হাসান ইমন

  ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৯

ক্ষতিগ্রস্তরা পাননি কোনো সহায়তা

চুড়িহাট্টা : রাসায়নিকের গুদাম এখনো সরেনি

পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা এলাকার হাজি ওয়াহেদ ম্যানশনের বর্তমান অবস্থা

পুরান ঢাকার ভয়াবহ চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির ক্ষত নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে পুড়ে যাওয়া ভবনটি। আশপাশের ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে নতুন করে রং করায় সেগুলোতে এই ট্র্যাজেডির চিহ্ন খুব একটা লক্ষ করা যায় না। তবে যে ভবন থেকে এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত, সেই হাজি ওয়াহেদ ম্যানশনের দিকে তাকালে মনে পড়ে ভয়াবহ ট্র্যাজেডির কথা। এ ঘটনায় অনেকে হারিয়েছেন বাবা, ভাই-বোনসহ আত্মীয়স্বজন। স্বজন হারানোর ব্যথা এখনো ভুলছেন না তারা। ওই সময় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তার কথা বললেও তারা এখনো পাননি কোনো সহায়তা।

এ বছরের প্রথমদিকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টার ৬৪ নম্বর হাজি ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এরপরই একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরা এলাকা। আগুনের লেলিহান শিখা বাড়তে বাড়তে অত্র এলাকা পুড়িয়ে দেয়। দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে মানুষ। কিন্তু ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনের সড়কে এবং ভবনের ভেতরে থাকা মানুষ কোনোদিকে দৌড়ানোর সুযোগ পায়নি। পুড়ে কয়লা হয়ে যান ৬৯ জন। আবার হাত, পা, পেট পুড়ে ৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। কিছুদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে তাদের একজন মারা যান।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একের পর এক দুর্ঘটনার ঘটনা এখন তাদের অনেকটা সয়ে গেছে। ফলে এ ধরনের দুর্ঘটনার পরও টনক নড়ছে না স্থানীয় বাসিন্দাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। স্থানীয় বাড়িওয়ালারা এ নিয়ে চিন্তিত না থাকলেও চরম আতঙ্কে রয়েছেন ভাড়াটিয়ারা। এদিকে, পুরান ঢাকার অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন ও কারখানা সরিয়ে নিতে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করতে পারেনি তারা। এসব দুর্ঘটনার জন্য কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতাকেই দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ঘটনা ঘটলে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। কিন্তু ঘটনার কিছুদিন পার হলেই ভুলে যান তারা। তবে যত দ্রুত সম্ভব পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়া উচিত বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা। আর ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তার কথা শুধু মুখে আর কাগজে-কলমে বললে হবে না, বাস্তবায়ন করতে হবে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ওয়াহেদ ম্যানশনের পাশের ভবনগুলো নতুন রঙে সাজানো হয়েছে। বাদ যায়নি এ ভবনটিও। গত দুই মাস আগে নিচতলার ক্ষতিগ্রস্ত দেয়ালগুলো নতুন করে তৈরি করা হয়েছিল। আগের মতো করে সাজানো হয়েছে। একই সঙ্গে দোতলায়ও ইটের গাঁথুনি করে নতুন সাজানো হয়েছিল। তবে গতকাল দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। নিচতলা সুন্দর করে সাজানো থাকলেও দোতলার গাঁথুনিগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। আর ওপরে ৩, ৪ ও ৫-তলা ক্ষতিগ্রস্তই রয়ে গেছে। নিচতলায় দুটি রুমের মধ্যে একটিতে প্লাস্টিকের কণা, অন্যটিতে সবজি বিক্রি করতে দেখা গছে। স্থানীয়রা জানান, এখানে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার কথা অনেকে ভুলে গেছেন। কারণ দুর্ঘটনায় যেসব ভবনে ক্ষতি হয়েছে, তা এখন নতুন করে সংস্কার করে ব্যবসা ও বসবাস করা হচ্ছে। ওয়াহেদ ম্যানশনটি নতুন করে সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছিল। মাসখানেক আগে রাজউকের বাধায় তা আর করা হয়নি। ভেঙে ফেলা হয়েছে দোতলার গাঁথুনিগুলো। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নিলে ফের দুর্ঘটনা ঘটার শঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকে।

এলাকাবাসী আরো বলেছে, এমন ভয়াবহ ঘটনার পরও টনক নড়েনি পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের। এখনো গোডাউন ও বাসাবাড়িতেই মজুদ রাখা হচ্ছে রাসায়নিক দাহ্য বস্তু। যেকোনো সময় আবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। তাদের অভিযোগ, প্রশাসন সঠিকভাবে পরিস্থিতি তদারকি করছে না। চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনার পর কিছুদিন তদারকি চললেও এখন শিথিল হয়ে গেছে। অভিযানে শিথিলতা আসার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসেছে পুরোনো চিত্র। এ ছাড়া, কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল জড়িত আছে। এ জন্য তারা কেমিক্যাল ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারছে।

জানা গেছে, পুরান ঢাকার এসব কারখানা ও গুদামের বিষয়ে সম্প্রতি দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক অধিদফতর, পরিবেশ অধিদফতর ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সমন্বয়ে মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, যেসব কারখানায় দাহ্যপদার্থ নেই, সেগুলোকে লাইসেন্স দেওয়া হবে। আর অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ২৯টি পদার্থ সেসব প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যাবে- সেগুলো সিলগালা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

সম্প্রতি ওই এলাকার কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শুরু করা হয়। কিন্তু অভিযানে কোনো অবৈধ কারখানা সিলগালা করা হয়নি।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডে যারা মারা গেছেন, তাদের মরদেহের সঙ্গে পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া কথা ছিল, পরে প্রত্যেক নিহতের স্বজনদের দেওয়া হবে এক লাখ টাকা করে। এ ছাড়া পরিবারের যোগ্যদের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে—এমন ঘোষণার পর কেটে গেছে ৯ মাস। কিন্তু এখনো কোনো সহায়তা পাননি স্বজনরা। তাদের অনেকেরই দিন কাটছে অভাব-অনটনে।

দুই সন্তানকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন সাহাব উল্লাহও। তিনি বলেন, নাতি আরেফিন মোহাম্মদের বেড়ে ওঠা আরো আনন্দের হতো পারত। চুড়িহাট্টার আগুনে বাবা মাসুদ রানাকে হারানোর পর খুব বেশি কথাও বলে না আরেফিন। সন্তান হারানো আরেক বাবা আলমগীর হোসেন জানান, সেদিন সন্তানের সঙ্গে পুড়েছিল তার দোকানটাও।

এ বিষয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার আইনজীবী রেজওয়ানা হাসান জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় একটি তহবিল গঠন করা হয়। এতে অনেক টাকা জমা পড়ার খবরও রয়েছে গণমাধ্যমে। কিন্তু, ঘটনার এত দিন পরও নিহতদের স্বজনরা সহযোগিতা না পাওয়ায় উঠেছে প্রশ্ন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, পুরান ঢাকা থেকে এসব ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান না সরালে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশন একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করতে আমরা দেখছি না। এখন আর কোনো সিদ্ধান্ত নয়, একটাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যত দ্রুত সম্ভব পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম ও প্লাস্টিকের কারখানা সরাতে হবে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চুড়িহাট্টা,সহায়তা,রাসায়নিকের গুদাম
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close