বদরুল আলম মজুমদার

  ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯

বিএনপিতে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর বিএনপির তৃণমূল হতাশায় ভুগছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে নেতাকর্মীরা যেমন হতাশ, তেমনি দলের উচ্চপর্যায়েও রয়েছে ব্যাপক ক্ষোভ। সিনিয়র নেতাদের ভেতর এরই মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। দলের সঠিক কর্মকৌশল প্রণয়নে ব্যর্থতার দায় নিয়ে একপক্ষ অন্যপক্ষকে সরে যেতে বলছে। এ ছাড়া অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা স্থায়ী কমিটিতে ব্যাপক পরিবর্তনের প্রস্তাব দিচ্ছেন আড়ালে-আবডালে।

এ অবস্থায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সবার সঙ্গে পরামর্শ করে দলে বড় ধরনের পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ ছাড়া মহাসচিবসহ দলের বড় একটি অংশ নতুন করে কাউন্সিল ডাকার কথা বলছে। এ কাউন্সিলের মাধ্যমে দলকে নতুন-পুরাতনে নেতাদের সমন্বয়ে যুগোপযোগী করে সাজাতে বলা হচ্ছে। তবে এখনই কাউন্সিল করার পক্ষে নেই বিএনপির হাইকমান্ড। কাউন্সিল না করে দলের মাঠপর্যায়ে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করাসহ নির্বাহী কমিটি ও জাতীয় স্থায়ী কমিটি ঢেলে সাজানোর বিষয়ে জোর দিয়েছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানতে শিগগিরই বিএনপির বেশ কিছু সিনিয়র নেতা দেখা করতে পারেন দলের কারান্তরীণ চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে। গত দুদিনে বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস পাওয়া গেছে।

নির্বাচনের পর বিএনপি ফল প্রত্যাখ্যান করলেও আন্দোলন নিয়ে আপাতত মাঠে নামতে চায় না। ফল বিপর্যয়ের পর ঘুরে দাঁড়াতে সব ধরনের কর্মপন্থা নিয়েই কাজ করবে দলটি। এ জন্য দলটির হাতে অনেক সময়ও রয়েছে। তাই বুঝেশুনে সামনে এগোতে নানা পরিকল্পনা সাজানোর কথা শোনা যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে শিগগির বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি পুনর্গঠন করা হচ্ছে। পুনর্গঠিত কমিটিতে বেশ কজন নতুন মুখ আসছেন। বয়সজনিতসহ বিভিন্ন কারণে বাদ পড়ছেন দু-তিনজন সিনিয়র নেতা। নতুন মুখ হিসেবে স্থায়ী কমিটির সাতটি পদে স্থান পাচ্ছেন দলের কয়েকজন ভাইস চেয়ারম্যান ও দল-সমর্থিত একজন পেশাজীবী। একই সঙ্গে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ ও জাতীয় নির্বাহী কমিটিও পুনর্গঠন করা হবে। এ ব্যাপারে দলের কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও লন্ডনে অবস্থানরত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের নীতিনির্ধারকদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। পুনর্গঠনের এ উদ্যোগে দলের নিষ্ক্রিয় ও আত্মগোপনে থাকা নেতারাও সক্রিয় হয়ে তদবির-লবিং শুরু করেছেন বলে দলের একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপির স্থায়ী কমিটির নতুন সদস্য হওয়ার তালিকায় এরই মধ্যে আলোচনায় আছেন বেশ কয়েকজন। তারা হলেন ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুল্লাহ আল নোমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মোহাম্মদ শাহজাহান, জয়নুল আবেদীন, দল-সমর্থিত পেশাজীবী ড. মাহবুব উল্লাহ প্রমুখ।

স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ার আলোচনায় থাকা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে দল পরিচালিত হচ্ছে। কাজেই স্থায়ী কমিটির শূন্য পদগুলো পূরণ করে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। দলের নেতাকর্মীরাও তাই মনে করেন। কাকে সদস্য করা হবে—সে বিষয়ে দলের কাউন্সিলে চেয়ারপারসনকে ক্ষমতা দেওয়া আছে। যাদের দিলে স্থায়ী কমিটি শক্তিশালী হবে, তিনি তাদের মনোনীত করবেন।

সূত্র জানায়, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অবিশ্বাস্য পরাজয়ের পর দলের মধ্যে জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্ব পরিবর্তনের দাবি তোলে দলের একাংশ। তবে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে কাউন্সিল করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন দলের নীতিনির্ধারকরা। দলের দুই শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আপাতত দল পুনর্গঠনের পক্ষে মত দেন। এ পরিস্থিতিতে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত দল পুনর্গঠনের মাধ্যমে সারা দেশে হতাশাগ্রস্ত নেতাকর্মীদের চাঙা করার উদ্যোগ নিয়েছে দলটি।

সূত্র জানায়, এ লক্ষ্যে স্থায়ী কমিটির পাশাপাশি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদমর্যাদায় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদও পুনর্গঠন করা হবে। বর্তমানে ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটির মধ্যে ৫ জন সদস্য মারা গেছেন। দল-সমর্থিত বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন, তাদের মধ্য থেকে এই ৫টি শূন্যপদ পূরণ করা হবে। একই সঙ্গে যে নেতাদের দলের ভাইস চেয়ারম্যান করা যাচ্ছে না, তাদেরও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হবে। জানা যায়, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটিও পুনর্গঠন করা হবে। শূন্যপদগুলো পূরণ এবং নিষ্ক্রিয়, শৃঙ্খলাভঙ্গকারী ও বিতর্কিত নেতাদের বাদ দিয়ে ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে মূল্যায়ন করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে।

এদিকে নির্বাচনের পর বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে মতভেদও প্রকাশ হচ্ছে। একে অপরকে ঘায়েল করে বক্তব্যও দিচ্ছেন। গত কয়েক দিনে প্রভাবশালী দুই সিনিয়র নেতার বক্তব্য নিয়েও বিএনপির ভেতরে-বাইরে তোলপাড় শুরু হয়। বলতে গেলে এ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটি এখন কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত। এরই মধ্যে লন্ডনে অবস্থান নেওয়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যপদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও ড. আবদুল মঈন খানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপরই ওই দুই নেতা চরম ক্ষুব্ধ হন বলে জানা গেছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে স্টিয়ারিং কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র কোনো নেতাই মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম না প্রকাশের শর্তে এক নেতা বলেছেন, ঘটনাটি সত্য। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বিষয়টি তিনি শুনেছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানেন না। স্টিয়ারিক কমিটির আরেক সদস্য গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক বলেন, এটা হতে পারে।

গত সপ্তাহে প্রয়াত জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় স্থায়ী কমিটির এই দুই সদস্য সরাসরি দল পুনর্গঠনের পক্ষে মত দেন। ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিএনপিকে এখন ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এ জন্য দলকে পুনর্গঠন করতে হবে। সেই দিন একই সুরে কথা বলেছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও। সূত্র মতে, এই দুই নেতার মতের সঙ্গে দ্বিমত খোদ তারেক রহমানসহ বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ অন্য সব সদস্যসহ ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ নির্বাহী কমিটির অধিকাংশ নেতাও তারেক রহমানের মতের সঙ্গে একমত। তাদের বক্তব্য হলো, খালেদা জিয়ার মুক্তির আগে কোনো কাউন্সিল হতে পারে না। এখন সবার আগে প্রাধান্য দেওয়া উচিত খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে।

পিডিএসও/হেলাল​

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
উদ্যোগ,বিএনপি,সংস্কার
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close