রুচিবোধেরও প্রকাশক। চিত্তবিনোদনের পাশাপাশি জাতীয় মূল্যবোধ গঠনেও যে সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা বলাই বাহুল্য। মূল্যবোধের বিচারে গ্রহণযোগ্য উপাদানের ভিত্তিতে যে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে তাকে যেমন সংস্কৃতির ইতিবাচক ধারা বলা যায় ঠিক তেমনি বর্জনীয় উপাদানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে অপসংস্কৃতি।

সাধারণত দেশভেদে সংস্কৃতির একটি স্বতন্ত্র রূপ থাকলেও ক্ষেত্রবিশেষে এক দেশের সংস্কৃতি অন্য দেশের সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এক্ষেত্রে যদি বাংলাদেশের কথা বলা হয় তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায় ভারতীয় সংস্কৃতি বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর উল্লেখযোগ্য মাত্রায় প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ভারতীয় চলচ্চিত্র, সংগীত এমনকি ধারাবাহিক নাটকগুলো বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়, তা যে ভাষায়ই নির্মিত হোক না কেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে কিছু অপসংস্কৃতিও আমাদের দেশে অনুপ্রবেশ করেছে, যার নানাবিধ ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে অশ্লীলতার অবাধ প্রসার যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বৃদ্ধিও। এ ধরনের কিছু অনুষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কলকাতাভিত্তিক টিভি চ্যানেল ‘সনি আট’-এ নিয়মিত সম্প্রচারিত সিরিজ ‘ক্রাইম পেট্রোল’। উল্লেখ্য যে, কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এই সিরিজটি ‘সামাজিক সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান’ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে এর নেতিবাচক প্রভাবই বরং বেশি।

সাম্প্রতিক নোয়াখালীর মাইজদীতে নির্মম পরিণতির শিকার তাসমিয়া হোসেন অদিতা তার ‘সর্বশেষ’ দৃষ্টান্ত। যিনি তার নিজের বাসায়ই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। হত্যার দায় স্বীকার করে পুলিশের কাছে জবানবন্দি দেওয়া আবদুর রহিম স্বীকার করেছেন তিনি ক্রাইম পেট্রোল দেখে শিখেছেন। উপরোল্লিখিত ‘সর্বশেষ’ শব্দটি লেখার কারণ হলো ক্রাইম পেট্রোল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ঘটানো এটিই একমাত্র ঘটনা নয়, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে পিরোজপুরে ১৩ বছর বয়সি এক কিশোরকে অপহরণের পর হত্যা, চট্টগ্রামে টাকা না পেয়ে ভাবিকে হত্যা, একই জেলায় মা-ছেলেকে হত্যা, কেরানীগঞ্জ এবং সাভারে দুই রিকশাচালককে হত্যাসহ বহু চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের পর আসামিরা জবানবন্দিতে ক্রাইম পেট্রোল দেখে শেখার কথা বলেছেন। শুধু হত্যাকাণ্ড নয়, ক্রাইম পেট্রোল দেখে চুরি, অপহরণ, নিপীড়নসহ অনেক অপরাধ ঘটানোর নজির রয়েছে যা বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে বারবার ওঠে এসেছে।

এখন প্রশ্ন আসাটা অস্বাভাবিক নয় যে সামাজিক সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান দাবি করা এই সিরিজের সঙ্গে অপরাধের যোগসূত্র কী। এর কারণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জনসাধারণকে সতর্ক করতে গিয়ে এই সিরিজ নির্মাতারা এমন সব নেতিবাচক কৌশল প্রচার করছেন যা সাধারণত জনসাধারণের কাছে অজানাই থাকে। এই অপকৌশলগুলো শিখে তা বাস্তবে প্রয়োগ করে সমাজে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে এক শ্রেণির দুর্বৃত্তরা। এছাড়াও ভারতীয় চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ঘটানো অপরাধের অহরহ নজির রয়েছে। এটি সত্য যে, আমাদের দেশে যত অপরাধ সংঘটিত হয় তার একমাত্র কারণ ভারতীয় এসব অনুষ্ঠানগুলো নয়, কিন্তু এই ডিজিটাল যুগে বর্তমানে ঘটমান অপরাধগুলোর একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে এসব অনুষ্ঠানগুলো।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিও এখন কলুষিত হওয়ার পথে। কিছু অসাধু পরিচালক তাদের চলচ্চিত্র এবং নাটকে এমন সব অশালীন দৃশ্য বা নোংরা সংলাপ প্রচার করছে যা যেকোনো সভ্য সমাজে নিন্দার সৃষ্টি করবে। এর মাধ্যমে তারা সমাজে চরম নৈতিক অবক্ষয় ঘটাচ্ছেন, যাদের মূল লক্ষ্যবস্তুই হলো এই দেশের তরুণ প্রজন্ম। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের একটি বহুল আলোচিত-সমালোচিত ধারাবাহিক নাটক ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’। যাতে কুৎসিত ইঙ্গিতপূর্ণ এবং নোংরা সংলাপের সয়লাব ঘটানো হয়েছে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে বর্তমানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এই ধারাবাহিকের নিয়মিত দর্শক। নাটকে প্রচারিত নোংরা সংলাপগুলো স্থান-কাল ভুলে অবাধে ব্যবহার করে তারা জানান দিচ্ছেন তাদের কতটা নৈতিক অবনমন ঘটেছে। এ ধরনের আরো অনেক অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে যা শুধু অশ্লীলতারই প্রসার ঘটাচ্ছে তা নয় বরং নিঃশেষ করে দিচ্ছে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ।

অপসংস্কৃতির এই ভয়াল থাবা থেকে বাঁচার একটি পথ হতে পারে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ। অপসংস্কৃতিকে রুখতে প্রয়োজন সুস্থ ধারার সংস্কৃতির বিকাশ, প্রয়োজন সচেতনতারও। দেশকে এই সাংস্কৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষায় বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের এগিয়ে আসা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি নৈতিক, শিক্ষামূলক গুণাবলিবিহীন বিনোদনের উপাদানগুলো বর্জন করা। তা ছাড়া নেতিবাচক বিষয়বস্তু সংবলিত অনুষ্ঠানগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা থেকে বিরত থাকাও এখন আমাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি নৈতিক, সামাজিক অবক্ষয় ঘটানো কুশীলবদের বর্জনে একতাবদ্ধ হতে পারলেই দূর হবে সাংস্কৃতিক দৌরাত্ম্য। পরিশেষে সংস্কৃতি হোক সুন্দর, বিনোদন হোক নির্মল।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close