মো. মিরাজ উদ্দিন, বাকৃবি

  ০৯ মে, ২০২৪

অবশেষে চক্রবৃত্ত পঞ্চান্নের ইতি

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র কবিতার কথা মনে আছে? আমার কিন্তু প্রায়ই মনে পড়ে, সেটি হলো-

‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়, বিচ্ছেদ নয়

চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন করা আর্দ্র রজনী

চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে

আমার না-থাকা জুড়ে।’

কবিতার এই খণ্ডাংশটি হৃদয়ের গভীর স্থানে সূক্ষ্ম দাগ কেটে যাওয়ার মতোই। হ্যাঁ! ঠিক একইভাবে থেকে যাবো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনে কোনো-না-কোনো না-থাকা জুড়ে। তবে প্রতিটি চলে যাওয়াই কষ্টের। কিছু কিছু ‘চলে যাওয়া’ এবং কিছু কিছু ‘ফেলে চলে আসা’ মেনে নেওয়া অসম্ভব কঠিন হয়ে পরে মাঝে মাঝে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের সাথে সাড়ে পাঁচ বছর একসঙ্গে ক্লাস, প্র্যাকটিকাল, আড্ডা, ঘুরাঘুরি আর জীবনের সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি সেই পশুপালন অনুষদের চক্রবৃত্ত পঞ্চান্ন ব্যাচের আজ ইতি। আর হবে না একসঙ্গে ক্লাস কিংবা ঘুরাঘুরি, সবাই যেন হারিয়ে যাবে নিজ নিজ গন্তব্যে।

শিক্ষার্থীর কাছে বিশ্ববিদ্যালয় তার দ্বিতীয় পরিবার। কলেজের পর আরো একটি প্রাতিষ্ঠানিক ইতি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশু পালন অনুষদের ৫৫তম ব্যাচ চক্রবৃত্তের শেষ দিনটি ছিল অনন্য সুন্দর।

ভদ্রলোকের ভাষায় এটিকে আজকাল ‘র‌্যাগ ফেস্টিভ্যাল’ বা ‘সাইনিং আউট ডে’ বলা হয়ে থাকে। তবে আমি বলবো ‘ইতি চক্রবৃত্ত পঞ্চান্ন’। সর্বশেষ একাডেমিক (স্নাতক) পরীক্ষার যখন ফর্ম ফিলাম করছিলাম তখন ভাবছিলাম, ‘আহা কি সুন্দর দিন ছিল!’

এইতো সে-দিনই কেবল ভর্তি হতে বেড়িয়ে পড়েছিলাম বাসা ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে। যখন ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছিলাম সেদিন পরীক্ষা দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের দিকে চোখ তুলেও তাকাইনি, ভেবেছিলাম যদি চান্স না পাই তাহলে খারাপ লাগবে। শুনেছিলাম বাকৃবি এক মনোরম সৌন্দর্যের প্রকৃতি কন্যা-স্রষ্টার অনন্য আশীর্বাদ। ভাগ্যের লিখনে লিখা ছিলো বলে চান্স হয়ে যায়। আজ প্রায় সাড়ে ৫বছর পর স্নাতক জীবন শেষ হবার পথে। ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়েছে সেই পুরোনো নোট-বইখাতা, হলের সেই রুম। হঠাৎ আর মোবাইল ফোনের মেমোরিতে থাকা প্রথম সেমিস্টারের ক্লাসের স্মৃতি। সেই দিনগুলোর কথা গুলো দেখলে মনে পরে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকের ক্লাসগুলোর প্রতি এত বেশি আবেগ আর উচ্ছলতা ছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

করোনা মহামারি কারণে অনেকটা সময় পিছিয়ে পরেছিলাম আমরা। প্রাায় দেড় বছর অনলাইনে ক্লাস করেছি কিন্তু পরীক্ষাগুলো বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর হয়েছে। সব কিছু স্বাভাবিক হতে সময় লাগছে ঠিকই তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষ হবার সময় শুরু হয়ে গিয়েছিল। সব কিছু এত দ্রুত শেষ হয়ে গেল যেন পলক খুলতেই আমি আর চক্রবৃত্তে নেই। তবে প্রায়ই মনে পরে সেই ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুদের দুষ্টুমি-খুনসুটিগুলো, আন্দোলন-শোডাউনগুলোতে একসঙ্গে কাটানো সময় আর গানের আসর কিংবা চায়ের আড্ডা। আমি প্রথম বর্ষে যখনই সুযোগ পেতাম তখনই বন্ধু বান্ধবের ক্যান্ডিট ছবি তুলতাম। কেও জিজ্ঞাসা করলে বলতাম, ‘থাকবে একসময় স্মৃতি হয়ে!’

বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি জায়গা যেখানে প্রায় সব রকমেরই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। এখানে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকে, থাকে স্বাদ আহ্লাদের পার্থক্য। এখানে যেমন থাকে নারসিসিস্টদের মারাত্মক টক্সিসিটি তেমনই থাকে এম্পাথিটিকদের বুকভরা স্নেহ ও ভালোবাসা (ভাবার উপায় নেই যেসব নারসিসিস্টই টক্সিক)। সৃষ্টিকর্তা আমার প্রতি অনেক সহানুভূতিশীল বলেই আমার আসে পাশের মানুষদের কাছে অনেক স্নেহ, মায়া, মমতা এবং ভালোবাসা পেয়েছি। আমি বলব আমার ক্লাসের সবাই অত্যন্ত আন্তরিক ও ভালো মনের মানুষ, তাদের নিয়ে আমি খুব গর্ববোধ করি। প্রিয় মানুষগুলোর সাথে সেই সময় কাটানোর মুহূর্ত বা আকাঙ্ক্ষা ইচ্ছাগুলো রয়ে যাবে স্মৃতির পাতায়। আজ থেকে ঠিক ছয়মাস পর কোনো ঝামেলা থাকবে না, সকালে ঘুম থেকে ওঠার যন্ত্রণা থাকবে না, সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ক্লাস, ল্যাবের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা, দেরিতে ব্যবহারিক খাতাণ্ডঅ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ায় শিক্ষকদের ধমক খাওয়া। এসব কিছুই একসময় শুধুই স্মৃতি হয়ে যাবে। ফ্যাকাল্টির ডিপার্টমেন্টগুলো থেকে বনভোজনের উদ্দেশ্যে বাসে চড়ে চিৎকার করতে করতে যাওয়া, কখনো দলবেঁধে ঘুড়তে যাওয়া আর কোনো দিন হবে না। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না, সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে একসময় পৌঁছায়।

চার-পাঁচ বছরের বন্ধুত্ব টিকে থাকুক আজীবন। কর্মজীবন এবং পারিবারিক ব্যস্ততার মাঝেও যেন বন্ধুত্বের বন্ধন ছিন্ন না হয়, এমনটিই প্রত্যাশা। সবার জন্য শুভকামনা রইল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close