reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৭ জুন, ২০২২

বিশ্বনেতাদের অনুকরণীয় হতে পারেন যে গরিব রাষ্ট্রপতি!

ছবি: মুজিকা ও তার গাড়ি

পৃথিবীতে অনেক মহান ব্যক্তি ছিলেন যারা তাদের গুণ ও মেধার জন্য অমর হয়ে আছেন মানুষের হৃদয়ে। মুসলিম বিশ্বের খলিফা হযরত উমর (রাঃ), বাগদাদের বাদশাহ হারুনুর রশিদ ছাড়াও আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁরা সবাই নিজ নিজ মহান কীর্তিতে অমর হয়ে আছেন।

আজ আমরা এমন একজন ব্যক্তি সম্পর্কে জানব, যিনি ‘বাস্তবিক অর্থে তুলনা করলে বর্তমান সময়ের সকল মাহাত্ম্যের গুণকে ছাড়িয়ে গেছেন’। বলছি, উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট ‘হোসে আলবার্তো "পেপে" মুজিকা কর্ডানো’ ওরফে হোসে মুজিকার কথা।

তাঁর জীবন কাহিনী অনেকটাই গল্পের মতো। কারণ, বর্তমান দুনিয়ায়ও যে এমন একজন মহৎ প্রেসিডেন্টের সন্ধান মিলবে, তা ধারণার বাইরে। এক কথায় সত্যিই অবিশ্বাস্য।

মুজিকাকে বলা হয় “দ্য ওয়ার্ল্ড পোরেস্ট প্রেসিডেন্ট” বা বিশ্বের সবচেয়ে গরিব রাষ্ট্রপতি। কিন্তু তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে জানার পর মনে হবে, তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী প্রেসিডেন্ট।

মুজিকা ১৯৩৫ সালের ২০ মে উরুগুয়ের মন্টেভিডিওতে একটি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা দিমেত্রিয় মুজিকা ছিলেন একজন কৃষক। মা লুসি কর্ডানো ছিলেন ইতালিয়ান প্রবাসী। পাঁচ বছর বয়সে মুজিকা তাঁর বাবাকে হারান। এরপর জীবনযাপন অনেকটা কষ্টসাধ্য হয়ে যায় তাঁর জন্য। চরম দারিদ্রতায় জীবন কাটে তাঁর। এসময় তিনি একটি বেকারিতে ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করেন। মাঝে মাঝে হোটেলেও কাজ করতেন মুজিকা।

তরুণ বয়সেই বাম চরমপন্থী নেতা হিসেবে উরুগুয়ের ত্রাস হয়ে উঠেন তিনি। ১৯৬০ সালে মুজিকা টুপামারোস গেরিলা মুভমেন্টে যোগ দেন। সেসময় তারা সরকারি ব্যাংক লুট করে গরীবদের টাকা দিতেন। ধনী ব্যবসায়ীদের খুন করে তাদের অর্থ শ্রমিকদের প্রদান করতেন।

১৯৬৯ সালে দেশটির টাইমস ম্যাগাজিনে তাঁকে রবিনহুড ‘মুজিকা নামে’ আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৭০ সালের পর তাদের দলটিতে কোন্দল শুরু হয় এবং আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে।

১৯৭০ সালের মার্চে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে গ্রেপ্তার হন মুজিকা। তাঁর উপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। দুইবার জেল থেকে পালিয়ে ১৯৭২ সালে আবারো গ্রেপ্তার হন মুজিকা। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ১৯৮৫ সালে মুক্তি পান এই গেরিলা যোদ্ধা।

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মুজিকাকে। ১৯৯৪ সালে তিনি সাধারণ নির্বাচনে একজন ডেপুটি হিসাবে নির্বাচিত হন। ১৯৯৯ সালে নির্বাচিত হন সিনেটর হিসেবে। ২০০৪ সালে তিনি পুনরায় সিনেটর হিসেবে নির্বাচিত হন।

২০০৫ সালে মুজিকা উরুগুয়ের কৃষিমন্ত্রী এবং ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। উরুগুয়ের জনগণ তাকে পেপে মুজিকা নামে ডাকেন। তার স্ত্রী লুসিয়াও একজন গেরিলা সদস্য ছিলেন। বর্তমানে তিনি একজন সিনেটরের দায়িত্বে আছেন।

প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্বেও তিনি সরকারের দেয়া বিলাসবহুল বাড়িতে থাকেন নি। নেননি কোন রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা। প্রেসিডেন্ট অবস্থায় তিনি তাঁর স্ত্রীর ফার্ম হাউজেই থাকতেন। বর্তমানেও তিনি একই স্থানে অবস্থান করছেন।

মুজিকাকে একবার জিজ্ঞাস করা হয়েছিল, যে গরীব রাষ্ট্রপতি বলার বিষয়ে তাঁর মন্তব্য কি?

তিনি বলেছিলেন আমি গরিব নই, আমি একজন মিতব্যয়ী। যারা আমাকে গরিব বলে প্রকৃত পক্ষে তাঁরাই গরিব। কারণ গরিব সে-ই, যার কোন কিছু পাওয়ার চাহিদা অত্যাধিক।

তিনি আরো বলেন, আমি রাজনৈতিক কারণে আমার স্বাভাবিক জীবনযাপনে কোন পরিবর্তন আনতে চাই না। আমি একজন মিতব্যয়ী এবং এভাবেই জীবনযাপন করতে চাই।

মুজিকা বিলেন, ধনীদের ভোগের কারণে দূষিত হচ্ছে পৃথিবী। আমরা চাইলেই বিশাল বাড়ি তৈরি করতে পারি, সৈকতে বিচ হাউস তৈরি করতে পারি, কিন্তু এগুলো আমাদের জন্য ভোগ ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ পৃথিবীতে বহু মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় খাবার পায় না।

তিনি বলেন, জার্মানিতে যে পরিমাণ মানুষ গাড়ি ব্যবহার করে তা যদি ভারতের জনগণ করতো, তাহলে পৃথিবীতে নিঃশ্বাস নেয়ার অক্সিজেন থাকত না।

মুজিকা বলেছিলেন, ভোগ একটি সংক্রামক রোগ।

মুজিকা তাঁর বাড়িতে স্ত্রী ও একটি তিন পা ওয়ালা কুকুরের সাথে থাকতেন। সম্প্রতি কুকুরটি মারা গেছে। তাঁর বাড়ির সামনে গার্ড হিসেবে চাজন প্রহরী থাকতেন। মুজিকার ইচ্ছা না থাকা সত্বেও প্রেসিডেন্ট থাকার সময় তাঁর বাড়ির সামনে চারজন প্রহরী রাখা হয়েছিল।

এখনও বৃষ্টির মৌসুমে তার বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে যায়।

তিনি ১৯৮৭ মডেলের একটি ভক্সওয়াজান বিটল গাড়িতে চলাচল করেন। যার বর্তমান মূল্য ১ হাজার ৮০০ ডলার। নির্মাতা কোম্পানি গাড়িটির জন্য এক মিলিয়ন দিতে চাইলেও মুজিকা কোন মতামত জানান নি।

মুজিকা বলেন, আমার অর্থের কোন প্রয়োজন নেই, আমি স্ত্রীর খামারে যে ‘ক্রিসেন থিমস’ ফুলের চাষ করি তা বিক্রি করে আমার পরিবার চলে যায়। আর স্ত্রীর বেতনের অর্থ জমানো হয়, যেন ভবিষ্যতে কোন বিপদ আসলে আমরা তার ব্যবহার করতে পারি। জীবনে যদি অতিরিক্ত অর্থ পাই তাহলে তা দান করে দেব।একজন প্রেসিডেন্ট হয়েও নিজেই খামারের ফুল বাজারে বিক্রি করেন মুজিকা। তার কোন সন্তান নেই।

২০১৪ সালে তাকে পুনরায় নির্বাচন করতে বলা হলে মুজিকা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। বলেন, তার বয়স হয়ে গেছে, এখন তাঁর অবসর দরকার।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাষ্টপ্রতি,মুজিকা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close