নূর আহমাদ

  ০৫ আগস্ট, ২০২২

দৃষ্টিপাত

হিজরি নববর্ষের শোকগাথা

দিন যায়, রাত আসে। এভাবেই মাস পেরিয়ে বছর ঘুরে। নীল আসমানে মহররমের চাঁদ। চাঁদের মুখটা মলিন। বাতাসে শোকের আর্তনাদ। মহররম এলেই সে আর্তনাদ ধ্বনিত হয় করুণ সুরে। কারবালার নির্মমতা বিচ্ছেদের গান হয়ে কাঁদিয়ে যায় আহলেবাইত প্রেমিকদের। তেমনই একজন আহলেবাইত প্রেমিক ছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মহররম এলেই সেই সুর বেজে উঠত তার হৃদয়ে। নিজে কাঁদতেন, কাঁদতে বলতেন আর সবাইকে। তিনি লিখেছেন, ‘ওরে বাঙলার মুসলিম, তোরা কাঁদ/এনেছে এজিদী বিদ্বেষ পুনঃমহররমের চাঁদ।’

দিনটি ছিল ৮ জিলহজ। হজের দিন। দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে মুসলমানরা মক্কায় এসেছে লাব্বাইকের গানে গানে। আর ইমাম হোসাইন রওনা করেছেন কুফায় এজিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে।

আল বিদায়া গ্রন্থে ঐতিহাসিক ইবনে কাসির লিখেছেন, যখন হোসাইনের (রা.) কাটা মাথা এজিদের সামনে আনা হলো, তখন এজিদ হাতের লাঠি দিয়ে ইমামের মাথা মোবারক খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখছিলেন। একবার ডানে খোঁচা দেয়। আরেকবার বামে। এরপর ঠোঁটের কাছে লাঠি নিয়ে আসলেন। লাঠি দিয়ে ঠোঁট দুটি ফাঁক করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ইমামের নুরানি দাঁতগুলো ঝলক দিয়ে উঠল। পাপিষ্ঠ এজিদ ইমামের দাঁতে মুখে এমনভাবে খোঁচাতে লাগলেন যে, আহলেবাইত প্রেমিকরা সহ্য করতে পারলেন না। দরবারে থাকা আবু বোরজা (রা.) জীবনের মায়া ত্যাগ করে সাহসের সঙ্গে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ওহে বদখত এজিদ! তুই কোন ঠোঁটে আঘাত করছিস! আমি অসংখ্যবার দেখেছি এই ঠোঁটে আল্লাহর রাসুল (সা.) চুমু খেতেন আর বলতেন, আমার আদরের কলিজা টুকরো নাতি! তোমরা দুজন বেহেশতি যুবকদের সর্দার। তোমাদের যারা হত্যা করেছো এবং উপহাস করছো, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে জাহান্নামের নিকৃষ্ট আবাস।’

আবু বোরজা আরো বলেছেন, ‘নাপাক এজিদ! ভেবে দেখো, কেয়ামতের দিন তোর পাশে থাকবে পাপিষ্ঠ ইবনে জিয়াদ, আর হোসাইনের পাশে থাকবে তার নানা নবীয়ে কায়েনাত (সা.)। সেদিন তুই কীভাবে নবিজীকে মুখ দেখাবি।’

শিয়া ঐতিহাসিক ইবনে তাউস লিখেন, ‘এমন সাহসী উচ্চারণ শোনার সঙ্গে সঙ্গে এজিদ রাগে লাল হয়ে যায়। এজিদ বলে, এই বুড়োকে এখনই আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও, নয়তো এর গর্দান উড়িয়ে দেব। সঙ্গে সঙ্গে তাকে টেনেহিঁচড়ে এজিদের দরবার থেকে নিয়ে যাওয়া হলো।’

ইবনে আসাকের লিখেছেন, ইমামের মাথা খোঁচাতে খোঁচাতে এজিদ কবিতা আবৃত্তি করছিলেন। কবিতার সারমর্ম ছিল এ রকম- ‘হে হুসাইন! তোমার নানা মুহাম্মাদ (সা.) বদরে আমার পূর্বপুরুষ উৎবাকে হত্যা করেছে। আজ আমি ফোরাতে তোমাকে হত্যা করে তার প্রতিশোধ নিলাম।’ ইবনে হাজার মাক্কি (রহ.) বলেন, এরপর এজিদ এমন কথা বলেছেন যা সুস্পষ্ট কুফুরি। এজিদ বলেছেন, ‘তোমার নানা আরবদের নিয়ে অনেক খেলেছেন। অথচ তার কাছে কোনো বাণী আসেনি, কোনো ওহিও আসেনি। হোসাইনকে হত্যা করে প্রমাণ করেছি, আমি উৎবার যোগ্য উত্তরসূরি।’

ইবনে হাজার মাক্কি শাফেয়ি (রহ.) আরো লেখেন, ‘এজিদ যখন ইমাম হুসাইনের কাটা শিরে লাঠি দিয়ে আঘত করছিল, তখন সেখানে রোম সম্রাটের একজন দূত বসা ছিল। তিনি বিস্ময়ভরা চোখে এজিদের বেয়াদবি দেখছিলেন। একপর্যায়ে দূত বলল, ‘এজিদ! তোমার আচরণ দেখে খুব অবাক হলাম। আমাদের দেশে এক নির্জন দ্বীপে একটি গির্জা আছে। সেখানে সচরাচর কেউ যায় না। তবে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় আমরা সেখানে যাই। নজরানা দিই। ইবাদতে মগ্ন হই। এত কষ্ট করি কেন জান? ওই গির্জায় ঈসা নবীর গাধার খুর রক্ষিত আছে। নবীকে বহন করা গাধার খুর আমাদের কাছে এত মর্যাদার! আর তোমাদের নবীর নাতিকে তোমরা হত্যা করে তার কাটা মাথা নিয়ে এভাবে আনন্দে মেতে উঠছ! হায়, তোমরা কেমন দুর্ভাগা মুসলমান?’

সাওয়ায়েকে মুহরিকা গ্রন্থে এসেছে, রোম দূতের কথা শেষ হলে উপস্থিত একজন ইহুদি বলে উঠল, আমি হজরত দাউদ নবীর ৭০তম বংশধর। ইহুদিরা আজও আমাকে সীমাহীন সম্মান ও আদর-যত্ন করে। আর তোমরা খোদ নবীর নাতিকে এমন নির্মমভাবে হত্যা করে ফেললে? ছি, কী অপদার্থ উম্মতই না তোমরা।’

ইমামের শিরের সঙ্গে আসা বন্দি আহলে বাইতের নারী সদস্যদের সঙ্গে সীমাহীন বেদয়াবি ও উপহাস শেষে এজিদ ঘোষণা করল, ‘হে সভাসদরা! হোসাইন ছিল বিদ্রোহী। সে আমিরুল মোমিনিন এজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। আল্লাহ বিদ্রোহীকে পরাজিত করেছেন, সত্যপন্থি এজিদকে বিজয় দিয়েছেন। ভবিষ্যতে যেই এজিদের হুকুমতের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইবে তার জন্য আজকের ঘটনা একটি হুশিয়ারি। যাও! হোসাইনের কাটা শির রাজ্যের অলিগলিতে প্রদর্শন করো। যেন এজিদ বিরোধীদের অন্তরে কাঁপন ধরে যায়।’ নির্দেশ পেয়েই কুখ্যাত নবীর দুশমনরা বর্শার মাথায় নবী দুলালের নুরানি শির গেঁথে দামেশকের অলিগলি-মাঠ-ঘাটে ঘোরাতে লাগল। এ দৃশ্য দেখে আহলেবাইত প্রেমিকরা নীরবে চোখের পানি ঝরালেন। সুন্নি ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, এজিদের সৈন্যরা তিন দিন পর্যন্ত ইমামের কাটা শির শহরে-গঞ্জে প্রদর্শন করে বেড়ায়।

হাফেজ আবুল খাত্তাব ইবনে ওয়াজিহ (রহ.) বলেন, ইমাম হোসাইনের কাটা শির শহর-গঞ্জে ঘোরানোর ঘটনা দেখার পর প্রখ্যাত তাবেয়ি খালেদ বিন গাফরা (রহ.) এক মাস লোকালয় থেকে আত্মগোপানে চলে যান। পরবর্তীতে তার নির্জনবাসের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আফসোস! তোমরা দেখছো না কী বীভৎস সময় পার করছি আমরা! পাপিষ্ঠ এজিদ ইমাম হোসাইনকে হত্যা করে আসলে রাসুলকেই (সা.) হত্যা করেছে। কোরআন রুহানিয়াত এবং ইসলামের প্রাণ মুছে ফেলেছে।’

হে ভিরু-লোভী মুসলমান! ইমাম হোসাইনের প্রতিবাদী আদর্শ ভুলে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছ তুমি, কেয়ামতের দিন কোন মুখে নবীর সামনে দাঁড়াবে!

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close