আবু আফজাল সালেহ

  ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

দৃষ্টিপাত

পাটের বহুমুখীকরণ আজ সময়ের দাবি

একসময় পাট ছিল আমাদের একমাত্র রপ্তানি পণ্য। কিন্তু বিদেশি চক্রান্ত ও সুদক্ষ পরিচালনা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে প্রায় মরে গেছে এ শিল্প। বর্তমান সরকার এ খাতকে গতিসঞ্চার করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। যার ফলও আমরা হাতে-নাতে পাচ্ছি। সম্প্রতি পাটের উৎপাদন বাড়ছে। কৃষিজমির হ্রাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে ‘পাট চাষ জোন’ গড়ে তোলা যেতে পারে। পাটপণ্যের পাশাপাশি হরেক, বাহারি, নিত্যব্যবহার্য, ফ্যাশনেবল বহুমুখী পাটসামগ্রীর প্রসার ও বিপণন এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন গতি সঞ্চার করেছে। বাংলাদেশ বিশ্বের মোট পাটের ৩৩ শতাংশ উৎপাদন করে এবং কাঁচা পাটের প্রায় ৯০ শতাংশই রপ্তানি করে। আমাদের ব্যবহারিক জীবনে পাটের গুরুত্ব অপরিসীম। এই পাট থেকে উৎপাদিত পণ্য (যেমন- বস্ত্র, থলে, দড়ি, কাছি, সূক্ষ্ম বস্ত্র ও কার্পেট প্রভৃতি) আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিনিয়ত ব্যবহার হয়ে থাকে। এই বাংলাদেশের পাট থেকে তৈরি ‘জুটন’ পৃথিবীর নানা দেশে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। আমাদের পাটকলের তৈরি কার্পেট পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এখনো বিশেষভাবে সমাদৃত। এ ছাড়া পাটের তৈরি ঝুড়ি, শিকে এবং কারুকাজশোভিত অন্য দ্রব্য বিদেশিদের শুধু দৃষ্টি কাড়ছে। এগুলো রপ্তানি করে বাংলাদেশ এখনো যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। বাজারে পাটের তৈরি চালের বস্তা ও সুতলি থেকে গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার বহুমুখী পাটপণ্যের বাজার সৃষ্টি হয়েছে। পাটপণ্যের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের নান্দনিক ব্যাগ, সেমিনার ফাইল ও প্রমোশনাল পণ্য, নানা ধরনের গৃহস্থালি, বাহারি সাজসজ্জায় ব্যবহৃত পণ্যসামগ্রী অন্যতম।

পাটের বহুমুখীকরণ করতে হবে। পাটের বহুমুখীকরণ যত বাড়ানো যাবে ততই পাটের অর্থনীতিতে অবদান বাড়বে। শুধু পাটেই নয়- যেকোনো পণ্যের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। আমরা যতই আধুনিক হচ্ছি ততই রুচিবোধে ভেরিয়েশন আসছে। আর এ কারণেই বহুমুখীকরণ ছাড়া অন্য উপায় কমফলপ্রসূ হবে। মানুষের রুচির ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে এবং তা অতি দ্রুততার সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে। খাপ খাওয়াতে তাই পাটের বহুমুখীকরণে সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার। পাটের মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০ ও বিধিমালা-২০১৩ আছে। পলিথিন উৎপাদন, বিপণন, ব্যবহার বন্ধ ও পাটপণ্যের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে চাহিদা অনুযায়ী গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন এবং এর প্রচার বাড়াতে হবে। মানসম্মত পাট উৎপাদন, পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, পাটপণ্যের বহুমুখীকরণ, পাটকলের আধুনিকায়ন, পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারণ এই পাঁচটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে ‘জাতীয় পাটনীতি-২০১৮’-এর অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। পাটের গুরুত্বের বিষয়টি সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। কারণ বর্তমান সরকারের উদ্যোগে ২০১৭ সালেই সর্বপ্রথম ৬ মার্চকে জাতীয় পাট দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সরকার ২০১০ সাল পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। দেশ-বিদেশে পাটের বাজার পুনরুজ্জীবিত করতে ‘পাট আইন-২০১৭’ যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।

পাটের উন্নয়ন ও বহুমুখীকরণের জন্য প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দরকার গবেষণা। এ ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে প্রচুর গবেষণা হয়। তার ফলেই কৃষিতে আমাদের প্রচুর উন্নতি হয়েছে। আসলে কোনো বিষয়/সেক্টরে উন্নয়নের জন্য প্রচুর গবেষণার ক্ষেত্র থাকতে হবে। অদৃশ্য এ উন্নয়নে আমাদের জোর দিতে হবে। এটা অবশ্য সব সেক্টরের জন্য প্রযোজ্য বলে আমি মনে করি। ভালোমানের বীজের অভাব সব সময়েই থাকে। অনেক ক্ষেত্রে চোরাইপথে আসা ভারতীয় নিম্নমানের পাটের বীজে আশানুরূপ ফল পাই না আমরা। নিজস্ব বীজ উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তা না হওয়া পর্যন্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণে ভালো বীজ আমদানি করে কৃষকের মধ্যে বিতরণ/বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। পাট চাষ, সংরক্ষণ ও বিতরণের উন্নয়নে কৃষিঋণের সহজীকরণ করতে হবে। প্রয়োজনে ব্যাংকগুলোর ওপর তদারকি বাড়াতে হবে। পাটের কম দাম পান প্রান্তিক কৃষকরা। কৃষকের চেয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি লাভবান হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিনা পুঁজিতে কৃষকের মাথায় ব্যবসা করে থাকে। তাদের কোনো লোকসানের ভয় নেই; কিন্তু কৃষকের লোকসানের আশঙ্কা থাকে। তারা আবার সিন্ডিকেটও তৈরি করে থাকে। কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি পাট কেনার ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। এই নেতিবাচক দিকগুলো শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এতে কৃষকরা লাভবান হবে এবং পাট চাষে ঝুঁকবেন। পাট-সংশ্লিষ্ট কুটিরশিল্পের জোরদারকরণ প্রকল্প হাতে নিতে হবে। দক্ষ জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে বহুমুখীকরণে তাড়াতাড়ি ফল পাব আমরা। তাদেরও পুনঃপুনঃ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ থেকে দক্ষতর জনবল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে বৈচিত্র্য আনতে পারব। সরকারের নতুন নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দ্রুত খাপ খাওয়াতে পারবে তারা। পাট ও পাটসামগ্রী বিপণনে হাটবাজার সম্প্রসারণ করতে হবে, গুদাম মেরামত বা নতুন তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থাকরণের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

সোনালি ব্যাগের প্রসারের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষতিকারক পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে এতে আকৃষ্ট করতে হবে। প্রয়োজনে প্রথমদিকে সোনালি ব্যাগের উন্নয়ন/ব্যবহারে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমদানি করা পচনশীল পলিমার ব্যাগের যে দাম তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ দামেই পাওয়া যাবে সোনালি ব্যাগ। বর্তমানে এক কেজি পলিথিন তৈরি করতে ২০০-২৫০ টাকা খরচ হয়। এর চেয়ে ৫০-১০০ টাকা বেশিতেই পাওয়া যাবে প্রতি কেজি সোনালি ব্যাগ। ব্যাগটির দাম কমিয়ে দেবে মূলত এর বিভিন্ন বাই-প্রডাক্ট (উপজাত)। এর গুরুত্বপূর্ণ দুটি বাই-প্রডাক্ট হলো লিগনিন ও হেমোসেলুলোজ। বিভিন্ন ধরনের কসমেটিক সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা হয় লিগনিন। এটি ভালো দামে বিক্রি হবে। আর হেমোসেলুলোজ সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাটের যে আঁশ এই ব্যাগ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় তার মাত্র ২-৩ শতাংশ উচ্ছিষ্টাংশ হিসেবে বেরিয়ে আসবে। বাকি ৯৭-৯৮ শতাংশই হবে কোনো না কোনো প্রডাক্ট। পাট একটি পরিবেশবান্ধব পণ্য। পরিবেশবিনাশী পলিথিন এমন একটি রাসায়নিক বস্তু যা পচনশীল নয়। এটি পোড়ালেও দুর্গন্ধযুক্ত ধোঁয়া বের হয়ে পরিবেশ নষ্ট করে দেয়। এটি যেখানে পড়ে থাকে সেখানে থেকেই কৃষি ফসলের জমিতে মাটির রস চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন খাল-বিল, নদী-নালা, ড্রেন, নর্দমা- সব জায়গায় পরিত্যক্ত পলিথিন জমে জমে পানি চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে থাকে। সেজন্যই পলিথিনের বিকল্প হিসেবে শুধু বাংলাদেশে নয়, আমাদের প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে ‘ক্যারিং ব্যাগ’ হিসেবে পাটের তৈরি ব্যাগ অনায়াসে ব্যবহার করা হচ্ছে।

পাটের কোনো কিছুই ফেলনা নয়। ছোট-বড় সব ধরনের পাটগাছ থেকে পাতা নিয়ে পুষ্টিকর পাটশাক খাওয়া যায়। এ পাটশাক শুকনো হিসেবেও দীর্ঘদিন ঘরে সংরক্ষণ করে খাওয়ার সুযোগ থাকে। পাটের পুরো মৌসুমে জমির মধ্যে যে পাতা পড়ে, তা ওই জমির জৈব পদার্থযোগে উর্বরতা বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। পাটের শিকড়, গাছ, পাতা থেকে সার যোগ হলে পরবর্তী ফসল আবাদে ওই জমিতে আর কোনো বাড়তি সার প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। জনগণের মধ্যে দেশীয় পণ্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া। সর্বনাশা পলিথিনের ব্যবহার স¤পূর্ণরূপে বন্ধ করে সুলভ ও আকর্ষণীয় পাটপণ্য তৈরি করার প্রতি জোর দিতে হবে। এ জন্য শ্রমব্যবস্থাপনায় আধুনিক ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষকতা, শ্রমিক-স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অধিক মনোযোগ দিতে হবে। পাটশিল্পে দক্ষ কর্মী সৃষ্টিতে অধিক ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট স্থাপন করা দরকার। পাট একটি পরিবেশবান্ধব বস্তু। পাট থেকে উন্নতমানের ভিসকস সুতা উৎপাদন হয়। যার সুতি কাপড় থেকে ও বাজারমূল্য বেশি। পাটখড়ি জ্বালানির প্রধান উৎস হলে কয়েক বছর ধরে পাটখড়ির চারকোল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, আয় হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে পাট থেকে তৈরি হচ্ছে চা। এতে জীবনরক্ষাকারী উপাদান আছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের পাটশিল্পে বেশ কিছু সমস্যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এ ছাড়া স্থবিরতা বা মূল্যহ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি; পুরোনো যন্ত্রপাতির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস, শ্রমিক সমস্যা, বহুবিস্তৃত দুর্নীতি, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, মূলধন ঋণে উচ্চসুদের হার আদায়, রাষ্ট্রায়ত্ত মিলে অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, অনিয়ন্ত্রিত অপচয়, বিদ্যুৎ ঘাটতি, অদক্ষ বা আধা দক্ষ শ্রমিক, অধিক জনবল নিয়োগ, জবাবদিহির অভাব, রুগ্ণ ট্রেড-ইউনিয়ন চর্চা ইত্যাদি সমস্যা এ শিল্পের জন্য অন্তরায়। এ বিষয়গুলো ভালোভাবে দেখতে হবে বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাটকলগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর বিশদ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দেশ ও বিদেশে পাটের বাজার বাড়াতে পাটজাত পণ্যের প্রদর্শনী, মেলা ও প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন দূতাবাসের মাধ্যমে বিদেশে প্রচারের কাজ ত্বরান্বিত করাও জরুরি। আমাদের টেকসই উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কোয়ালিটি উন্নয়ন করতে হবে পণ্যে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। যত প্রশিক্ষণ তত দক্ষ জনবল তৈরি হবে। বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করবে। আর দরকার জনসচেতনতা সৃষ্টি। ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে পলিথিন বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক জিনিসপত্র ব্যবহারে অনুৎসাহিত করে ইতিবাচক জনমত গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি-মিডিয়া- বেসরকারি সেক্টর সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে আমরা ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব। এরই মধ্যে সরকার ও সবার প্রচেষ্টাই আমরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সফল হয়েছি।

লেখক : উপপরিচালক (বিআরডিবি)

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close