বিবিসি

  ২২ মার্চ, ২০১৮

পাচার হচ্ছে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অল্প বয়সী মেয়েরা বিদেশিদের যৌনকর্মে ব্যবহারের টার্গেট হয়ে উঠছে। কক্সবাজার থেকে যৌনকর্মের জন্য রোহিঙ্গা মেয়ে ও শিশুদের পাচার করা হচ্ছে। বিদেশি খদ্দের সেজে এমন তথ্য পেয়েছে বিবিসি নিউজের একটি দল। ওই দল এবং ফাউন্ডেশন সেন্টিনেল নামের অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি কক্সবাজার ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে। অনুসন্ধান শুরুর পর স্থানীয় ছোট হোটেল ও সৈকতের রিসোর্ট থেকে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দালালদের টেলিফোন নম্বর যোগাড় হয়ে গেল। এই হোটেল ও রিসোর্টে অসামাজিক কর্মকা-ের জন্য কক্ষ ভাড়া পাওয়া যায়।

পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েই দলটি এসব নম্বরে ফোন করে দালালদের কাছে জানতে চায় বিদেশিদের জন্য অল্প বয়সী রোহিঙ্গা মেয়ে পাওয়া যাবে কিনা। এর উত্তরে টেলিফোনে ওপার থেকে এক দালাল জানায় ‘অল্প বয়সী মেয়ে আছে কিন্তু রোহিঙ্গা মেয়ে কেন খোঁজা হচ্ছে? ওরা তো খুব নোংরা।’

আরো অনুসন্ধানে দেখা গেল রোহিঙ্গা মেয়েদের সেখানে সবচেয়ে সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। পতিতাবৃত্তির ক্ষেত্রেও তারা সেখানে সবচেয়ে নিচের সারিতে রয়েছে।

দলটি দালালকে জানালো যত দ্রুত সম্ভব তারা এসব মেয়েদের সঙ্গে রাত কাটাতে চায়। খুব দ্রুতই বিভিন্ন দালালদের কাছ থেকে রোহিঙ্গা মেয়েদের ছবি আসতে শুরু করল। যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছর। বলা হলো ছবির মেয়েদের পছন্দ না হলে এমন আরো বহু আছে। চাইলেই পাওয়া যাবে। এভাবে এত রোহিঙ্গা মেয়ে পাওয়া গেল যা খুবই ভয়াবহ। যখন খদ্দের থাকে না তখন এসব মেয়েরা অনেক সময় দালালদের বাড়িতে রান্নাবান্না বা ধোয়ামোছার কাজ করে বলেও জানা গেল।

অল্প বয়সী মেয়েরা ‘ঝামেলা’ করে বলে তাদের দ্রুত বিদায় করে দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। দালালদের সঙ্গে কথাবার্তার রেকর্ডিং ও ভিডিও স্থানীয় পুলিশকেও দেওয়া হয়েছে। পুলিশের একটি ছোট দলকেও অভিযানে দেওয়া হয়।

দালালদের একজনকে পুলিশ খুব দ্রুতই চিনে ফেলে। বলা হয় সে সম্ভবত পুলিশেরই তথ্য দাতা অথবা অপরাধী কেউ হবে।

অভিযানের অংশ হিসেবে দলটি কক্সবাজারের ওই দালালকে ফোন করে। ছবিতে দেখা দুটো মেয়েকে রাত ৮টায় শহরের একটি নামি হোটেলে পাঠাতে বলা হয়।

ফাউন্ডেশন সেন্টিনেলের এক কর্মী অনুবাদক হিসেবে হোটেলের বাইরে অপেক্ষা করছিল। হোটেলের কার পার্কে অপেক্ষা করছিল পুলিশ। রাত ৮টার দিকে বেশ কয়েকটি ফোন কলের পর একটি গাড়িতে করে ড্রাইভারের সঙ্গে ছবিতে দেখা মেয়ে দুটিকে পাঠানো হয়। বিদেশি খদ্দের সেজে থাকা ব্যক্তিটি জানতে চায় রাতের পরে আরো মেয়ে পাওয়া যাবে কিনা। গাড়িচালক সম্মতি সূচক মাথা নাড়েন। টাকা হস্তান্তরের পরই পুলিশ গাড়ির চালককে গ্রেফতার করে। মেয়ে দুজনকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। দারিদ্র্য আর পতিতাবৃত্তির জালে যেন এই মেয়ে দুটি আটকে গেছে। তারা জানায় পতিতাবৃত্তি ছাড়া জীবন চালানো তাদের জন্য খুব কঠিন।

কিন্তু পাচার হওয়া নারী ও শিশুদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পর্যায়ে নারী ও শিশু পাচারে খুব শক্তিশালী নেটওয়ার্ক দরকার হয়। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট এখন যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা মেয়েদের ঢাকা, নেপালের কাঠমান্ডু ও ভারতের কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। কলকাতায় ব্যস্ত অসামাজিক কাজের এরকম অনেক নারীদের পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে তারা। এর পর তাদের আর খোঁজ মিলছে না।

দুই কিশোরীর করুণ গল্প : মিয়ানমারে পরিবারের লোকজনের হত্যাকা-ের পর ১৪ বছর বয়সী আনোয়ারা পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন। বিপদগ্রস্ত এই কিশোরীর সে সময় সাহায্য খুবই দরকার ছিল। আর এই অসহায়ত্বের সুযোগটিই নিয়েছে পাচারকারীরা। ‘একদিন একটি গাড়িতে করে কয়েকজন নারী এলেন। তারা জানতে চাইলেন আমি তাদের সঙ্গে যাব কিনা’, বলছিলেন আনোয়ারা। তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল নতুন জীবনের। তাদের সঙ্গে যেতে রাজি হওয়ার পর আনোয়ারাকে গাড়িতে তোলা হলো এবং কক্সবাজার নিয়ে যাওয়া হলো। খুব বেশিক্ষণ হয়নি তার আগেই ওরা আমার কাছে দুটো ছেলে নিয়ে এলো। তারা আমাকে ছুরি দেখাল। পেটে ঘুষি মারল। আমি রাজি হচ্ছিলাম না দেখে ওরা আমাকে মারতে থাকল। এক পর্যায়ে ওরা আমাকে ধর্ষণ করল।

কক্সবাজারে ক্যাম্পগুলোতে নারীদের সঙ্গে ‘অসামাজিক কাজে’ জড়িয়ে পড়ার এমন অনেক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া গেছে। অল্প বয়সী নারী ও শিশুরা এর মূল টার্গেট। বিপদগ্রস্ত এই নারী ও শিশুদের মূলত কাজের লোভ দেখিয়ে ক্যাম্প থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শিশু ও তাদের অভিভাবকরা বলছেন দেশের বাইরে কাজ, ঢাকায় বাড়ি ঘরে গৃহকর্মীর কাজ বা হোটেলে কাজের অনেক প্রস্তাব আসছে তাদের কাছে। মারাত্মক ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পে বিশৃঙ্খল পরিবেশ পাচারকারীদের সুযোগ যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

মাসুদা নামের আরেক কিশোরী তার কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন, ‘আমি জানতাম আমার কপালে কী আছে। যে নারী আমাকে কাজ দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি একজন রোহিঙ্গা। অনেক দিন আগে এখানে এসেছেন। সবাই জানে যে তিনি লোকজনকে অসামাজিক কাজে সহায়তা করেন। আমার কোনো উপায় ছিল না কারণ এখনো আমার জন্য কিছুই নেই। রোহিঙ্গাদের জন্য জীবনের ভরসা নেই। ক্যাম্পের জরাজীর্ণ জীবনই তাদের ভবিষ্যৎ। তা থেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন মাসুদা। এখন তিনি একটি স্থানীয় এনজিওর তত্ত্বাবধানে রয়েছেন।

মাসুদা বলছেন, আমার পরিবার নিখোঁজ হয়ে গেছে। আমার অর্থকড়ি নেই। মিয়ানমারে আমি ধর্ষণের শিকার হয়েছি। আমি একসময় আমার ভাইবোনের সঙ্গে খেলা করতাম। এখন খেলা কাকে বলে সেটাই ভুলে গেছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist