মিজানুর রহমান মিজান

  ২৯ নভেম্বর, ২০২২

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩ বছর

সবুজের বুকে সুন্দর মনোরম পরিবেশ, সকাল-সন্ধ্যা কিচিরমিচির পাখির ডাক, অবিরাম বয়ে চলা শান্ত হিমেল হাওয়া, হাজারো বাহারি রঙের ফুলে হেসে ওঠা ফুলেল ক্যাম্পাস বললেই চোখে ভাসে সৌন্দর্যের রানিখ্যাত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) নাম। ক্লান্ত চোখে শান্তি প্রদানকারী নান্দনিক শ্যামল সুন্দর ও বাহারি ফুলের প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। চারদিকে নয়নাভিরাম স্থাপনা ঘিরে রয়েছে শত বৈচিত্র্যপূর্ণ চোখধাঁধানো বৃক্ষ, ফুল-ফল ও ঔষধি গাছ। সেখানেই সব সৌন্দর্যকে নির্মল করে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ (সংক্ষেপে ইবি নামে পরিচিত) স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া নামেই অধিক পরিচিত। বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধর্মের ও বর্ণের দেশি-বিদেশি ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকের সমন্বয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, ব্যবসা প্রশাসন, সামাজিক বিজ্ঞান এবং মানবিক ও কলা অনুষদীয় বিষয়ের পাশাপাশি দেশে শুধুমাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতেই ধর্মতত্ত্ব ও ইসলামী আইনের ওপর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হয়। শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয়টি আর্থিকভাবে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সাহায্যে পরিচালিত হয়ে আসলেও বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে। ইসলামী শিক্ষার উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া জেলায় প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করা হয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৬ সালের ২৮ জুন তাদের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে ৮টি অনুষদের অধীনে ৩৬টি বিভাগ চালু আছে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস জেনে নেওয়া যাক। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একটি ইসলামী বিদ্যাপীঠ স্থাপনের উদ্যোগ অনেক পুরোনো। সর্বপ্রথম ১৯২০ সালে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী চট্টগ্রামের পটিয়ায় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ফান্ড গঠন করেন। ১৯৩৫ সালে মাওলানা শওকত আলি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৪১ সালে মাওলা বক্স কমিটি ইউনিভার্সিটি অব ইসলামিক লার্নিং প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করে। ১৯৪৬-৪৭ সালে সৈয়দ মোয়াজ্জেম উদ্দীন কমিটি এবং ১৯৪৯ সালে মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ কমিটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করে। ১৯৬৩ সালের ৩১ মে ড. এস এম হোসাইনের সভাপতিত্বে ‘ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন’ গঠন করা হয়।

স্ব^াধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার ১ ডিসেম্বর ১৯৭৬ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। ১৯৭৭ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রফেসর এম এ বারীকে সভাপতি করে ৭ সদস্যবিশিষ্ট ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পরিকল্পনা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ২০ অক্টোবর ১৯৭৭ সালে রিপোর্ট পেশ করে। কমিটির সুপারিশে ধর্মতত্ত্ব ও ইসলামি অধ্যয়ন অনুষদের অধীন (১) আল-কুরআন ওয়া উলুমুল কুরআন, (২) উলুমুত তাওহীদ ওয়াদ দা’ওয়াহ, (৩) আল হাদীস ওয়া উলুমুল হাদিস, (৪) আশ-শরিয়াহ ওয়া উসুলুস শরিয়াহ এবং (৫) আল ফালসাফাহ ওয়াত তাসাউফ ওয়াল আখলাক বিভাগ, মানবিক ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধীন (১) আরবি ভাষা ও সাহিত্য, (২) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, (৩) ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, (৪) অর্থনীতি, (৫) লোক প্রশাসন, (৬) তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, (৭) ভাষাতত্ত্ব ও বাণিজ্য বিভাগ এবং বিজ্ঞান অনুষদের অধীন (১) পদার্থ বিজ্ঞান, (২) গণিত, (৩) রসায়ন, (৪) উদ্ভিদবিদ্যা এবং (৫) প্রাণিবিদ্যা বিভাগ প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয়।

৩১ মার্চণ্ড৮ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে মক্কায় ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানদের এক সম্মেলনে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়। এই সুপারিশের ভিত্তিতে ২২ নভেম্বর ১৯৭৯ সালে কুষ্টিয়া শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে ঝিনাইদহ শহর থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের পাশে শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুর নামক স্থানে ১৭৫ একর জমিতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরের বছর ১৯৮০ সালের ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। এরপর ১৯৮১ সালের ৩১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক এ এন এম মমতাজ উদ্দিন চৌধুরীকে প্রথম উপাচার্য নিয়োগ করা হয় এবং দুটি অনুষদের অধীনে চারটি বিভাগে মোট ৩০০ জন ছাত্র নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। এরশাদ সরকার ১৯৮২ সালে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহে নির্মাণ হতে যাওয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ স্থগিত করেন এবং ১৯৮৩ সালের ১৮ জুলাইয়ের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে গাজীপুরের বোর্ড বাজারে স্থানান্তর করেন। কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ শুরু হয় আন্দোলন, এ আন্দোলনে কুষ্টিয়ার বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী নেতা গ্রেপ্ততার হন এবং দীর্ঘদিন কারাবরণ করেন। প্রবল আন্দোলনের এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে ১৯৮৯ সালের ৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৯৯০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এক আদেশে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে গাজীপুর থেকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। তখন শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরে ক্যাম্পাসের কাজ শেষ হয়নি। এজন্য বিকল্প ব্যবস্থায় কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই ভবনে ধর্মতত্ত্ব ও ইসলামি অধ্যয়ন অনুষদ, কুষ্টিয়া মেডিকেল স্কুলে মানবিক ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ এবং শহরের অন্যান্য ভবনে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করা হয়। ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে একযোগে আরো ৫টি নতুন বিভাগ প্রবর্তিত হয়। সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে প্রথমবারের মতো ছাত্রী ও ধর্মণ্ডবর্ণ নির্বিশেষে ছাত্রছাত্রী ভর্তির রেওয়াজ চালু করা হয়। ১৯৯২ সালের ১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ক্যাম্পাস শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়।

১৯৯৩ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানের জন্য এমফিল এবং পিএইচডি কার্যক্রম শুর হয়। ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রচলিত ৩ বছরের পরিবর্তে ৪ বছরের অনার্স কোর্স এবং ২০০৬-২০০৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করা হয়। ১৯৯০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নারী শিক্ষক নিয়োগ ও ১৯৯০-১৯৯১ শিক্ষাবর্ষে প্রথম ছাত্রী ভর্তি করা হয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে শিক্ষার্থী ভর্তি ও শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।

বর্তমান বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার জন্য অন্যতম পছন্দের প্রতিষ্ঠান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এর অন্যতম কারণ শিক্ষার মান ও নজর কাড়া সৌন্দর্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে সামনেই রয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব ম্যুরাল, তার পাশেই রয়েছে মুক্তবাংলা ভাস্কর্য: মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নতুন প্রজন্মের মনে চির জাগরুক রাখতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্মারক ভাস্কর্য ‘মুক্তবাংলা’ আরো রয়েছে, সততা ফোয়ারা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্মৃতিসৌধ, বাংলা মঞ্চ, কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া, মুক্তির আহ্বান ও শাশ্বত মুজিব ম্যুরাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য রয়েছে শরীরচর্চা ও ক্রীড়া বিভাগ, ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর ও স্কাউটস।

এছাড়া ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসহ রয়েছে চিকিৎসা কেন্দ্র, স্টেডিয়াম, জিমনেসিয়াম, প্রেস, কেন্দ্রীয় মসজিদ, শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা।

ক্যাম্পাসের পেছনের দিকে রয়েছে ইবির মফিজ লেক, রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। চারদিকে ফুল ফলের শোভা যেন লেকের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়াও রয়েছে প্যারাডাইস রোড, পেয়ারা তলা, ঝাল চত্বর, ডায়না চত্বর। সময় পেলেই সবাই মেতে ওঠে খেলাধুলা, গান-বাজনা আর হইহুল্লোড়ে। প্রকৃতি আর ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের আবাসিক ছাত্র সিয়াম আহমেদ সিফাত বলেন, যেকোনো সুন্দর জিনিসের প্রতিই সবার ভালো লাগা, ভালোবাসা থাকে। সুন্দরের পূজারী কবি নজরুল থেকে আমি। কম-বেশি সবাই সুন্দরের কাছে মাথা নত করে। আর সে সুন্দর জিনিস বা বস্তুটি যদি হয় সৌন্দর্যের রমনীখ্যাত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ফুলেল কোনো ক্যাম্পাস। তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। আমাদের ভালোবাসা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭৫ একর মাটি।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস ফুল বলেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ সুন্দর ক্যাম্পাস আমাদের মুগ্ধ করে। ১৭৫ একরের এই ক্যাম্পাস লাবণ্য আর মহিমা দেখে সাজানো বিয়ে বাড়ি মনে হয়। সকালে বয়ে চলা হিমেল বাতাসে শান্ত আর বিকালে কিচিরমিচির পাখির ডাকে মন হয়ে ওঠে প্রশান্ত। এই সুন্দর মায়াবী বিশ্বিবদ্যালয় আমাদের শান্তির নীড়। সময়ের সঙ্গে এই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আরো এগিয়ে যাবে। সারা বিশ্বের ইতিহাসে আলো ছড়াবে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close