আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ২৭ মে, ২০২২

দৃষ্টিপাত

রিমঝিম বৃষ্টি প্রভুর অপার সৃষ্টি

বেশ কদিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি রহমতের বার্তাবাহক। বান্দার প্রতি আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসার নিদর্শন। বৃষ্টির রূপালি ফোঁটায় ভর করে নেমে আসে রিজিক। উর্বর হয় শুকনো মাটি। ফসলের খেত হয়ে ওঠে সতেজ ও সবুজ। বৃষ্টির আগমনে নেচে ওঠে ময়ূরের দল। ফুলে ফুলে রঙিন হয় পৃথিবীর বুক। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘তুমি কি দেখ না, আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন; অতঃপর পৃথিবী সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে। নিশ্চয়ই তিনি সূক্ষ্মদর্শী; সব বিষয়ে জানেন।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৬৩)।

কখনো কখনো অতিবৃষ্টি আবার বিপাকের কারণ। আনাস (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ! তখন আকাশে বিন্দুমাত্র মেঘের ছোঁয়াও ছিল না। রাসুল (সা.)-এর দোয়ার পর দিগন্তে মেঘের সৃষ্টি হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো আকাশ ছেয়ে ফেলে, অতঃপর মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হয়। আনাস (রা.) আরো বলেন, আল্লাহর শপথ! পরবর্তী ছয় দিন যাবৎ আমরা সূর্য দেখিনি। সপ্তাহান্তে পরবর্তী জুমায় পুনরায় ওই ব্যক্তি যখন মসজিদে প্রবেশ করে, তখন রাসুল (সা.) খুতবারত অবস্থায়। ওই ব্যক্তি আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! ধনসম্পদ সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পানিতে পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে, আল্লাহ তায়ালার কাছে বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার প্রার্থনা করুন। তখন রাসুল (সা.) দুই হাত উঁচিয়ে দোয়া করলেন, আল্লাহুম্মা হাওয়া-লাইনা, ওয়ালা আলাইনা; আল্লাহুম্মা আলাল আ-কাম ওয়াজ জিরাব ওয়া বুতুনিল আওদিআ; ওয়া মানাবিতিস শাজার। (বোখারি শরিফ; হাদিস : ১০১৪)। অর্থ : হে আল্লাহ! আমাদের আশপাশে বৃষ্টি দিন, আমাদের ওপরে নয়, হে আল্লাহ! পাহাড়-টিলা, খাল-নালা এবং গাছ-উদ্ভিদ গজানোর স্থানগুলোতে বৃষ্টি দিন।

এজন্যই রাসুল (সা.) বৃষ্টির সময় এই দোয়া করতেন, আল্লাহুম্মা সাইয়্যিবান নাফিআহ। অর্থ : হে আল্লাহ তুমি এ বৃষ্টিকে প্রবহমান ও উপকারী করে দাও। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৫২৩)।

বৃষ্টি পরিবেশ আর মনোজগতকে একেবারে বদলে দেয়। তীব্র খরায়, গ্রীষ্মের দাবদাহে জমিন যখন ফেটে চৌচির হয়ে যায়, তখন এক পশলা রহমতের বৃষ্টিতে জগতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। প্রকৃতি হয়ে ওঠে সতেজ ও প্রাণবন্ত। বৃষ্টি যে আল্লাহ তায়ালার কী অপার নেয়ামত, তা বুঝে আসে যখন এক ফোঁটা বৃষ্টির অভাবে চারদিক খাঁ খাঁ করতে থাকে। ফসলে খরা লাগে, ছটফট করতে থাকে প্রাণিকুল। খরা বা অনাবৃষ্টি মূলত আমাদের পাপের কারণেই হয়ে থাকে। তাই অনাবৃষ্টি দেখা দিলে আমাদের খালেছভাবে তাওবাহ করা এবং বৃষ্টি চেয়ে দোয়া করা। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার জুমার দিন রাসুল (সা.) খুতবা দেওয়া অবস্থায় এক সাহাবি মসজিদে প্রবেশ করে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! জীবজন্তু মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। আল্লাহ তায়ালার কাছে আমাদের জন্য বৃষ্টি প্রার্থনা করুন।। তখন রাসুল (সা.) তার দুই হাত উঠিয়ে দোয়া করতে শুরু করেন, ‘আল্লাহুম্মাসক্বিনা, আল্লাহুম্মাসক্বিনা, আল্লাহুম্মাসক্বিনা।’ অর্থ : হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করো! হে আল্লাহ আমাদের বৃষ্টি দান করো! হে আল্লাহ আমাদের বৃষ্টি দান করো।

সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলায় সুশোভিত এই বসুন্ধরা বৃষ্টির স্পর্শেই হয়ে উঠেছে বাসযোগ্য। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহ) পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আকাশকে ছাদ করেছেন, এবং আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে তা দিয়ে তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উৎপাদন করেন। সুতরাং জেনে শুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করিও না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২২) ।

অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘তুমি কি দেখ না, আল্লাহ সঞ্চালিত করেন মেঘমালাকে, তৎপর তাকে পুঞ্জীভূত করেন, অতঃপর তাকে স্তরে স্তরে রাখেন, অতঃপর তুমি দেখ যে, তার মধ্য থেকে নির্গত হয় বারিধারা। তিনি আকাশস্থিত শিলাস্তূপ থেকে শিলাবর্ষণ করেন এবং তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা তা অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন। তার বিদ্যুৎ ঝলক দৃষ্টিশক্তিকে যে বিলীন করে দিতে চায়।’ (সুরা আন-নুর, আয়াত : ৪৩)।

বৃষ্টি এলে নবীজি খুবই খুশি হতেন। বৃষ্টিতে প্রফুল্ল হয়ে উঠত তার চিত্ত। তিনি নিজে বৃষ্টিতে ভিজতেন এবং অন্যদেরও রহমতের এই বৃষ্টিতে সিক্ত হতে বলতেন। রাসুল (সা.) বৃষ্টি সংক্রান্ত বেশ কিছু দোয়া ও শিষ্টাচার শিখিয়ে গেছেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা রাসুল (সা)-এর সাথে ছিলাম। সে সময় আমাদের বৃষ্টি পেয়েছিল। তখন রাসুল (সা.) তাঁর গায়ের পোশাক কিছুটা সরিয়ে নিলেন, যাতে তাঁর গায়ে বৃষ্টি পড়ে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম ‘আপনি এমনটি কেন করলেন?’ তিনি বললেন ‘যেহেতু বৃষ্টি তার রবের নিকট থেকে নবাগত।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৮৯৮)।

বৃষ্টির পানি মানবদেহের নানা রোগের শেফা। অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণা রিপোর্টে জানানো হয়, বৃষ্টির পানি পান করা সবচেয়ে নিরাপদ। মাটি বা পাথরে থাকা মিনারেলস আর বর্জ্য বৃষ্টির পানিতে থাকে না। সে কারণেই বৃষ্টির পানি পানে অগাধ উপকারিতা রয়েছে। হজম শক্তি বৃদ্ধিতে বৃষ্টির পানির তুলনা নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও প্রমাণিত যে, অ্যালকালাইন pH যা অ্যাসিডিটি কমায়। হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। বৃষ্টির পানিতে থাকা অ্যালকালাইন pH ক্যান্সার রোগীদের ক্ষেত্রে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের কাজ করে বৃষ্টির পানি। বৃষ্টির পানির কোষে জমে থাকা খারাপ ব্যাকটেরিয়াকে সাফ করে দেয়। ত্বকের জ্বালাও দূর হয়। তাই বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বৃষ্টি দেখে আর ঘরে বসে থাকা নয়। প্রাণ ভরে ভিজুন। বৃষ্টির পানি ধরুন। বৃষ্টির পানি পান করুন।

বৃষ্টির সময় আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। এ সময়ে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। বজ্রপাত পৃথিবীবাসীদের জন্য সতর্ক সংকেত। আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.) থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি বজ্রপাতের সময় কথা বন্ধ রাখতেন। আর বলতেন, ‘ওয়া ইউসবিহুর রা’দু বিহামদিহি, ওয়াল মালাইকাতু মিন খিয়ফাতিহি। (সুরা রাদ, আয়াত :১৩)।

এরপর বলেন, এটি দুনিয়াবাসীর জন্য চরম হুমকি। (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৭২৩)।

বৃষ্টি আসে নব সমারোহে, জয়বাদ্য বাজিয়ে। নীল নব অঙনে নবীন মেঘের সমারোহে। তাই বৃষ্টি এলেই কবিরা বসে যান বিরহের ঝাঁপি খুলে। প্রাচীনকাল থেকেই বৃষ্টি বন্দনা বাঙালি কবিকুলে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে আসছে। যেমনটা লক্ষ্য করা যায় এই কবিতায়- ‘এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা কেমনে আইলো বাটে/আঙ্গিনার মাঝে বঁধূয়া ভিজিছে দেখিয়ে পরাণ ফাঁটে।’ (চণ্ডিদাস)।

সাম্য ও প্রেমের কবি কাজী নজরুলের কবিতায় বৃষ্টি এসেছে ভিন্ন আঙ্গিকে। রিমঝিম ধারাকে তিনি বর্ণনা করেছেন প্রিয়তমার আগমনী বারতা হিসেবে। কবি লিখেছেন- ‘বাদল রাতের পাখি/উড়ে চল যেথা আজো ঝরে জল,/নাহিক ফুলের ফাঁকি।’ (চক্রবাক, বাদল রাতের পাখি)।

বৃষ্টি এলেই গ্রাম বাংলার চিত্র বিস্মিত হয়ে ওঠে চোখের পাতায়। পূর্ণ যৌবনে টইটম্বুর জলরাশি ছুটে চলা, দু-কূল

ছাপিয়ে ছল ছল শব্দে নদীর এগিয়ে চলা, টিনের চালে জলধারার ‘টিপটিপ’ শব্দ যে তন্ময়তার সৃজন করে, তার কোনো তুলনাই হয় না। এ যেন এক অন্যরকম পৃথিবী। বৃষ্টি শুধু ভিজিয়েই দেয় না, জীবনকে রাঙিয়েও দেয়। বৃষ্টির পরশেই ফোটে রজনীগন্ধা, কদম, জুঁই, টগর, বেলি প্রভৃতি ফুল। ফুলের সুবাসিত গন্ধে ভরে যায় মন মিনার।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও খতিব

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close