নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৯ মে, ২০২২

মত গবেষকের

ভোজ্য তেল সংকটের উৎস খোঁজা জরুরি

‘প্রাইস ট্যাগ’ মুছে বেশি দামে বিক্রি

দেশে গত ১ বছরে ভোজ্য তেল আমদানি হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টন। যার মধ্যে রমজানকে কেন্দ্র করেই আনা হয়েছে প্রায় ৮ লাখ টন। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে বাড়ানো হয়েছে দামও। তারপরও বাজার থেকে হাওয়া সয়াবিন ও পাম তেল। এই পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তেল গায়েব হয়ে যাওয়ার উৎস খুঁজে বের করা বাঞ্ছনীয়। আর বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দামের রেকর্ড হওয়ার কারণেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। তবে বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া পাম তেলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরই সমন্বয় করলে হুট করে লিটারে ৩৮ টাকা বাড়তি দেওয়ার ধাক্কা গ্রাহকদের ওপর পড়তো না বলে মনে করেন গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, যে দাম ঠিক করা হয়েছে সেই দামেও যেন অন্তত মানুষ তেল পায় সেটা নিশ্চিত করাই হবে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল। আমদানি করা তেল যেন বাজারে থাকে এবং মানুষ যেন পায় সেটা প্রতিটি পর্যায়ে নজরদারির মাধ্যমে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে দ্রুত পণ্য বাজারে আনাও নিশ্চিত করতে হবে। সরবরাহ ঠিক থাকলে কেউ অযাচিতভাবে দাম বাড়াতে পারবে না। যদিও ব্যবসায়ী এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

তবে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ঈদে মানুষের ব্যয়ের কথা চিন্তা করে ঈদের আগে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব সরকার অনুমোদন করেনি। যদিও আগেই বেশি দামে বিশ্ববাজার থেকে তেল সংগ্রহ করতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের।

গেল এপ্রিল পর্যন্ত ১ বছরে দেশে ভোজ্য তেল আমদানি হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টন। এর মধ্যে ৭ লাখ ৮০ হাজার টন আসে গেল ৪ মাসে। এছাড়া ঈদের আগমুহূর্তে মের শুরুতে আসে আরো প্রায় সাড়ে ৪৭ হাজার টন। দেশে মাসে ভোজ্য তেলের চাহিদা প্রায় ২ লাখ টন। যা কিছুটা বাড়ে রমজান মাসে। সবমিলিয়ে চাহিদার তুলনায় অধিক আমদানি এবং শুল্কহার হ্রাসের পরও বাজারে তেলের সরবরাহে বিশাল ঘাটতি আর দামের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনার মো. ফখরুল আলম বলেন, বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার চিনি ও ভোজ্য তেলের দাম কমিয়েছে। একই সঙ্গে প্রত্যাহার করা হয়েছে শুল্কহারও। গেজেট প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর হয়।

তবে মিল মালিকদের দাবি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে তেলের আন্তর্জাতিক বাজার অস্থির। যুদ্ধের আগে টনপ্রতি দাম ১৬০০ ডলার থাকলেও সম্প্রতি তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৫০ ডলারে। এমন বাস্তবতায় দেশে বোতল জাত তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। তবে দাম বাড়িয়েও তেলের হাহাকার কেন, তার কোনো সদুত্তর নেই কারো কাছে।

সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, বাজারে তেল আছে। কিন্তু দাম ঠিক হলেই তারা তেল ছাড়বে। অনেক প্রতিষ্ঠান তেল আমদানি করেছে।

এদিকে, রাজধানীর পলাশী বাজারে ভোজ্য তেলের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিলেন রুবেল। বাজারের দোতলায় ৪-৫টি দোকানে খোঁজার পর এক দোকানি তেল বিক্রি করতে রাজি হলেন। বোতলজাত আধ লিটার তেলের দাম নেওয়া হলো ৯০ টাকা। তবে তেলের বোতলে থাকা কোম্পানির ‘প্রাইস ট্যাগ’ ঘষে মুছে ফেলা হয়েছে।

দোকানি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার থেকে ঈদের আগে বেশি দামে তেল কিনতে হয়েছে। তাই কিছুটা লাভ ধরে বিক্রি করছি। আর কেনার সময়ই প্রাইস ট্যাগ মুছে দেওয়া অবস্থায় পেয়েছি আমরা। বাজারে ভোজ্য তেল নেই। ক্রেতা ধরে রাখতেই বেশি দামে তেল এনে বিক্রি করছি। এক্ষেত্রে আমার কোনো দায় নেই।’

তবে অন্য দোকানিরা অভিযোগ করেন, কোনো কোনো দোকানে আগের দামে কেনা তেল মজুদ করে রেখে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য সচিবের সঙ্গে মিল মালিকদের বৈঠকের পর সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম নির্ধারণ করে সরকার। সে অনুযায়ী ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯৮ ও খোলা প্রতি লিটার ১৮০ টাকায় বিক্রি হবে। আর পাম অয়েল বিক্রি হবে ১৭২ টাকা লিটার। এর আগে বোতলজাত এক লিটার সয়াবিনের দর ছিল ১৬০ টাকা। আর খোলা তেল ছিল ১৩৬ টাকা লিটার। অর্থাৎ আগের চেয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেলে লিটারপ্রতি ৩৮ টাকা ও খোলা তেলে ৪৪ টাকা বেড়েছে।

পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৮৫ টাকা, যা আগে ছিল ৭৬০ টাকা। সরকার নতুন করে দর বেঁধে দেওয়ার পর পলাশী বাজারের ওই দোকানির মতো কারসাজিতে জড়িয়েছে অন্য অনেক বিক্রেতাই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্য তেলের বর্ধিত দাম ঘোষণার পর কোনো কোনো ব্যবসায়ী তাদের কাছে থাকা তেলের পুরোটাই মজুদ করে ফেলে। পরে গোপনে বের করে বেশি দামে বিক্রি করছে তারা।

রাজধানীর কারওয়ানবাজার, হাতিরপুল, পলাশী, মিরপুরসহ বিভিন্ন বাজারে গোপনে তেল বিক্রি হচ্ছে। তবে চাহিদার তুলনায় তা কম।

কারওয়ানবাজারের ব্যবসায়ী সুমন মিয়া জানান, তেলের সরবরাহ কম। তবে একেবারে নেই তা বলা যাবে না। যে যতটুকু তেল পেয়েছে তা মজুদ করেছে।

আগে থেকেই গুঞ্জন ছিল তেলের দাম বাড়বে। তাই তেল ধরে রেখে বাজারে সংকট সৃষ্টি করা হয়। নতুন দামের তেল সোমবার থেকে আসতে শুরু করবে। এর মধ্যে পুরোনো তেল বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। যেহেতু চাহিদা বেশি তাই বাড়তি দামেই মানুষ কিনছে।

কারওয়ানবাজারের তেল কিনতে আসা বেইলি রোডের বাসিন্দা সুমিত বলেন, ‘ফাস্টফুডের দোকান চালাতে প্রতিদিন আমার ২০ লিটার সয়াবিন তেল দরকার হয়। কিন্তু কোথাও তেল পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে এ দোকান সে দোকান ঘুরছি।’

কারওয়ানবাজারের কিচেন মার্কেটের ব্যবসায়ী সেলিম খান বলেন, ‘অতি মুনাফার লোভে কেউ কেউ তেল মজুদ করে রেখেছিল। তবে ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানে জরিমানাও গুনতে হয়েছে অনেককে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, আইনের ব্যত্যয় ঘটলে আমরা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করব। ভোক্তা অধিকার সব সময় মাঠে আছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ব্যবসায়ীরা ঈদের আগেই দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সরকার সেই প্রস্তাব গ্রহণ না করায় হয়তো তেল বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ করা হয়নি। আবার বিশ্ববাজারে দামের উত্থান পতনের সঙ্গে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের মনোভাব বিবেচনা করে অনেক ব্যবসায়ী আমদানির জন্য এলসি খুলতে আগ্রহী হননি। তবে এখন সরকার মোটামুটি যৌক্তিক দাম ঠিক করায় অনেকেই এলসি খুলতে উৎসাহিত হবেন এবং এরই মধ্যে আসা সয়াবিন ও পাম তেল দু-এক দিনের মধ্যে বাজারে এলে বাজারে তেলের যে সংকট সেটি আপাতত কাটবে বলে একজন ব্যবসায়ী মন্তব্য করেছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close