অলোক আচার্য

  ২৯ জুন, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

ঈদুল আজহায় মোটরবাইক দুর্ঘটনা

দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জাতীয় মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। গত ১৯ জুন রাজধানীতে বিআরটিএর কার্যালয়ে এক কর্মশালায় এ সুপারিশ করা হয়েছে। গত ঈদুল ফিতরের দুর্ঘটনার স্মৃতি এখনো মনে আছে। গত ঈদুল ফিতরের সময় সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেশি হওয়ায় মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধের সুপারিশ করা হয়। বিআরটিএর প্রদত্ত তথ্যে জানা যায়, ২০২১ সালের ঈদুল ফিতরের মহাসড়কে ৫৬ সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৭ জন নিহত হয়েছেন। গত ঈদুল ফিতরের আট দিনে ১০৬ সড়ক দুর্ঘটনায় ১০৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিন ১৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে।

কর্মশালায় আরো বলা হয়, যেসব জাতীয় মহাসড়কের পাশে সার্ভিস রোড রয়েছে, সেসব মহাসড়কের সার্ভিস রোডে মোটরসাইকেল চলতে দেওয়া যেতে পারে। শখের বশেই সাধারণত মোটরসাইকেল কেনা হয়। কয়েক বছর আগেও কিন্তু দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা নিয়ে এ শোরগোল ছিল না। কারণ এত বেশি মোটরসাইকেল কোথাও দেখাও যেত না। শহরের রাস্তায় দেখা পাওয়া যেত। অথচ আজ দৃশ্যপট ভিন্ন। প্রায় সব শ্রেণির এবং বয়সিদের হাতেই মোটরসাইকেল রয়েছে, এটা ছাড়া এক মুহূর্তই চলে না।

মোটরসাইকেল যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হয়ে দেখা দিয়েছে। এর কারণ হলো প্রয়োজনের চেয়ে হিরোইজম। যার কারণে অভিভাবক অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও নিজের অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের হাতে মোটরসাইকেল তুলে দেন। আবার অনেকে নিজের ইচ্ছাতেই মোটরসাইকেল কিনে দেন। প্রয়োজনে মোটরসাইকেল যে কেউ কিনছেন না তা নয়। তবে প্রয়োজনের চেয়ে শখেই বেশি। আবার সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় অংশেই এই মোটরসাইকেল রয়েছে। চোখের সামনে এ রকম অনেক শিশু-কিশোরকে অকালে প্রাণ দিতে দেখেছি আবার দেখেছি পঙ্গু হয়ে বাড়িতে থাকতে। তার পরও কিন্তু থামছে কিশোর হাতের এই অনিরাপদ ড্রাইভিং। রাস্তায় অনেক কিশোর যে ভঙ্গিতে মোটরসাইকেল চালায় তা দেখে নিজের শরীরেই শিহরণ জাগে! এত দ্রুতগামী আর এঁকেবেঁকে যায় যে তা চালকের জন্য এবং পথচারীর জন্যও বিপজ্জনক।

ঈদুল ফিতরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বহু প্রাণ ঝরে গেছে। রোড সেফটি ফাইন্ডেশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত এপ্রিল মাসেই দেশজুড়ে ৪২৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫৪৩ জন নিহত হয়েছেন এবং ৬১২ জন আহত হয়েছেন। আরেকটি বিষয় হলো এর মধ্যে ১৮৯টি বাইক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২০৬ জন। এপ্রিল মাসে গড়ে নিহত হয়েছেন ১৮ জন। আর শুধু ঈদযাত্রায় এ বছর ২৬ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত ১৫ দিনে ৩৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৪১৬ জনের। এ তথ্য যাত্রীকল্যাণ সমিতির। সংগঠনটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় এবারের ঈদযাত্রায় সড়কে দুর্ঘটনা ১৪.৫১ শতাংশ বেড়েছে। নিহতের সংখ্যা বেড়েছে ২২.৩৫ শতাংশ। অনিরাপদ সড়কে প্রতিদিন মানুষ মরছে।

যানবাহন আমাদের জীবনে গতি এনেছে। আর একই সঙ্গে বাড়িয়ে দিয়েছে দুর্গতি। সড়কে রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই আর একটি সড়ক দুর্ঘটনার খবর আসছে। প্রতিটি যানবাহনেই এ দুর্ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে একটি অংশ হলো মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। সহজে বহন, পারিবারিক এবং ফ্যাশনে মোটরসাইকেল জনপ্রিয়। আবার একটু গণপরিবহনের স্বল্পতা, সময় ও অন্যান্য কারণে পরিবারে মোটরসাইকেল কিনছে অনেকে। অর্থাৎ প্রয়োজন এবং ফ্যাশন দুই কারণেই মোটরসাইকেল প্রয়োজন। তবে প্রতি বছর এই যানে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধিতে সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, এক তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান ৯৪৫ জন। পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৬৩ জন। আর ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান ২ হাজার ২১৪ জন, যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ৫০ শতাংশ।

চলতি বছরেও মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৮৩০ জন। কর্তৃপক্ষ মোটরসাইকেল চালাতে বিভিন্ন সতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়েছেন চালকদের। বিআরটিএ এর তথ্যে, বর্তমানে দেশে মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা ৩৬ লাখ ৫০ হাজার হলেও মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা ২৩ লাখ ৫০ হাজার। ভয়ংকর এই বাহনে বছরে সড়কে দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা। মোট দুর্ঘটনার ৪৪ ভাগের বেশি এখন মোটরসাইকেলে সংঘটিত হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে এ নিয়ে কড়াকড়ি রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের গ্রাম থেকে শহর, মহাসড়ক থেকে গলির রাস্তা সবখানেই মোটরসাইকেল নামক দ্বিচক্রযানের চিত্র। এই বাহনই ইদানীং সময় মৃত্যুর কারণ হচ্ছে বেশি। শিশু-কিশোরদের হাতে ব্যবহৃত হওয়া মোটরসাইকেল যে প্রয়োজনীয় নয় সে কথা বেশ বলা যায়। আবার যারা তরুণ বাইকার রয়েছেন তারাও অনেকেই সড়কের নিয়ম মানতে চান না। দ্রুত গতি, ওভারটেকিং ইত্যাদি কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। তা ছাড়া এসব চালক নিরাপত্তামূলক কোনো পোশাকও পরিধান করেন না। মাঝেমধ্যে হেলমেটও থাকে না মাথায়। ফলে দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। অভিভাবকদের আবেগের কারণেই তাদের হাতে দুই চাকার এই যান উঠছে। বয়সটা এমন যে গতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কথা নয়।

অভিভাবকরাও সন্তানের আবদার পূরণ করতে গিয়ে যেকোনোভাবেই মোটরসাইকেল কিনে দিচ্ছেন। প্রাইভেট পড়া থেকে শুরু করে বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে রেস- সবকিছুই চলে মোটরসাইকেলে। অলিগলিতে এসব মোটরসাইকেল বেপরোয়া গতিতে চালাতে দেখা যায়। অনেক সময় নিজেদেরই ভয় করে। সাইড দিতে হয়। অথচ এই গতিতে চালানোর জন্য উপযুক্ত রাস্তা এসব নয়। দ্রুত গতির সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ চালনা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পরিমাণ বৃদ্ধি করছে। যেমন : অনেক সময় সামনের চাকা উঁচু করে মোটরসাইকেল চালাতে দেখা যায়। বাজারেও আসছে একের পর এক মোটরসাইকেল। সেসব কেনার জন্য ঘুরছে এ প্রজন্মের ছেলেরা। কিন্তু যেভাবে চালানো দরকার সেভাবে না চালিয়ে খারাপভাবে করছে। ফ্যাশনেবল ছাড়াও বর্তমানে প্রয়োজনের তাগিদেই মোটরসাইকেলের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরে। রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে যেমন বহু বেকার যুবকের সাংসারিক ভরণপোষণের ব্যবস্থা হচ্ছে, তেমনি খুব দ্রুত নিজের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেল ব্যবহার করছে। সেই সংখ্যাও ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে তাদের মধ্যে বাড়ছে প্রতিযোগিতা। বাড়ছে দুর্ঘটনা।

বুয়েটের এআরআই ২০২০ সালে রাইড শেয়ারিংয়ের ৪৫০ মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীর ওপর একটি জরিপ করে। এতে উঠে আসে, ৫০ শতাংশ আরোহী চালকের চালানো নিয়ে অনিরাপত্তায় ভোগেন। অপ্রয়োজনে সন্তানকে এই যান কিনে না দিই। আর যারা নেহাত প্রয়োজনে ব্যবহার করছি তারা সাবধান হই। স্পিড আইন মেনে চলি। একটু মুহূর্তের আনন্দ সারা জীবন কান্নার কারণ হয়ে থাকবে। এ মৃত্যুর মিছিল থামাতে না পারলে তা আরো বহু প্রাণ কেড়ে নেবে এবং অসহায় জীবনও বেছে নিতে হতে পারে। একটি নিরাপদ সড়ক আমাদের সবার কাম্য।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close