মেহেদী হাসান

  ২৬ মার্চ, ২০২৪

পেঁয়াজের বাজার ফের গরম

ভারত থেকে আমদানি বন্ধের খবরে দেশের বাজারে ফের বেড়ে গেছে পেঁয়াজের দাম। গতকাল সোমবার রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দুদিন আগের তুলনায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ পাইকারিতে বেড়েছে ১০ থেকে ১২ এবং খুচরায় বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় থাকা বাংলাদেশ পণ্যটি আমদানিতেও রয়েছে ১ নম্বরে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় এ আমদানিনির্ভরতা। আর সেই সুযোগে সরবরাহ চেইনে সামান্য কমবেশি হলেই সুযোগ নেয় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের বাজারে পেঁয়াজের ঘাটতি নেই। তবে চাহিদা বাড়ায় দামের ওপর প্রভাব পড়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, ২০২২ সালে ৭ লাখ ২৭ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করে বাংলাদেশ। ওই বছর বিশ্বের আর কোনো দেশ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি করেনি। ২০২৩ সালের ১১ মাসে পেঁয়াজের আমদানি হয় ৮ লাখ ৬৪ হাজার টন। আবার জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। তথ্যমতে, দেশে পেঁয়াজের নিট উৎপাদন ২২ লাখ থেকে ২৩ লাখ টন। অন্যদিকে চাহিদা রয়েছে ৩০ লাখ থেকে ৩২ লাখ টন। তাই অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানির পরও চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।

ভারত বিদায়ি ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর এক ঘোষণায় পেঁয়াজ রপ্তানি চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে। এতে ওইসময় দাম বেড়ে গিয়ে ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে দাঁড়ায়। রমজান উপলক্ষে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে ও দামের ঊর্ধ্বগতি রোধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতকে অনুরোধ জানালে, তাতে সাড়া দেয় দেশটি। এরপর ২ মার্চ ভারত থেকে ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি পায় বাংলাদেশ। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভারতীয় রপ্তানিকারকরা ৩১ মার্চ পর্যন্ত এ পেঁয়াজ বাংলাদেশে রপ্তানি করবে। অথচ গত রবিবার ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, তা অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়িয়েছে। এরই ফল হিসেবে রাতারাতি বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।

সোমবার রাজধানীর কারওয়ানবাজার, মগবাজার, মহাখালী কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। অথচ গত সপ্তাহজুড়ে পেঁয়াজের কেজি ৫০ থেকে ৫৫ টাকার মধ্যে ছিল। অর্থাৎ এক রাতের ব্যবধানে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের বাজার চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জেও কেজিপ্রতি ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। রবিবার কেজিপ্রতি দেশীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা থেকে ৭২ টাকা, যা গত শুক্র ও শনিবার বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৫২ টাকা থেকে ৫৮ টাকার মধ্যে।

খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশে এখনো পেঁয়াজের সংকট নেই। আমদানি ও দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের বিশাল মজুদ রয়েছে বিভিন্ন গুদামে। স্বল্পসময়ের জন্য মজুদ করলেও তা প্রভাব ফেলে বাজারে। ব্যবসায়ীদের হিসাবে, বর্তমানে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে প্রায় ৩৬ লাখ টন। তবে সরকারি হিসাবে ২৫ লাখ টনের কিছু বেশি। সে হিসাবে এক দিনে দেশের বাজারে গড়ে প্রায় ৯০ থেকে ৯৮ লাখ কেজি পেঁয়াজের লেনদেন হয়। ফলে প্রায় ১ লাখ কেজি পেঁয়াজ বাজারে কমবেশি করতে পারলেই দাম ওঠানামা করানো যায়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে প্রতি বছর ২৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। দেশি উৎপাদনের পাশাপাশি প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৬ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ হয় প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে এবং উৎপাদন হয় প্রায় ৮ লাখ টন। এ মুড়িকাটা ও গ্রীষ্মকালীন নতুন পেঁয়াজ খেত থেকে তোলা ও বাজারে আসতে শুরু করলে দাম কমে।

২০১১-১২ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ১০-১১ বছরে পেঁয়াজ উৎপাদিত জমির পরিমাণ ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে প্রায় ১৯ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৪ লাখ ৬০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৬ লাখ টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ এ উৎপাদিত পেঁয়াজের অন্তত ৩০ শতাংশ প্রায় অর্থাৎ ১০ থেকে ১১ লাখ টন পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ার কারণে উৎপাদন থেকে কমে নিট উৎপাদন দাঁড়ায় প্রায় ২২ থেকে ২৩ টন। আমাদের চাহিদা ৩০ থেকে ৩২ লাখ টন। বিপরীতে এ ১০ থেকে ১১ লাখ টন আমদানি করে মেটানো হয়।

পেঁয়াজ আমদানির উপযুক্ত সময় নির্বাচনে কৃষক ও আমদানি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতনৈক্যে লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষকদের কারণ নিয়ন্ত্রণ সিন্ডিকেটের হাতে। তবে পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে মৌসুমে ৬ মাস আমদানি বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন মসলাজাতীয় ফসলের গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পের পরিচালক ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার।

প্রতিদিনের সংবাদকে তিনি বলেন, দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন যে হারে বাড়ছে, তাতে পেঁয়াজ আমদানি বছরে ৬ মাস বন্ধ রাখা উচিত। অন্যথায় কৃষকরা ভালো দাম পাবেন না। যখন কৃষকের পেঁয়াজ ঘরে আসে, তখন বাজারে আমদানি বাড়ে; সিন্ডিকেট পেঁয়াজের দাম কমিয়ে দেয়। অতিপ্রয়োজনে যখন কৃষকের পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হয়, তখন সুযোগ নেয় সিন্ডিকেট। পরে বাজার নিয়ন্ত্রণ হয় তাদের হাতে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, দেশে ১ লাখের মতো পেঁয়াজ বিক্রেতা রয়েছে। তারা সিন্ডিকেট নয়। তবে কিনতে সিন্ডিকেট থাকতে পারে। আমদানি বন্ধের কারণে সরবরাহ সংকট দেখা দেয়। আর সরবরাহ সংকটের কারণে দাম বাড়ে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close