ইসমাইল মাহমুদ

  ২৫ জুলাই, ২০১৯

বিছানাকান্দির পাথর রাজ্যে

যেন এক স্বর্গোদ্ধান। স্বর্গের বিছানা বিছানো এক মনোরম স্থান। বাংলাদেশ-ভারতের ‘নো-ম্যান্স ল্যান্ড’-এ অবস্থিত এক অপরূপ পর্যটন স্পট। নাম বিছনাকান্দি। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট ইউনিয়নের রুস্তমপুর ইউনিয়নের প্রান্তিক জনপদের এক আকর্ষণীয় স্থান। প্রতি দিনই এ স্থানের টানে দলে দলে ছুটছেন পর্যটকরা। বিছনাকান্দি মানুষের অতৃপ্ত মনকে তৃপ্ততার আবেশে ভরিয়ে তুলে।

গত শীতের শুরুতে এক ভোরে আমি, মাহফুজ সুমন ও আনোয়ার হোসেন জসিম শ্রীমঙ্গল থেকে হবিগঞ্জ-সিলেট বিরতীহীন বাসে চড়ে বসি। সকাল সাড়ে আটটায় পৌঁছে যাই সিলেট কদমতলী বাস স্টপেজে। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিক্সা যোগে ১০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাই আম্বরখানা পয়েন্টে। ঐতিহ্যবাহী ইষ্টিকুটুম হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে সকাল সাড়ে নয়টায় পুনরায় চড়ে বসি সিএনজি অটোরিক্সায়। এবার আমাদের যাত্রা গোয়াইনঘাট উপজেলার হালদারপাড় বাজারের উদ্দেশ্যে। পথে যেতে যেতে মালনীছড়া চা বাগান, সিলেট ওসমানী বিমান বন্দর, সালুটিকর বাজার প্রভৃতি আকর্ষণীয় স্থান আমাদের আবিষ্ট করে। সালুটিকর বাজার পেরিয়ে সামনে এগোতে থাকে আমাদের বহনকারী সিএনজি অটোরিক্সা। পথে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সুউচ্চ পাহাড় আমাদের মন কেড়ে নেয়। সকাল সাড়ে এগারোটায় হালদারপাড় বাজারে পৌঁছে দেহ-মনকে খানিকটা চাঙ্গা করতে স্থানীয় বিসমিল্লাহ হোটেলে ধুমায়িত চা পান করি।

বেলা বারোটার দিকে হালদারপাড় বাজার থেকে পায়ে হেঁটে রওয়ানা হই স্বর্গের অপ্সরি বিছনাকান্দির পথে। হালদারপাড় বাজারেই পেয়ে যাই রাজমিস্ত্রি মো. আমিন উদ্দিনকে। তার বাড়ি গোলাপগঞ্জে। এ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার সুবাধে এলাকার সবকিছু তার চেনাজানা। তিনি আমাদের সাথে স্বেচ্চায় গাইড হিসেবে যোগ দেন। তিনি জানালেন বর্ষা মৌসুমে হালদারপাড় বাজার থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে বিছনাকান্দি যাওয়া যায়। ভাড়া নেয় জনপ্রতি মাত্র ২০ টাকা। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে কোনও যান না চলায় পায়ে হাঁটাই একমাত্র ভরসা। অগত্যা পায়ে হেঁটেই রওয়ানা হই বিছনাকান্দির দিকে। যতই সামনে এগোতে থাকি ততই যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আমাদের মুগ্ধতার আবেশ বাড়িয়ে তুলছিল। মায়াবী পিয়াইন নদীর নীল জলরাশি, ধান ক্ষেত, পাথরের পাহাড় সব কিছুই অসম্ভব অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের সমাহার। পুরো বিছনাকান্দির পথ এতাটাই সৌন্দর্যময় যা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। চারিদিকে বিষ্ময়কর সৌন্দর্য।

আমরা যত সামনে এগোতে থাকি ততই কাছাকাছি আসতে থাকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সুউচ্চ পর্বতমালা। এসব পর্বতের মাঝে হীমশীতল সৌরন্দর্যময় ঝর্ণাধারা আমাদের বিমোহীত করে। দেড় ঘল্টা পায়ে হাঁটার পর বেলা দেড়টায় পৌঁছে যাই বাংলাদেশ-ভারতের ‘জিরো পয়েন্ট’ বিছনাকান্দিতে। বিছনাকান্দি পুরোটাই পাথরে ভরা। পিয়াইন নদীর পানি ও সমতলে যেদিকে দু’চোখ যায় শুধু পাথর আর পাথর। ছোট-বড় অসংখ্য পাথর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অংশ থেকে ঝর্ণাধারার সাথে গড়িয়ে নামছে বাংলাদেশের বিছনাকান্দি অংশে। এ এক মনোরম দৃশ্য, কল্পনারও অতীত। পিয়াইন নদীর বুক চিড়ে পাথর তুলে আনছেন পাথর শ্রমিকরা। একদিকে পাথর তোলা হচ্ছে মুহুর্তেই অন্যদিকে পাথর এসে ভরে যাচ্ছে ওই স্থানটি। এছাড়া বড় বড় পাথরের ফাঁকে পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ নীল জলরাশি এবং শ্যাওলার আস্তরণ দেখে মনে হল সাগরের তলদেশের প্রবাল। পাথর ছুইয়ে জল চলে যাচ্ছে পিয়াইন নদীর স্রোতে। সারা বছরই বিছানাকান্দি তার রূপের ঝলক দেখায়। সারাদিনের যান চড়া ও দেড় ঘণ্টার পায়ে হাঁটার ক্লান্তি দুর হয়ে যায় এক নিমিষেই। সহযাত্রী মাহফুজ সুমন বিছনাকান্দি পৌঁছেই শুরু করেন ক্যামেরায় ‘ক্লিক’ করা। আনোয়ার হোসেন জসিম প্রথমে মুগ্ধ চিত্তে চারপাশ দেখার পর হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েন পাথুরে পানিতে। শরীর এলিয়ে দেয় পাথর পানির অপরূপ বিছানায়। বিছনাকান্দির ওপারে রয়েছে একটি সীমান্ত হাঠ। ভারতের অংশে এ হাটটি অবস্থিত হলেও এখানে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই দু দেশের অধিবাসী।

প্রায় তিন ঘণ্টা বিছনাকান্দি অবস্থানের পর এবার ফেরার পালা। ঘড়ির কাটা বিকেল সাড়ে চারটার ঘর ছুয়েছে। আমি তাড়া দিলাম। মাহফুজ সুমনও তার ক্যামেরা ব্যাগে গুছিয়ে রেখে ফেরার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু বাধ সাধলো আনোয়ার হোসেন জসিম। বললো আর একটু সময় কাটিয়ে যাই সৌন্দর্যের অপ্সরিতে। তার যেন বিছনাকান্দি থেকে ফিরতেই মন চাইছিল না। কিন্তু চাইলেইতো আর সবকিছু করা যায় না। ৫টার দিকে আমরা বিছনাকান্দি পেছনে রেখে রওয়ানা হই ফিরতি পথে। দেড় ঘণ্টা পায়ে হাটার পর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় হালদারপাড় বাজারে পৌঁছে সন্ধ্যায় সেরে নিই দুপুরের খাবার! সেখান থেকে সিএনজি অটোরিক্সায় সিলেটের উদ্দেশ্যে। রাত পৌনে নয়টায় এসে পৌঁছি সিলেট নগরীতে। সেখান থেকে বিরতীহীন বাসে চড়ে বসি। রাত সাড়ে এগারোটায় এসে পৌঁছালাম শ্রীমঙ্গলে। তখনো আমাদের সবার চোখেমুখে পরিপূর্ণ একটি ভ্রমণের পরিতৃপ্তি।

যেভাবে যাবেন

সুন্দর্যের অপ্সরি বিছনাকান্দি যেতে হলে দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে বাস, ট্রেন, প্রাইভেট গাড়ি অথবা বিমানে পৌঁছতে হবে সিলেট নগরীতে। নগরীর আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে যেতে হবে সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাট-এর হাদারপাড় বাজারে। সিলেট নগরী থেকে হাদারপাড় যেতে সময় লাগবে আনুমানিক ২ ঘণ্টা। ভাড়া নেবে জনপ্রতি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। রিজার্ভ নিলে ভাড়া নেবে ৫শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকা। বর্ষা মৌসুমে হালদারপাড় বাজার থেকে বিছানাকান্দি পর্যন্ত ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলে। নৌকায় যেতে সময় লাগে ১৫ মিনিট। ভাড়া নেয় জনপ্রতি ২০ টাকা। আর শুষ্ক মৌসুমে পুরো এলাকা হয়ে পড়ে মরুদ্যান। সে সময়ে পায়ে হাঁটা ছাড়া কোনও গত্যন্তর নেই। এছাড়া জৈন্তা উপজেলার সারিঘাট থেকে সিএনজি অটোরিক্সায় যাওয়া যায় হালদারপাড়। সেখান থেকে বিছানাকান্দি। তবে আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সরসারি সিএনজি অটোরিক্সায় হালদারপাড় যাওয়াই সহজসাধ্য।

পিডিএসও/রি.মা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিছানাকান্দি,পাথর রাজ্য
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close