অপু সুলতান

  ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

পণ্ডিত মশাই

রাস্তার ধারে একটা বেঞ্চে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন পণ্ডিত মশাই। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এবং নিজের উপার্জিত যাবতীয় সম্পত্তি এখন শেষ প্রায়। ব্যাংকে গচ্ছিত কয়েকটি টাকাই এখন শেষ সম্বল। তবু মানুষের জন্য তার ভাবনা। তিনি ভাবছেন শেষ সম্বলটুকু দিয়ে একটি মুদির দোকান দিবেন। যেখান থেকে আর্থিক সংকটে থাকা মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে পারবেন। অবশ্য বিনা পয়সায় দিবেন না- বাকিতে দিবেন। পরে সুবিধা মতো সময়ে তারা তা শোধ করে দিবেন। এখন আর একেবারে বিনা পয়সায় পণ্য দেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা নেই পণ্ডিত মশাইয়ের।

বৃদ্ধ পণ্ডিত মশাই ছোট বেলা থেকেই পরোপকার করেন। সম্পত্তির বেশির ভাগ ব্যয় করেছেন সতপুর গ্রামের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে। তিনি পড়িয়েছেন গ্রামের নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। নিজের আয়ের বেশির ভাগ তিনি খরচ করেছেন মানুষের জন্য। বিদ্যালয়ের পাঠ্য বই ছাড়াও নানাবিধ বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান। বলা যায়, বিনামূল্যেই তিনি শিক্ষার দ্যুতি ছড়িয়েছেন। গ্রামের মানুষের বিপদ-আপদে তিনি আছেন ছায়ার মতো। দিয়েছেন জ্ঞান-বুদ্ধি, সদুপদেশ ও সুপরামর্শ। এই জন্যই সতপুরবাসী সম্মানস্বরূপ তার নাম দিয়েছেন- পণ্ডিত মশাই। এখন অবস্থা এরকম পণ্ডিত মশাই নামের আড়ালে তার আসল নাম ঢাকা পড়ে গেছে।

চারদিকে নদীবেষ্টিত একটি ছোট্ট গ্রাম সতপুর। দেখতে প্রায় দ্বীপের মতো। গ্রামের পূর্বদিকে একটি লম্বা সড়ক। সড়কের শেষে একটি কাঠের সেতু। এই সেতুটির দ্বারাই গ্রামটি অন্য গ্রামের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। আর এটিই একমাত্র রাস্তা যেটি ধরে গ্রামবাসীকে বের হতে হয়। সংযোগ সেতুটির পাশেই বসানো হলো দোকানের টংঘর। দু’চালার টংঘরে তোলা হলো চাল, ডাল, তেল, লবণ ও চিনিসহ যাবতীয় নিত্য প্র্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ক্রেতার সংখ্যা। যাদের আর্থিক সমস্যা আছে তারা পণ্য নিচ্ছেন বাকিতে। তবে যারা বাকিতে কিনছেন তাদের খুব কমই সময়মতো দোকান বাকির টাকা দিচ্ছেন। যারা টাকা দিতে বিলম্ব করছেন পণ্ডিত মশাই নামের তালিকা ধরে তাদের টাকা দেওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন। তবে তাতে কাজ হচ্ছে যৎসামান্য।

এভাবেই বছরখানেক গেল। দু’বছরের মাথায় পণ্ডিত মশাই লক্ষ্য করলেন- বিগত ছয় মাস কী এক বছর যাবত অনেককেই তিনি এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে দেখেন না। অনেকের চেহেরাও তিনি ভুলে গেছেন। তারা কি একবারের জন্যও গ্রামের বাইরে যাননা? পণ্ডিত মশাই মনে মনে ভাবেন- কোথাও যেতে চাইলে তো এটাই একমাত্র রাস্তা। এই রাস্তা ছাড়া গ্রাম থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। আরও কিছুদিন যাওয়ার পর দোকানের ক্রেতার সংখ্যা প্রায় শূন্যে দাঁড়ালো। দোকানের মালামাল আর পুঁজিও একেবারে শেষ।

একদিন পণ্ডিত মশাই সিদ্ধান্ত নিলেন- এভাবে আর বসে থাকা যায় না। কিছু একটা করা দরকার। গ্রামের মানুষ কি সব মরে গেছে? এতোগুলো মানুষ এক সাথে কোনো কারণ ছাড়া মরতে পারে না। তিনি পরদিন বাড়ি থেকে বের হলেন। কাঁচা রাস্তা ধরে সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে নদীর তীরে। এই নদীটাই গ্রামের চারপাশ দিয়ে বয়ে চলে গেছে। অসম্ভব রূপবতী নদী। তিনি দেখলেন, পাশ্ববর্তী চাতুরীপুর গ্রামের সাথে পারাপারের জন্য খেয়া দেওয়া হয়েছে। প্রতিবারই আসা যাওয়ার সময় নৌকাভর্তি হয়ে মানুষ পারাপার হচ্ছে। যারা পণ্ডিত মশাইয়ের দোকানের ক্রেতা ছিলেন। যাদের তিনি বিগত এক-দেড় বছর যাবত দেখেন না। তাদের অনেককেই তিনি দেখতে পেলেন খেয়া পারাপার হতে। অত্যন্ত আহত হলেন পণ্ডিত মশাই। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘আমার জীবনভর নিরলস শিক্ষা আর ভালোবাসার মূল্য এরা এভাবে দিলো? মানুষ এতটা নির্বোধ হয় কী করে? সামান্য কয় টাকা দোকান বাকির জন্য ওরা রাস্তাই বদলে ফেললো?’ নিঃসন্তান পণ্ডিত মশাই একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন। বুকের বামপাশ চেপে ধরে আস্তে করে মাটিতে বসলেন। আকাশের দিক তাকিয়ে বললেন, ‘আমার এই এক জীবনে তাদের জন্য কিছুই করতে পারলামনা অথবা আমার কোনো প্রচেষ্টাই তাদের কোনো কাজে আসেনি। আমার যদি একটা সন্তান থাকতো এই অবোধ মানুষগুলোকে দেখাশোনার দায়ভারটা তাকে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতাম।

পিডিএসও/ জিজাক

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পণ্ডিত মশাই,শিক্ষক,মুদি দোকান,নদী
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close