মো. শাহ আলম, খুলনা

  ২২ জানুয়ারি, ২০২৪

খুলনায় ওএমএস নিয়ে নয়ছয়

খুলনা মহানগরীতে ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) কার্যক্রমে চাল ও আটা বিতরণে অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এ কারণে অভিযুক্ত ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে খাদ্য অধিদপ্তর। গত ৮ জানুয়ারি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বরাবর ১৪ দফা সুপারিশ পাঠানো হয়। অধিদপ্তরের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত পত্রে অভিযুক্ত ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এতে নড়েচড়ে বসেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এর আগে খুলনা নগরীতে ওএমএস কার্যক্রমে চাল ও আটা বিতরণে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিষয়ে প্রাপ্ত অভিযোগ তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করে। তদন্ত কমিটি সার্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করে তদন্ত প্রতিবেদনে কয়েকটি বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করে। খুলনা মহানগরীতে ওএসএম বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে প্রভাবশালী ডিলাররা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করে না। অধিকাংশ কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করেই চলছে।

অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মেসার্স আশা ফ্লাওয়ার মিলের উৎপাদিত আটার বস্তায় তাদের মিলের নাম মুদ্রিত না থাকায় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত গম বরাদ্দ ও চাহিদাপত্র প্রেরণ স্থগিত করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো হলো- ‘মেসার্স শিকদার স্টোর’ নামক দোকানটির কার্যক্রম টিবি ক্রস রোডের পরিবর্তে কেন ও কত দিন ধরে রূপসা স্ট্যান্ড এলাকায় পরিচালিত হচ্ছে, এতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি আছে কি না তা যাচাই করে অবহিতকরণ, মেসার্স শিকদার স্টোরের ভেতরে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও পরিদর্শনের দিন ছয় বস্তা চাল কম পাওয়ায় কারণ দর্শানোসহ তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ।

সুপারিশে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, পরিদর্শনকালে পরিদর্শক দলকে অসহযোগিতা ও অসদাচরণের কারণে ‘মেসার্স পলাশ এন্টারপ্রাইজ’-এর কাছে ব্যাখ্যা তলব, ডিলারশিপ স্থগিত/বাতিলকরণসহ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ, কোনো অচল বন্ধ ময়দার মিলে যাতে গম বরাদ্দ না হয়, তা নিশ্চিতে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃক মিলগুলো নিয়মিত পরিদর্শনকরণ, প্রত্যেক ওএমএস কেন্দ্রের বিক্রয় দিবসের চাল ও আটার পৃথক মাস্টাররোল জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে সংরক্ষণ ও যথাযথভাবে যাচাইপূর্বক পরবর্তী বরাদ্দ আদেশ প্রদান, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃক নির্ধারিত এলএসডি/সিএসডিতে ময়দা মিল কর্তৃক উৎপাদিত আটা সংরক্ষণ, ডিলার কর্তৃক সেখান থেকে তা উত্তোলন ও এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় রেকর্ড পত্রাদি পরিপালন, ওএমএস কেন্দ্রগুলো চাল ও আটা বিক্রয় চলাকালীন তদারককারীদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ, যেসব ওএমএস কেন্দ্রে ডিলারের প্রতিনিধি কর্তৃক দোকান পরিচালিত হয় সেসব কেন্দ্রে প্রতিনিধির প্রাধিকারপত্র সংরক্ষণ, উৎপাদিত আটার মান যাচাই কমিটি কর্তৃক প্রত্যেকটি ময়দা মিলের মান যাচাই প্রতিবেদন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, সব ওএমএস কেন্দ্রে ডিলার কর্তৃক ডিওর কপি সংরক্ষণ, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃক নিয়মিত ওএমএস কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন ও পরিদর্শন প্রতিবেদন আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে প্রেরণ, যেসব বিক্রয়কেন্দ্রে ভোক্তাদের ভিড় বেশি সেসব কেন্দ্রে শৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা গ্রহণ।

উল্লিখিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে খাদ্য অধিদপ্তরকে অবহিত করার জন্যও নির্দেশনা প্রদান করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ওএমএস ডিলারদের নিম্নমানের আটা সরবরাহের কারণে মেসার্স আশা ফ্লাওয়ার মিলের মালিক আসলামকে একাধিকবার সতর্ক করা হয়। কিন্তু তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি। উপরন্তু ২০১২ সালে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। এমনকি তাকে সতর্ক করায় তৎকালীন আরসি ফুড রোকা মিয়া ও ডিসি ফুড সুধাংশু হালদারের বিরুদ্ধে মামলাও করেন আশা ফুডের মালিক আসলাম। যার কারণে তার মিল স্থায়ীভাবে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। তবে দীর্ঘদিন পর ২০১৯ সালে খাদ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তার মধ্যস্থতায় পুনরায় বরাদ্দ পান তিনি। অথচ তার নিজস্ব কোনো মিল নেই। এনকে ফুড নামে একটি মিলে আশা ফুডের সাইনবোর্ড টানিয়ে বছরের পর বছর বরাদ্দ তুলে নিচ্ছেন তিনি। এছাড়া সম্প্রতি মেসার্স আশা ফ্লাওয়ার মিলের মালিক আসলাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তার ওপর চড়াও হন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীতে বর্তমানে ৯৬ জন ওএমএস ডিলার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ডিলাররা পর্যায়ক্রমে নগরীর ৩১টি ওয়ার্ডের ২৪টি পয়েন্টে খোলা বাজারে সরকারি চাল ও আটা বিক্রি করে থাকেন। আর ডিলারদের মনিটরিংয়ের জন্য জেলা খাদ্য দপ্তরের দুজন নগর পরিদর্শক এবং ডিলার পয়েন্টে নজরদারির জন্য ৩০-৩৫ জনের মতো খাদ্য বিভাগীয় তদারক কর্মকর্তা রয়েছেন। যারাও পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

অভিযোগ রয়েছে, ওএমএস ডিলারদের মধ্যে অনেকেই যথাযথ প্রক্রিয়ায় কার্যক্রম পরিচালনা করেন না। বিশেষ করে জনপ্রতি নির্ধারিত পরিমানে চাল-আটা বিক্রি না করে অধিক মূল্যে বস্তা ধরে কালো বাজারে বিক্রি করেন। এছাড়া অনেকেই বিক্রির গ্রাহক তালিকা (রোস্টার) নিজেরাই মনগড়া নাম দিয়ে তৈরি করেন। বিশেষ করে নামে-বেনামে থাকা একাধিক ডিলারশিপের মালিকদের বিরুদ্ধে উল্লিখিত অভিযোগের মাত্রা বেশি।

আরো অভিযোগ রয়েছে, ওএমএস ডিলারদের নজরদারি ও কালোবাজারি রোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট খাদ্য পরিদর্শকরা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন না। তারা ডিলার পয়েন্টে গিয়ে নামমাত্র হাজিরা দিয়ে ‘সালামি’ নিতে ভুল করেন না। ডিলারদের সঙ্গে পরিদর্শকদের অলিখিত ‘লেনদেন’ চুক্তির মধ্য দিয়েই চলছে অনিয়ম। ফলে পরিদর্শকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ওএমএস ডিলাররা বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম করছেন।

এ বিষয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. তাজুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, খাদ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী ‘মেসার্স শিকদার স্টোর’ ও ‘মেসার্স পলাশ এন্টারপ্রাইজের দুজন ডিলারকে শোকজ করে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। তারা এখনো জবাব দেননি। এছাড়া আশা ফ্লাওয়ার মিলের বরাদ্দ প্রদানও বন্ধ করা হয়েছে। অন্যান্য নির্দেশনাগুলোও যথাযথভাবে পরিপালন করা হচ্ছে। উল্লিখিত বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মৌখিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নিজের ব্যস্ততার কারণে সবদিকে নজর দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে হাতে-নাতে অভিযোগের প্রমাণ পেলে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্টদের কঠোরভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close