জাকির হোসেন, সুনামগঞ্জ ও হিমেল আহমেদ, নিকলী (কিশোরগঞ্জ)

  ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

হাওরে কৃষকের স্বস্তি কম্বাইন্ড হারভেস্টার

* উজান থেকে ঢল আসার আগেই ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত কৃষকরা * বোরো মৌসুমের ফসলে নির্ভরশীল সুনামগঞ্জের ২৩ লাখ মানুষ

দেশে হিট অ্যালার্টের পরই সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টির আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। সেখানে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ি ঢলে হাওরে আগাম বন্যা দেখা দেয়। এ ছাড়া ২ থেকে ৫ মে কালবৈশাখীর আশঙ্কা করছেন একজন আবহাওয়াবিদ। এই আগাম বন্যার আশঙ্কায় শ্রমিক সংকটের মধ্যেই সুনামগঞ্জের হাওওে এবং কিশোরগঞ্জের নিকলিতে পুরোদমে শুরু হয়েছে ধান কাটা। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে চাষিরা মাঠে যাচ্ছেন, কাজ করছেন সন্ধ্যা অবধি। তারা উজান থেকে ঢল আসার আগেই এবং প্রবল বৃষ্টি শুরুর আগেই ধান কাটা শেষ করতে চান। এদিকে ধান কাটার শ্রমিক সংকট নিরসনে স্বস্তি এনেছে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন। এই মেশিনে দ্রুত ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাবন্দি করা যাচ্ছে সহজেই।

সুনামগঞ্জ জেলার হাওরে প্রধান ফসল বোরো ধান। একটি মাত্র ফসলের ওপর নির্ভরশীল সুনামগঞ্জের হাওরের ২৩ লাখ মানুষ। এই ফসলের ওপর নির্ভর করে তাদের সারা বছরের খোরাক আর বেঁচে থাকার স্বপ্ন। এদিকে, বোরো ফসল স্বস্তিতে ঘরে তোলার জন্য সরকারের পক্ষ থেকেও নেওয়া হয়েছে নানা প্রকল্প। ফসলরক্ষা বাঁধ থেকে শুরু করে ধান কাটা ও মাড়াই করার জন্য উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে হাওরে। প্রতি বছরই আগাম বন্যার আশঙ্কা সঙ্গে থাকে শ্রমিক সংকট। এসব সংকট নিরসনের জন্য দ্রুত ধান কাটা ও মাড়াই করার জন্য কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন ব্যাপক সাফল্য এনে দিয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সরকারের ভর্তুকিতে হাওরের জন্য দেওয়া হয়েছে দ্রুত সময়ে ধান কাটার ১ হাজার কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন। এছাড়া আরো ২ শতাধিক রিপার মেশিন হাওরের কৃষকদের সহায়ক হিসেবে কাজ করছে ফসলের মাঠে। এছাড়া দুই লাখ শ্রমিক ধান কাটার কাজ করছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলায় গত বুধবার পর্যন্ত ধান উঁচু এবং নিচু এলাকা মিলে পাকা ধান কাটা হয়েছে গড়ে ৪৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এর মধ্যে উঁচু হাওরে ৪৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং নিচু হাওরে ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ।

১ হাজার কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন, ২ শতাধিক রিপার মেশিন ও ২ লাখ শ্রমিক ধান কাটা সত্ত্বেও শ্রমিক সংকট নিরসন হচ্ছে না। জেলার বৃহৎ বৃহৎ হাওরের জন্য যে পরিমাণ কম্বাইন্ড হারভেস্টার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তাতে অনেক জমির মালিককে মেশিনের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ফলে ধান কাটা পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কৃষকরা জানিয়েছেন, এসব কম্বাইন্ড হারভেস্টারগুলো হাওরের উঁচু জমির ধান কাটতে পারলেও হাওরের তলদেশের নিচু জমির ধান কাটতে পারছে না। কারণ নিচু জমিতে এখনো হাওরের পানি জমে আছে। পানি জমে থাকা এসব জমিতে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন চলতে পারে না। ফলে সেখানে সনাতন পদ্ধতিতেই ধান কাটতে হয়। হাওরের উঁচু অংশের জমিতে কম সময়ের মধ্যে ধান কাটা সম্ভব হলেও হাওরের তলদেশের নিচু জমির ধান কাটতে দেরি হচ্ছে। আগামীতে কৃষিকে আরো আধুনিক করতে কৃষকদের বেশি করে যান্ত্রিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনার জন্য দাবি করেছেন কৃষকরা।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার দেখার হাওর পাড়ের কৃষক আবদুল মনাফ বলেন, গত কয়েক দিন আগে একটানা দুদিন বৃষ্টিপাত হওয়ার ফলে আমাদের এলাকার জমিতে পানি জমে আছে। এসব জলাবদ্ধ জমিতে চাইলে মেশিন দিয়ে ধান কাটা যাচ্ছে না। তাই আমরা নিজেরাই বাড়তি টাকা দিয়ে শ্রমিক নিয়ে ধান কাটছি।

দেখার হাওর পাড়ের দরিয়াবাজ গ্রামের কৃষক আবদুল হেকিম বলেন, হারভেস্টার মেশিন কৃষকদের জন্য খুবই উপকারী। যেহেতু হাওরে সামান্য বৃষ্টি হলেই জমিতে পানি জমে যায়। পানি জমে থাকা জমির ধান কাটতে পারে এমন মেশিন আমাদের দরকার।

প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষকদের জন্য অনেকটা সহজলভ্য হয়েছে। যেখানে বিগত ৫ বছর আগেও জেলার বাইরে থেকে হাজার হাজার শ্রমিক আসত ধান কাটার জন্য। সেখানে বর্তমানে এই কম্বাইন্ড হারভেস্টারের কারণে বাইরের শ্রমিক আর লাগছে না। একদিকে ধান কাটা, অন্যদিকে ধান মাড়াই করার কাজ এক মেশিনেই করা যাচ্ছে। এতে খুশি হাওরবাসী।

কৃষকদের দাবি-অধিকার আদায়কারী সংগঠন ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলনে’র সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক মিলন জানালেন, আমাদের হাওর এলাকার জন্য এই কম্বাইন্ড হারভেস্টার অত্যন্ত উপকারী। যেহেতু আমরা সীমান্তের কাছের জেলা। এই সময় ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হলেই আগাম বন্যা দেখা দেয়। সেই বন্যার কবল থেকে ফসল রক্ষার জন্য দ্রুত ধান কাটার জন্য এই মেশিন আমাদের হাওরের জন্য আশির্বাদ।

গত শুক্রবার সুনামগঞ্জের হওরে ধান কাটা উদ্ধোধন ও কম্বাউন্ড হারভেস্টার বিতরণ করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুস শহীদ। এ সময় তিনি বলেন, হারভেস্টার মেশিন সংকট বা এসব মেশিন বিকল হয়ে গেলে আমাদের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা আছেন, তাদের কাছে সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন। যদি তারা কোনো কাজ না করে সংসদ সদস্যের মাধ্যমে আমার কাছে অভিযোগ করবেন। সরকার কৃষকদের সুবিধার জন্য সবকিছু করবে বলে তিনি জানান।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, পুরো জেলার সব হাওরে আমাদের কৃষি কর্মকর্তারা এখন মাঠে আছেন। যেকোনো ধরনের সমস্য তারা দেখছেন। যেখানে শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটতে সমস্যা হচ্ছে, সেখানে সঙ্গে সঙ্গে হারভেস্টার মেশিন পাঠানো হচ্ছে। তিনি বলেন, কম্বাইন্ড হারভেস্টারের সফলতায় এবার দ্রুত সময়ের মধ্যে ধান কাটা যাচ্ছে। আগামী ৫ মের মধ্যে ৯৫ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে এবং ১৫ মের মধ্যে শতভাগ ধান কাটা শেষ হবে বলে জানান তিনি।

জেলায় এবার বোরো চাষাবাদ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধান ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২০২ টন। চাল ৯ লাখ ১৩ হাজার ৪৬৮ টন। টাকার অঙ্কে ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকার চাল উৎপাদন হবে এই জেলায়।

নিকলী (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের নিকলীকে হাওর বাংলার প্রবেশদ্বার বলা হয়। এককালে পাট উৎপাদন ও ব্যবসায়ের জন্য খ্যাতি ছিল। ধান ও মাছের জন্য ও সুনাম আছে নিকলীর হাওরের। এখানে চলতি মৌসুমে প্রায় ১৪ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদ করা হয়েছে। এই বিশাল পরিমাণ জমির ফসল শ্রমিক দিয়ে কাটালে বিপুল অর্থ এবং সময় সাপেক্ষ।

প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধান কাটা শ্রমিক নিকলী হাওরে এলেও এবার সেই সংখ্যা অনেক কম। যার ফলে শ্রমিকের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে ধান কাটা ও মাড়াই করার জন্য স্থানীয় শ্রমিকরা দৈনিক মাথা পিছু ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা হাকিয়ে থাকেন।

গত বছর শ্রমিক দিয়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকায় প্রতি একর জমির ধান কাটাতে খরচ হলেও এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণে। শ্রমিকের বাড়তি মজুরির কারণে ধান কাটা ও মাড়াই নিয়ে দুশ্চিন্তার ভাজ কৃষকের কপালে।

এদিকে কৃষকদের আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে উৎসাহিত করতে কাজ করে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ। কৃষকদের আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে উৎসাহিত করতে ও তাদের উৎপাদন খরচ কমাতে সরকার হাওরাঞ্চলে ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে কম্বাইন্ড হারভেস্টার, রিপার মেশিনসহ ইত্যাদি যন্ত্রপাতি বিতরণ করেছেন।

শ্রমিক দিয়ে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের চেয়ে সময় এবং খরচ কম হওয়ায়, দিন দিন এ হারভেস্টার মেশিনের ব্যবহার বাড়ছে। হারভেস্টার মেশিন দিয়ে বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কৃষকরা। চাহিদা বেশি থাকায় আরো মেশিন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে কৃষকরা। এতে শ্রমিক সংকট কাটিয়ে ওঠে কম সময়ে ফসল ঘরে তুলতে পারছেন তেমনি উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।

উপজেলার কামালপুর গ্রামের কৃষক মো. কামরুল হাসান বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে হাওরের জমিগুলোয় ধান হয়েছে প্রচুর। কিন্তু শ্রমিক সংকট ও বাড়তি মজুরির কারণে মাঠ থেকে ধান ঘরে তোলা নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। হারভেস্টার মেশিন পাওয়ায় সে দুশ্চিন্তা যেমন দূর হয়েছে তেমনি দ্রুত সময়ের মধ্যে ধান কেটে ঘরে তুলতে পেরেছি। পাশাপাশি খরচও অর্ধেক লাগছে। যেখানে শ্রমিক দিয়ে এক একর জমির ধান কাটতে লাগছে ১৮-২০ হাজার টাকা, সেখানে মেশিন দিয়ে ধান কাটতে লাগছে ৬-৭ হাজার টাকা।

হারভেস্টার মেশিনের মালিক উপজেলার দামপাড়া ইউনিয়নের মো. মোর্শেদ আলী (বাবুল) বলেন, এ মেশিন দিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে অধিক পরিমাণ জমির ধান কাটা ও মাড়াই করা যায়। মেশিনের মাধ্যমে ধান কাটলে কৃষকের অনেক টাকা সাশ্রয় হয়। খোলা থেকে জমির দূরত্ব ভেদে হারভেস্টার মেশিনে একর প্রতি জমির ধান কাটতে পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। তিনি আরো জানান, শ্রমিক দিয়ে ধান কাটলে ১৮-২০ হাজার টাকা লাগে। এতে সময় যেমন বেশি লাগে, তেমনি বাড়তি খরচের কারণে কৃষক লাভবান হতে পারেন না। নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নিকলী উপজেলায় মোট ৫২টি হারভেস্ট মেশিন থাকলেও বর্তমানে ৪০টি মেশিন সচল রয়েছে। এ ছাড়া আশপাশের জেলা উপজেলা থেকেও অনেক হারভেস্ট মেশিন নিকলীতে এসেছে ধান কাটার জন্য। জমিতে ৮০ শতাংশ ধান পাকলে দ্রুত কাটার জন্য কৃষকদের তাগিদ দিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close