আহমদ আবদুল্লাহ

  ১২ জানুয়ারি, ২০১৮

ধর্ম

ইহ ও পরকালের মুক্তির পথ

সৎকাজ হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তারই আদেশ-নিষেধ মান্য করে জীবনের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা। মহান আল্লাহ যেসব কাজ করতে আদেশ করেছেন সেসব কাজ করা এবং যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তা বর্জন করাই হলো ‘আমলে সালিহা’ বা সৎকাজ। আল্লাহ তায়ালা ইমান অবলম্বন করতে, নামাজ কায়েম করতে, রমজান মাসে রোজা রাখতে, জাকাত আদায় এবং হজ পালন করার আদেশ করেছেন। তিনি মা-বাবার সঙ্গে সদাচারণ, প্রতিবেশীর হক আদায়, আত্মীয়তা বজায় রাখা, সবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার, দান-খায়রাত করা, বিপদে ধৈর্যধারণ, নেয়ামতের শুকরিয়া করা ইত্যাদি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহর এসব আদেশ ও নির্দেশ পালন করা যেমন সৎকাজ, তেমনি তার নিষিদ্ধ কাজ মিথ্যা বলা, গিবত করা, সুদ-ঘুষ খাওয়া, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, গর্ব করা, হারাম পন্থায় আয় করা, জুলুম-নির্যাতন, ঝগড়া-ফ্যাসাদ ইত্যাদি বর্জন করাও সৎকাজ।

বিভিন্ন প্রসঙ্গ ও ঘটনা পরম্পরায় কোরআনে অর্ধশত আয়াত অবতারণা করে সৎকাজ সম্পাদনে মহামহিম আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কোথাও আদেশ, কোথাও নির্দেশ এবং কোথাও উদ্বুদ্ধ করেছেন। তবে যেখানে সৎকাজ করার কথা উল্লেখ করেছেন, সেখানে ইমানের কথাও বলেছেন। এ সম্পর্কিত কোরআনে সবগুলো আয়াতই ‘ইয়া আইউহাল্লাজিনা আ-মানু ওয়ামিলুস সা-লিহাতু’Ñঅর্থাৎ ‘যারা ইমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে’ দিয়ে শুরু হয়েছে। এ থেকে প্রতিভাত হয়, কোনো ব্যক্তি ইমান আনলেই মুমিন হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, সৎকাজ সম্পাদনের মাধ্যমে তাকে তার স্বাক্ষর রাখতে হবে। ইমান মনের গভীরে গোপন লালিত বিশ্বাস এবং সৎকাজ দেহের সঙ্গে সম্পৃক্ত, প্রকাশ্যে সংঘটিত কর্মানুষ্ঠান, একটি অন্যটির পরিপূরক। ইমান সৎকাজ যেমনি মূল্যহীন, সৎকাজ ছাড়া তেমনি প্রাণহীন। ইমানদার ব্যক্তি সৎকাজ করলে সৎকর্মশীল বলে গণ্য হবে এবং ইহ ও পরকালে আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত নেয়ামতের দাবিদার হবে।

মহান রাব্বুল আলামিন সৎকাজ সম্পাদন এবং অসৎকাজ বর্জন করতে এভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচারণ ও আত্মীয়স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎকাজ ও সীমালঙ্ঘন।’ তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষাগ্রহণ করো। (সুরা নাহল : ৯০)। ওই আয়াতে আল্লাহ তিনটি কাজের আদেশ দিয়েছেন। যেমন : সুবিচার, সদাচার ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি অনুগ্রহ করা এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনটি কাজ করতেও নিষেধ করেছেন। যেমন : নির্লজ্জ কাজ, প্রত্যেক মন্দ কাজ এবং জুলুম বা নির্যাতন। এসব আদিষ্ট ও নিষিদ্ধ কাজসমূহের মধ্যে যাবতীয় সৎ এবং অসৎকাজ এসে গেছে।

আয়াতে উল্লিখিত শব্দ ‘ইহসান’ বা সদাচারণ অর্থ সুন্দর করা, ভালোভাবে করা। আর তা দুই প্রকার : এক. কর্ম, চরিত্র, অভ্যাস ও ইবাদতকে সুন্দর ও ভালো করা। দুই. কোনো ব্যক্তির সঙ্গে ভালো ব্যবহার ও উত্তম আচরণ করা। প্রসিদ্ধ ‘হাদিসে জিবরিলে’ স্বয়ং রাসুল (সা.) ‘ইহসান’- এর যে অর্থ বর্ণনা করেছেন তা হচ্ছে ‘ইবাদতে ইহসান’। এর সারমর্ম এই যে, আল্লাহর ইবাদত এভাবে করা দরকার যেন তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছো। যদি আল্লাহর উপস্থিতি এমন স্তর অর্জন করতে না পারো, তবে এতটুকু বিশ্বাস তো প্রত্যেক ইবাদতকারীর থাকা উচিত যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর কাজ দেখছেন। কেননা, আল্লাহর জ্ঞান ও দৃষ্টির বাইরে কোনো কিছু থাকতে পারে না। এটি ইসলামি বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এরপর আত্মীয়স্বজনের হক আদায় করতে বলা হয়েছে। অর্থ দিয়ে সাহায্য, অসুস্থ হলে সেবা করা, দেখতে যাওয়া, বিপদাপদে সান্ত¡না ও সহানুভূতি প্রকাশ করা তাদের প্রাপ্য হকের অন্তর্ভুক্ত। মহান রাব্বুল আলামিন অশ্লীলতা, অসৎকাজ ও সীমালঙ্ঘন নিষেধ করেছেন। অসৎকাজ এমন কথা বা কাজ যা হারাম ও অবৈধ হওয়ার ব্যাপারে শরিয়ত বিশেষজ্ঞরা একমত। সীমালঙ্ঘন দ্বারা জুলুম ও উৎপীড়ন বোঝায়। সীমালঙ্ঘন এতটাই মন্দ কাজ যে, এর প্রভাব অপরাপর লোক পর্যন্ত সংক্রমিত হয়। মাঝেমধ্যে এই সীমালঙ্ঘন পারস্পরিক ঝগড়া-ফ্যাসাদ এমনকি দেশে দেশে যুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছায়, যা সারা বিশ্বে অশান্তির কারণ হয়।

আলোচ্য আয়াতে যে ইতিবাচক ও নেতিবাচক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা যথাযথ প্রতিপালনে নিহিত রয়েছে মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের সাফল্যের প্রতিকার। সুরা বাকারার ১১৭নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হলো, ইমান আনবে আল্লাহর ওপর, কেয়ামত দিবসের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর ও সমস্ত নবী-রাসুলের ওপর। আর সম্পদ ব্যয় করবে আল্লাহরই মুহাব্বতে আত্মীয়স্বজন, এতিম-মিসকিন, মুসাফির, ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত আদায় করে, যারা কৃত-প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং বিপদে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যধারণকারী, তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী এবং তারাই পরহেজগার।’

সুতরাং যারা ইমান ও সৎকাজ নিয়ে পরকালে উপস্থিত হবে, তাদের ক্ষমা করা হবে, তাদের মন্দ কাজগুলো মিটিয়ে দেওয়া হবে। আর বিনিময়ে হিসেবে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, আল্লাহ তাদের ক্ষমা ও মহাপ্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’ (সুরা মায়িদা : ০৯)। এমনিভাবে অন্য আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আমি অবশ্যই তাদের মন্দ কর্মগুলো মিটিয়ে দেব এবং তাদের তাদের উৎকৃষ্টতর প্রতিদান দেব। (সুরা আনকাবুত : ০৭)। উল্লিখিত আয়াতদ্বয় দ্বারা এটাই প্রতিভাত হয় যে, পরকালে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মহান আল্লাহ তার বান্দাদের দুনিয়াতে ইমান ও সৎকাজ সম্পাদনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সুরা কাহাফের ১০৭নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা সৎকর্মশীল মুমিনদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে তাদের অভ্যর্থনার জন্য রয়েছে জান্নাতুল ফেরদাউস। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। তারা সেখান থেকে স্থান পরিবর্তন করতে চাইবে না।’

ইমানদার ব্যক্তি সৎকর্মের বিনিময়ে কেবল পরকালেই পুরস্কৃত হবেন তা-ই নয়, দুনিয়াতেও আনন্দময় পবিত্র জীবন লাভ করবেন। আল্লাহ বলেন, যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ইমানদার পুরুষ হোক কিংবা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব। (সুরা নাহল : ৯৭)। ওই আয়াতে ‘পবিত্র জীবন’ বলতে আনন্দময় পবিত্র জীবন বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যে ইমানদার ব্যক্তি দুনিয়াতে যথাযথভাবে সৎকাজ করবে সে আনন্দময় পবিত্র জীবন লাভ করবে। এটা এরূপ নয় যে, সে কখনো অনাহার-উপবাস বা অসুখ-বিসুখের সম্মুখীন হবে না। বরং এর অর্থ হলো, মুমিন ব্যক্তি কোনো সময় আর্থিক অভাব-অনটন কিংবা কষ্টে পতিত হলেও দুটি বিষয় তাকে উদ্বিগ্ন হতে দেয় না। এক. অল্পে তুষ্টি ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের অভ্যাস, যা দরিদ্রের মধ্যেও কেটে যায়। দুই. তার এ বিশ্বাস থাকে যে, অভাব-অনটন ও অসুস্থতার বিনিময়ে পরকালে সুমহান চিরস্থায়ী নেয়ামত পাওয়া যাবে। কাফের ও পাপাচারী ব্যক্তিদের অবস্থা এর বিপরীত। সে অভাব-অনটন ও অসুস্থতার সম্মুখীন হলে তার জন্য সান্ত¡নার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে সে কা-জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। প্রায়ই আত্মহত্যা করে ফেলে। পক্ষান্তররে সে যদি সচ্ছল জীবনের অধিকারীও হয়, তবে লোভের অতিশয্য তাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। সে লাখপতি হয়ে গেলেও কোটিপতি হওয়ার চিন্তায় জীবনকে বিড়ম্বনাময় করে তোলে।

ইমানদার সৎকর্মশীল লোকদের পরস্পরের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের দয়াময় আল্লাহ ভালোবাসা দেবেন।’ (সুরা মারয়াম : ৯৬)। অর্থাৎ ইমান ও সৎকর্ম দৃঢ়পদ ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহ বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন। উদ্দেশ্য হলো, ইমান ও সৎকর্ম পূর্ণরূপ পরিগ্রহ করলে এবং বাইরের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত হলে ইমানদার সৎকর্ম সৎকর্মশীলদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতি তৈরি হয়। একজন সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তি অন্য একজন সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তির সঙ্গে ভালোবাসা বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য মানুষ ও সৃষ্টিজীবের মনেও আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করেন।

লেখক : ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist