reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পর্যালোচনা

হতাশার মধ্যে অর্থনীতিতে আশার আলো

মোতাহার হোসেন

বৈশ্বিক মহামারি করোনায় দেশের সামগ্রিক কাঠামোতে আঘাত হেনেছে। দেশের অর্থনীতিকে নতুন করে চাপে ফেলেছে। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও করোনার এই অভিঘাত মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী ও দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে করোনার কারণে বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের মানুষ দরিদ্রে নিপতিত হবে। মারা যাবে হাজার হাজার মানুষ। শিশু ও নারীরা পুষ্টিহীনতায় নিপতিত হবে। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না ইত্যাদি। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের এসব পূর্বাভাসকে ভুল প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ; যা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সুযোগকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে। সময়োচিত সিদ্ধান্ত, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং তার সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় দেশের মানুষ আশার আলো দেখতে শুরু করেছে। বিশেষ করে করোনাকালে মানুষের জীবিকা ও জীবনকে সচল রাখা এবং অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সোয়া লাখ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দেশকে এই দুর্যোগেও গতিশীল রাখতে সাহায্য করেছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সরকারের সোয়া লাখ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজসহ নানা কর্মসূচির কারণে চলতি অর্থবছরে জিডিপি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ অর্জিত হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। সরকার গৃহীত প্রণোদনার সঠিক বাস্তবায়নের কারণে এর সুফল ইতোমধ্যে মানুষ পেতে শুরু করেছে। মূলত এখানেই নিহিত রয়েছে শেখ হাসিনার সরকারের ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের সাফল্য।

প্রসঙ্গত, আমাদের দেশে করোনার ধাক্কা সামলাতে শুরু থেকে মানুষের জীবন, জীবিকা রক্ষার পাশাপাশি প্রায় সোয়া লাখ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি দেশের হতদরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের জীবিকার কথা বিবেচনায় নিয়ে নানা রকম সামাজিক কর্মসূচির আওতা সম্প্রসারণ ও উপকার ভোগীর সংখ্যা এবং সহায়তার পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। এসব কর্মসূচির মুখ্য উদ্দেশ্যই হচ্ছে প্রাণঘাতী করোনার মধ্যে মানুষের জীবন রক্ষা করা, মানুষের জীবিকার চাকা সচল রাখা এবং দেশে চলমান অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের গতিকে এগিয়ে নেওয়া। এমনি অবস্থায় সরকার গৃহীত এসব কর্মসূচির সফলতাও আসতে শুরু করেছে। স্থানীয় এবং বৈশি^ক অর্থনৈতিক সূচকেও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্ত, সবল এবং নিয়ত গতিশীল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে অর্থনীতির প্রধানতম সব সূচকে ঊর্ধ্বমুখী অবস্থান বিরাজ করছে। বিশেষ করে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানি আয় হয়েছে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার, তথা ৪০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। এই আয় লক্ষ্যমাত্রা অপেক্ষায় ৪ শতাংশ বেশি আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। এ সময় শুধু রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাত থেকে আয় হয় ৩ হ্জাার ৪১০ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ বেশি। বিগত অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হচ্ছে ৩৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার আর গত আগস্ট মাসে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৭৩ কোটি ডলার আর জুনে এসেছে ১৮৩ কোটি ডলার। মূলত রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ আর রেমিট্যান্স বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের ওপর ২ শতাংশ হারে এবং পণ্য রফতানি আয়েও প্রণোদনা প্রদান। রেমিট্যান্সের ওপর প্রণোদনা প্রদানে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেল ব্যবহার করায় রিজার্ভ, রেমিট্যান্স দুটোই ক্রমাগত সমান হারে বাড়ছে। এটি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা রাখছে। অবশ্য করোনাকালে দেশের অর্থনীতির গতিময়তায় সরকারি মহলসহ সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন সহযোগীরা বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকের সেপ্টেম্বর আপডেটে বালাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক তথ্য ওঠে এসেছে। এতে বলা হয়, ‘প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা সামলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৬ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়তে পারে বলে প্রাক্কলন করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি।’ আর সরকারের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বরাবরই বলে আসছেন বছরান্তে জিডিপি ৮ শতাংশ অর্জিত হবে। তবে এই পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে মহামারিকেই সবচেয়ে বড় ঝুঁকি বলে মনে করছে এডিবি। অর্থাৎ বাংলাদেশে কিংবা বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের গন্তব্য দেশগুলোতে মহামারির সংকট দীর্ঘায়িত হলে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন নাও হতে পারে। তারা বলছে, উৎপাদনের গতি বাড়ায় এবং বাংলাদেশি পণ্যের ক্রেতা দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ ২০২১ সালে মূল্যস্ফীতিকে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে এবং চলতি হিসাবের (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) ঘাটতিকে জিডিপির ১ দশমিক ১ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখতে পারবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

তবে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের এধারা টেকসই করতে সামষ্টিক অর্থনীতির বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনা এবং সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা কর্মসূচির বাস্তবায়নে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে এডিবি। এডিবির মতে, ‘মহামারির ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্য খাতে বিপুল চাপের পরও সরকার যথাযথ প্রণোদনা ঘোষণা এবং সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়িয়ে দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা নিয়ে অর্থনীতিকে ভালোই সামাল দিয়েছে।’ রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে সাম্প্রতিক ইতিবাচক ধারা এবং বিদেশি তহবিল সংগ্রহের পাশাপাশি সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বাস্তবায়নের ফলেই অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করেন এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বাংলাদেশ ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্যও ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল। কিন্তু মহামারির মধ্যে দুই মাসের লকডাউন আর বিশ্ববাজারের স্থবিরতায় তা বড় ধাক্কা খায়। আমাদের মনে রাখা উচিত, করোনা মহামারিতে রফতানি আয় কিছুটা হোঁচট খেয়েছে। তবে এপ্রিল মাসের পর থেকে প্রবাসীদের পাঠানো টাকার পরিমাণ আশাতীত হারে বাড়তে থাকায় শেষ পর্যন্ত রেমিট্যান্সে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। গত অর্থবছরে দেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১ হাজার ৮২০ কোটি ৩০ লাখ ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার আয় করেছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম। তবে মহামারির সংকটে রফতানি আয় যতটা ধাক্কা খাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি ততটা খারাপ হয়নি।

এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ বলেন, ‘রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের উন্নতি দেখে আমরা উৎসাহ পাচ্ছি।’ আশা করছি, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের এই ধারা টেকসই হবে। আর তা করা গেলেই প্রাক্কলিত জিডিপি অর্জন সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে করোনার টিকা যদি আগে পাওয়া যায় এবং মহামারিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর যে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তা যদি অব্যাহত রাখা হয়, তা হলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের এই ধারাকে টেকসই করতে ‘সহায়ক হবে’ বলে মনে করছেন তিনি। এডিবি প্রদত্ত বিবৃতিতে আরো বলা হয়, এই সংকটে সম্পদের যথাযথ বণ্টন, ব্যবস্থাপনা, রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ, নতুন নতুনভাবে কর্মসংস্থানের বিবিধ ক্ষেত্রে বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি তথা ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান, আউটসোর্সিং, ক্ষুদ্র, মাঝারি, কুঠির শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, হাঁস-মুরগি গবাদিপশু পালন, মৎস্য খামার গড়ে তুলে বেকার, তরুণ-যুবকদের কর্মসংস্থান করা গেলে বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতির চাকা আরো বেগবান হবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, স্বল্প সুদে ও সহজ কিস্তিতে ঋণ, প্রয়োজনীয় কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা, তাদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্যপ্রাপ্তি, বাজার ব্যবস্থাপনাসহ সরকারি সহায়তা দরকার। একই সঙ্গে কর্মরত মানুষের দক্ষতা উন্নয়ন এবং সামাজিক সুরক্ষা জোরদারে আরো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগানো গেলে সম্ভাবনার দ্বার আরো প্রসারিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের লক্ষ রাখা প্রয়োজন যে, করোনাকালে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন, অর্থায়ন না করে এ সময়ের উপযোগী প্রকল্প গ্রহণ করার পাশাপাশি যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকে গুরুত্ব দেওয়া। প্রত্যাশা থাকবে করোনাকালে মানুষের জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক রাখা এবং কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির চাকা আরো বেগবান করতে প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা। তাহলেই সম্ভব ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মতো বৈশ্বিক মহামারি করোনা যুদ্ধেও জয়ী হয়ে দেশকে, দেশের মানুষকে স্বস্তির জায়গায় রাখা অসম্ভব নয়।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close