নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৮ জুন, ২০২২

বাইকাররা বেপরোয়া

* নজরদারির ঘাটতি * সড়কে বিশৃঙ্খলা

রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন মোটরসাইকেল-চালক বা বাইকাররা। তারা রাইড শেয়ারিংয়ের নামে সড়কে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ পথচারীদের।

আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নজরদারির ঘাটতি, বিআরটিএর প্রযুক্তির ব্যবহারে অদক্ষতার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া বেশি চার্জ আদায় করা যাত্রী হয়রানিরও অভিযোগ রয়েছে। এসব অব্যবস্থাপনার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তি সেবা গ্রাহক স্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজধানীতে রাইড শেয়ারিং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে চলে না, চলে খ্যাপে। প্রযুক্তি সেবায় নিয়ন্ত্রণ নেই ফলে সড়কে আছে নৈরাজ্য। বিশ্বের বহু দেশে ইন্টারনেটভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস চালু করে ব্যক্তিগত মোটরযান ভাড়ায় যাত্রী পরিবহনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে।

মহিউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, এটি এমন একটি পরিবহন ব্যবস্থা, যেখানে গাড়ির মালিক তার নিজের প্রয়োজন মিটিয়েও ইন্টারনেটের মাধ্যমে একটি স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করে অনলাইন অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত মোটরযান ভাড়ায় ব্যবহার করতে পারেন। এর মাধ্যমে মোটরযানের সংখ্যা কমিয়ে আনাই অন্যতম উদ্দেশ্য বাংলাদেশ সরকারের। সরকার রাইড শেয়ারিং নীতিমালা ২০১৭ প্রণয়ন করে, যা ২০১৮ সালে পাস হয়। এতে পরিবহনের সংখ্যা কমার চেয়ে উল্টো পরিবহনের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, সড়কে বেড়েছে নৈরাজ্য, বেড়েছে দুর্ঘটনা। মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে পরিচালিত এ সেবা প্রদানের জন্য সর্বপ্রথমে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ কর্তৃক এনলিস্টেড হতে হয়। সেখানে সে কী পরিমাণ গাড়িচালক ও গাড়ি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে সেবা প্রদান করবে তার যাবতীয় তথ্য গাড়ির লাইসেন্স ড্রাইভিং, লাইসেন্সসহ যাবতীয় তথ্যাদি জমা দিতে হয়। তবে ভাড়ার পরিমাণ নির্ধারিত করে দেওয়া হয় বিআরটিএ থেকে। কিন্তু প্রথম প্রথম মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে চললেও বর্তমান সময়ে অ্যাপভিত্তিক সেবা আর চলে না। চলে চুক্তিভিত্তিক খ্যাপের মাধ্যমে। এখন আর সড়কে বোঝা যায় না, কোনটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে চলে আর কোনটি ছিনতাইকারী ডাকাত দল বা ব্যক্তিগত কর্মজীবী মানুষের পরিবহন।

বিআরটিএর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় বর্তমানে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৫ লাখ ৮৪ হাজার ৪৯০টি। এ সেবাকে অতি মুনাফার পেশা হিসেবে নিয়েছে এক শ্রেণির লোক। কিন্তু বিআরটিএ থেকে অ্যাপভিত্তিক সেবা দেওয়ার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান এনলিস্টমেন্ট নিয়েছে, তাদের দুর্বলতা, অতি মুনাফা, সেবা প্রদানে অনাগ্রহ, মনিটরিংয়ের অভাবে আজ প্রযুক্তি সেবা মুখথুবড়ে পড়েছে। সরকারও এ খাত থেকে রাজস্ব হারাচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশে যেসব রাইড শেয়ারিং এনলিস্টেড হয়েছে, এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রাইড শেয়ারিং অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠান উবারের প্রায় এক লাখ চালক রাজধানীতে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকায় আরেকটি জনপ্রিয় বাইক রাইডিং পাঠাওয়ের আছে প্রায় দেড় লাখের বেশি রাইডার। এ ছাড়াও রাজধানীতে সহজ ডটকম, স্যাম, ওভাই, ওবোন ইত্যাদির আওতায় আছে আরো প্রায় ৫০ হাজার রেজিস্ট্রার্ড বাইক।

এ হিসাবে রাজধানীতে মোট রেজিস্টার্ড বাইকারের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। তবে এ রাইডারদের অনেকেই একসঙ্গে কয়েকটি অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত। এ ৩ লাখ বাইকাররা বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে গাড়ি চালান দৈনিক ৬-১০ ঘণ্টা। দ্বৈত লাইসেন্সধারীদের বাদ দিয়ে মোট রাইডারের সংখ্যার হিসেবে ১ লাখ ২৩ হাজার রাইডার ৫ ঘণ্টা বা বেশি সময় বাইক চালান। তাদের আয়ের প্রধান উৎস বাইক রাইডিং।

মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, প্রায় ৪ লাখ চালক অ্যাপভিত্তিক পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত নয়। এ চালকদের চিহ্নিতকরণের জন্য নেই আলাদা পোশাক, নেই প্রশিক্ষণ। তাদের মনিটরিংয়ে সবার আগে বিআরটিএকে প্রযুক্তিবান্ধব হয়ে অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি মোটরসাইকেল চালকদের উন্নত প্রশিক্ষণ, শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে রাস্তায় চলা এবং প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে সরকার পাবে রাজস্ব, সড়কে শৃঙ্খলার পাশাপাশি যাত্রীরা পাবেন নিরাপত্তামূলক সেবা।

এদিকে, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বহু বছর ধরে কাজ করছেন চলচ্চিত্র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন, যিনি নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন।

ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘বাইক দুর্ঘটনা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন ২০১৬ সাল থেকে। আমরা যে রিপোর্ট করি সেখানে বলে আসছি যে, মোটরসাইকেলকে যদি নিয়ন্ত্রণে না রাখা যায় তাহলে এটা আমাদের জন্য ভয়াবহতা ডেকে নিয়ে আসবে। ২০১৬ সালে বিআরটি-এর তথ্য অনুযায়ী দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল সাত লাখ। সেটা বর্তমানে ৩০ লাখের ওপরে। এই মোটরসাইকেল যারা চালাচ্ছে তারা অন্যান্য যানবাহনের চালকদের মত কোনো ট্রেনিং ইনিস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে না। কোনো রকমে একটা লাইসেন্স জোগাড় করে বা না করে তা চালাচ্ছে।

ইলিয়াস কাঞ্চন আরো বলেন, সড়কে যাত্রী, চালক, সাধারণ পথচারী যদি সড়কের নিয়ম না জানে-না মানে তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটাবেই। মোটরবাইক চালানোর জন্য যে জ্ঞানের প্রয়োজন অনেকেরই সেটা নেই। তারা ভাবে যেহেতু সাইকেল চালাতে পারে, মোটরসাইকেল তার জন্য কোনো ব্যাপারই না। বেশিরভাগ চালক কিছুই মানতে চায় না। তারা একটু ফাঁক পেলেই সেখান দিয়ে চলে যেতে চায়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) বলছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এআরআই আরো বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যেমন ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ছিল সাড়ে ২২ শতাংশ। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২০ সালে পথচারী মৃত্যুর হার ছিল ২৯ দশমিক ৯। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৬ শতাংশ। সামগ্রিক বিবেচনায় আগের বছরের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ৫ শতাংশ বেড়েছে।

এআরআইর পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ২০১৫ সালে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় সড়ক নিরাপদ করতে গণপরিবহনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনার প্রবণতা অনেকটা নিম্নমুখী ছিল। দুঃখজনক হচ্ছে, ২০১৭ সালে রাইড শেয়ারিং নীতিমালা তৈরি করা হয়। তারপর গত পাঁচ বছরে ঢাকা শহরে মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখে দাঁড়িয়েছে। পুরো যুক্তরাষ্ট্রেও ১০ লাখ মোটরসাইকেল চলে না।

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ‘দেশে এখন ৩২ লাখের মতো মোটরসাইকেল নিবন্ধিত আছে; অর্থাৎ গণপরিবহনের যে কথা আমরা বলছি, সেই ভারসাম্য অবস্থা এখন আর নেই। অবকাঠামোগত দুর্বলতা থাকার পরও কিছু নীতিগত দুর্বলতা হুটহাট করে নিয়ে ফেলছি। এটা অনেকটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close