মোতাহার হোসেন

  ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

বিশ্লেষণ

আলোর পথের দিশারি

স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্মদিন, তথা হীরক জন্মজয়ন্তী আজ। ৭৫ বছর আগে আজকের এই দিনে তিনি পৃথিবীতে আগমন করেন। তার জন্মদিনটি আমার কাছে বাংলাদেশের পুনর্জন্ম বলে মনে হয়। কারণ অত্যন্ত সহজ। ৩০ লাখ শহীদ, চার লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রু এবং কতিপয় উচ্চভিলাষী বিপথগামী সেনাসদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে সেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ঘাতকচক্র মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যা করার চেষ্টা করে। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র নানা আবরণে দীর্ঘ ২১ বছর দেশ পরিচালনা করে। এ সময় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাকে ধ্বংস করে যুদ্ধাপরাধী মানবতাবিরোধীরা। আজকের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্ম যদি না হতো, কিংবা তিনি যদি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে না আসতেন, আওয়ামী লীগের হাল না ধরতেন তাহলে আজকের যে বাংলাদেশ আমরা দেখছি, তা আমাদের দেখা সম্ভব হতো না। কারণ বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়েছেন স্বাধীনতা, আর তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা দিয়েছেন জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি ও প্রত্যাশিত উন্নয়ন, যা না হলে বিশ্বে বাংলাদেশ ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হতো না। ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে যেই বাংলাদেশকে হত্যা করা হয়েছে। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে পরে দেশের হাল ধরার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের পুনর্জন্ম হলো।

এ বছর আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশত বছর পূর্ণ করেছি। অতিমারির কারণে সীমিত পরিসরে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করা হয়েছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সম্পর্কে সব নেতিবাচক ও নিরাশাবাচক ভবিষ্যদ্বাণী প্রমাণ করে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।’ আবার এ বছরই জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপিত হয়েছে। এরই মধ্যে ‘কোভিড-১৯’ গত ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক সংকট হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থিত হয়েছে। এমনই অবস্থায় মানবজাতি নতুনভাবে বিশ্বব্যবস্থার পরিকল্পনার কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছে, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এবারও করোনার অতিমারির মধ্যে ?বাংলার গণমানুষের নন্দিত নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ দেশ-বিদেশের মানুষ তার দীর্ঘায়ু কামনা করে দোয়া ও আশীর্বাদ করবেন।

রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণের সুবাদে শৈশব থেকেই সংগ্রামী চেতনার সুমহান উত্তরাধিকার বহন করছেন তিনি। পিতার সংগ্রামী জীবনের আত্মত্যাগ কাছ থেকে দেখেছেন, শিখেছেন। ছাত্রলীগের নেত্রী শেখ হাসিনা ইডেন মহিলা কলেজের নির্বাচিত ভিপি হিসেবে ৬৯-এর গণ-আন্দোলনে সক্রিয় সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ ৪০ বছর নিষ্ঠা, সততা ও সাহসের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে, অত্যাচার-অবিচার, জেল-জুলুম সহ্য করে গণরায়ে অভিষিক্ত করে চারবার সরকারে অধিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আগরতলা মামলায় জাতির পিতা কারারুদ্ধ থাকা অবস্থায় অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্যক্তিগত জীবনে আইটি বিশেষজ্ঞ পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও অটিজম বিশেষজ্ঞ কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের গর্বিত জননী।

জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রিয় মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা প্রদান করে বাংলা ভাষাকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন। বিশ্বে যারা এক দিন তাচ্ছিল্য করে বলেছিল, বাংলাদেশ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। আর আজ তারাই বলে, ‘বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের’। জাতির পিতা দুটি লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। এর একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেননি। সেই কাজটি তার কন্যা শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষতা, নিষ্ঠা, সততা ও সাহসের সঙ্গে সম্পন্ন করে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন তার নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ হবে মর্যাদাশালী, ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।

প্রসঙ্গত, নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দেশের মানুষ ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করেন এবং প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ হাসিনা। ওই সময় উত্তপ্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে তিনি চুক্তি করেন। ১৯৮১ সালের পর থেকে দীর্ঘ চার দশক ধরে দেশের রাজনীতির অগ্রভাগে থেকে নিরলস নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ সময় ঘাতকদের উত্তরসূরিরা বারবার তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ছিল অন্যতম, যা ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত একটি হত্যা ষড়যন্ত্র। সেই হামলার মূল লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিস্তার ঘটানো। এর আগেও তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িকতার আঁতুড়ঘর বানাতে চেয়েছিল। পরে ঘাতকদের আনুকূল্যে যারাই ক্ষমতাসীন হয়েছে, তারাই বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিরাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছে। তারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিস্তার ঘটিয়েছে। কারণ বঙ্গবন্ধুর হত্যকারীরা সংবিধানের সব মূলনীতি বিধ্বস্ত করেছিল। তারা সংবিধানকে এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছিল, তাতে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র অবশিষ্ট ছিল না। জঙ্গিবাদের উত্থান, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দরিদ্রতাসহ নানা কারণে দেশ যখন একটি ক্রান্তিকাল পার করছিল, এমন পরিস্থিতিতে তিনি ক্ষমতাসীন হন। জঙ্গিবাদ নির্মূল, দুর্নীতি দমন, দারিদ্র্যবিমোচন ও জীবনমানের উন্নতি ঘটানো জরুরি হয়ে পড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর অনেক বেশি দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। তিনি সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ত্যাগ, শ্রম ও সাহসিকতা বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত করবে বলে। বঙ্গবন্ধুকন্যা দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে না এলে বাংলাদেশের আজকের ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো। অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সামাজিক, স্বাস্থ্য খাত, যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নের এই যে এত অগ্রসরতা অথবা আজকে বাংলাদেশ যে বিশ্বদরবারে সম্মানজনক অবস্থায় পৌঁছেছে, এটি বঙ্গবন্ধুকন্যার মেধা, শ্রম, সাহসিকতা ও দক্ষতার ফসল। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, এটি মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, এটি ১৮ কোটি বাঙালির স্বপ্ন। এই স্বপ্নপূরণে তিনি নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। নির্মিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ। আর এই আরাধ্য দেশ নির্মাণই বাঁচিয়ে রাখবে বঙ্গবন্ধুকে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে অনন্তকাল ধরে। এর জন্য প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বের চলমান কল্যাণধর্মী, মমতাময়ী ও সাহসী নেতৃত্ব।

বিশ্বে অধিকার বঞ্চিত, শোষিত, নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছেন বহু মহামানব। শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, জেল-নির্যাতন মোকাবিলা করে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হয়েছে তাদের অনেককে। ২৩ বছর পাকিস্তানের জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে, বারবার মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালে অধিকারবঞ্চিত বাঙালির স্বাধীনতা এনেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন মানবদরদি নেতা। বিশ্বে তার পরিচিতি ছিল শোষিত মানুষের নেতা হিসেবে। তার কন্যা এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায়। মানবিক মনোভাবের কারণে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এখন বিশ্বে একটি বহুল আলোচিত নাম। তার নামের আগে-পরে কোনো বিশেষণ যোগ করার দরকার হয় না।

ধূলি-ধূসরিত গ্রামের ছোট ছোট আনন্দ-বেদনার যে জীবন; যে জীবন ঘাস-লতা-পাতা-শ্যাওলার সূর্য ছায়ায় অনন্তকাল চলমান, সেই দুঃখ দহনের পথের পাঁচালিকেই আজন্ম ভালোবেসেছেন আমাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা। এ পথের হয়তো কোনো শেষ নেই। এজন্য শেখ হাসিনা কেবল গ্রামে ফিরতে চান। জন্মগ্রাম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় যেতে চান। হারানো মা, বাবা, ভাই ও স্নেহের ছোটভাই রাসেলকে ওই নীলাকাশ আর আলো-বাতাসে খুঁজে পেতে চান। জাতির পিতার মতোই শেখ হাসিনা চিরকালের বাঙালির মঙ্গলালোকের প্রসন্ন মানুষ, মানবতাবাদী। রাজনৈতিক জীবনে তিনি বাংলার মানুষের ভোট ও ভাতের নিশ্চয়তা দানকারী। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে তিনি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী ও জাতির পিতাসহ পরিবারের সদস্যদের খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও বিচার নিশ্চিত করে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন। একজন নিরহংকার আল্লাহভক্ত মানুষ, যিনি পিতা-মাতা, ভাই ও স্বজনহারানোর বেদনার জগদ্দল পাথর বুকে নিয়ে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে অবিরাম সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার শুভ জন্মদিনে তার সুস্থ ও দীর্ঘজীবন কামনা করি। মুজিববর্ষে অবস্থান করে আমরা যখন আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার হীরক জন্মজয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছি, তখন সমগ্র জাতি ও বিশ্বের সব বাংলা ভাষাভাষী মানুষসহ অন্য সবাইকে জানাচ্ছি আন্তরিক শুভেচ্ছা, কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close