প্রতীক ইজাজ

  ০২ অক্টোবর, ২০১৮

বিএনপির ৭ দফা : চিন্তিত নয় আওয়ামী লীগ

বিএনপির ৭ দফা দাবি নিয়ে চিন্তিত নয় আওয়ামী লীগ। বরং এসব দাবির মধ্য দিয়ে বিএনপির এই সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীনরা। তাদের মতে, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে এটা আওয়ামী লীগেরও প্রত্যাশা। সরকার সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায়। সেখানে বিএনপিরও দায়িত্ব আছে।

বিএনপির এসব দাবির বেশিরভাগই অসাংবিধানিক এবং আইনানুগ নয় বলে মত ক্ষমতাসীনদের। তাদের মতে, এসব দাবি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের মধ্য থেকে এসব দাবি পূরণ সম্ভব নয়। ইভিএম ও কোটা সংস্কারসহ কিছু দাবি সেগুলো এমনিতেই সমাধান হচ্ছে। এগুলোর জন্য আন্দোলনের দরকার নেই। এমনকি এসব দাবি নিয়ে আলোচনায় বসারও কোনো প্রয়োজন মনে করছে না তারা। সেক্ষেত্রে কোনো দলের নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো ভালো পরামর্শ থাকলে তা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়ার কথা বলেন তারা। তাদের মতে, নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনকালীন সরকার কমিশনকে নির্বাচনে সহযোগিতা করবে। সুতরাং কারো যদি কোনো পরামর্শ থাকে তা নির্বাচন কমিশনকে দিলেই হবে।

‘তবে এসব দাবি পূরণের নামে কোনো ধরনের সহিংসতা করলে ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ’, জানান আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী নেতারা। তারা বলেন, যেকোনো ধরনের সহিংসতা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিহত করবে আওয়ামী লীগ। বিএনপিরও উচিত নেতিবাচক রাজনীতি পরিহার করা। এ সংস্কৃতি গণতন্ত্র ও রাজনীতির জন্য ভালো নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ নেতৃত্বে এ ধরনের রাজনীতি নেই। বিএনপিও ধ্বংসাত্মক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসুক, সেটা আওয়ামী লীগও চায়। নির্বাচনের আগে এসব অযৌক্তিক ও অসাংবিধানিক দাবির নামে কিছুতেই নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করতে দেবে না আওয়ামী লীগ।

গতকাল আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে দলের এমন মনোভাব জানা গেছে। দলীয় সূত্র মতে, সংবিধানের মধ্য থেকে সব দলকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায় সরকার। এজন্য বিএনপির দাবিগুলো যে অযৌক্তিক ও অসাংবিধানিক তা জনগণকে বোঝাতে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দল। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে চায় বিএনপিকে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে বিএনপিকে বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও বাধা দেবে না। তবে কোনো ধরনের সহিংসতা বা নেতিবাচক রাজনীতি মেনে নেবে না দল। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে কঠোর হওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তও রয়েছে দলে।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, বিএনপি সমাবেশ থেকে যেসব দাবি দিয়েছে, তারা নিজেরাও জানে সেগুলো পূরণ করা সম্ভব নয়। বরং এর মধ্য দিয়ে তারা যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই নির্বাচনে আসতে চায়, সেটা প্রকাশ পেয়েছে।

আওয়ামী লীগের এই নেতা বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, নেতিবাচক রাজনীতি পরিহার করে বিএনপির উচিত নির্বাচনে অংশ নেওয়া। সুষ্ঠু নির্বাচনে তাদেরও দায়িত্ব আছে। আমরা আশা করছি, বিএনপি নির্বাচনে আসবে।

মাহবুব উল আলম হানিফ আরো বলেন, বিএনপি বা কোনো রাজনৈতিক দল যদি মনে করে নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো পরামর্শ আছে, সেগুলো তারা নির্বাচন কমিশনকে দিতে পারে।

এসব দাবি নিয়ে সরকারের কোনো আলোচনার সুযোগ নেই। কারণ নির্বাচন করবে কমিশন। সরকার তাদের সহযোগিতা করবে মাত্র। সংবিধানের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। বিএনপির মধ্যে নির্বাচন নিয়ে যে সন্দেহ, তা অমূলক। সেটা দূর করতে হবে। এর আগে কুষ্টিয়ার এক অনুষ্ঠানে এই নেতা আরো বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে। ওই নির্বাচনে আমরা সব দলকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। এ অবস্থায় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইন ভঙ্গ বা সংবিধান লঙ্ঘনের দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। সেখানে ‘নির্বাচনের আগেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি’ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া আদালতের রায়ে দণ্ডিত হয়ে কারাগারে আছেন। বিএনপিকে মাথায় রাখতে হবে দ-িত কোনো কয়েদিকে আদালতের মাধ্যম ছাড়া মুক্তি পেতে হলে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে নিজের দোষ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। এর বাইরে আর কোনো পথ নেই। তিনি এমনও বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিয়ে বেআইনি কোনো দাবি মানার সুযোগ নেই।

গত রোববার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ থেকে বিএনপি নির্বাচনী ৭ দফা দাবি ঘোষণা করে। দাবিগুলোর মধ্যে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগেই দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার, জাতীয় সংসদ বাতিল করে সরকারের পদত্যাগ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ, ইভিএম ব্যবহারের চিন্তা ও পরিকল্পনা বাদ দেওয়া উল্লেখযোগ্য। সমাবেশে দলের নেতারা খালেদা জিয়াকে ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না ও বিএনপি নির্বাচনে যাবে না বলেও জানান। এমনকি সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করারও অভিযোগ আনেন তারা।

সমাবেশের পরপরই বিএনপির দাবিগুলো নিয়ে তীব্র সমালোচনা করতে থাকেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। গতকালও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দাবিগুলো অসাংবিধানিক ও অযৌক্তিক বলে যুক্তি খন্ডন করেন। এ সময় তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা প্রকাশ করেন এবং সংবিধান মেনে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির সমাবেশে লোকসমাগম নিয়েও সমালোচনা করেন। পাশাপাশি যেকোনো ধরনের সহিংসতা প্রতিহত করতে সরকার ও আওয়ামী লীগের দৃঢ়তার কথাও জানান তারা।

অবশ্য বিএনপির সমাবেশের আগের দিন গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে নির্বাচন করার জন্য ‘যথেষ্ট সুন্দর পরিবেশ আছে’ এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ও সেটাই থাকবে বলে উল্লেখ করেন। সেখানে তিনি নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনে লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড তৈরিসহ অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারের ইতিবাচক মনোভাব তুলে ধরেন।

সমাবেশের পর আওয়ামী লীগ নেতারা ৭ দফা দাবির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দেন। এর মধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সমাবেশের পর এক সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির সাত দফা দাবিকে অযৌক্তিক ও অবাস্তব বলে মত দেন। এছাড়া গতকালও গতকাল রাজধানীতে দলের এক নির্বাচনী কর্মসূচির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এ নিয়ে কথা বলেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, এই সাত দফা দাবি অযৌক্তিক ও অবাস্তব এবং কোনো কোনোটি সংবিধানবিরোধী। কাজেই এসব অবাস্তব দাবি এই সময়ে, নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার আর মাত্র এক মাস বাকি এর মধ্যে মেনে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা নিজেরাই ক্ষমতায় থাকলে এই সময়ের মধ্যে দাবিগুলো মেনে নিতে পারত না। অসাংবিধানিক দাবি কেউ মেনে নিতে পারে না।

এর আগে বিএনপির সমাবেশের পরপরই এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের এমনও বলেন, গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হলে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করবে। যদি আন্দোলনের নামে ২০১৪ সালের মতো নাশকতা, বোমা হামলা এবং সেই ভয়াবহ দৃশ্যপটের অবতারণা করা হয়, প্রশাসন যা যা করা দরকার সব করবে। তিনি আরো বলেন, আমরাও (আওয়ামী লীগ) ঘরে বসে ডুগডুগি বাজাব না। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করব, প্রতিহত করব।

এমনকি এসব দাবি পূরণে বিএনপির সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবও নাকচ করে দেন এই নেতা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের কোনো পরিবর্তন, সংযোজনের সুযোগ নেই। তিনি বলেন, দেশে কী এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে এখন বিশেষ সরকারের প্রয়োজন পড়েছে? বাংলাদেশ তো অশান্ত নয়। তিনি জানান, অক্টোবরের মাঝামাঝি অথবা শেষ সপ্তাহে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হবে। এই সরকার রুটিন দায়িত্ব পালন করবে। তার হাতে কোনো ক্ষমতা থাকবে না।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আওয়ামী লীগ,রাজনীতি,বিএনপির ৭ দফা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close