আবুল খায়ের, লেখক

  ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

গ্রন্থ আলোচনা : বেনারসী বৃষ্টির জল

অত্যন্ত মননশীল কবি মনজিল মুরাদ লাভলু বিরচিত ‘বেনারসী বৃষ্টির জল’ নামক কাব্যগ্রন্থটি তার কবি মানসের এক জ্বলন্ত মশাল সদৃশ বললেও বেশি বলা হবে না। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ঘটে যাওয়া সুখ, দুঃখ, বিরহ, ব্যথা কবি হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায় প্রতিনিয়ত। আর তাকেই উপজীব্য করেছেন কবিতার মাধ্যমে কতোগুলো কথামালা দিয়ে। এক একটি কবিতা যেন সমাজের এক একটা দর্পন। তিনি কবিতার মাধ্যমে পাঠকের হৃদয়ে এতটুকু হলেও স্থান করে নেয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন বেশ দক্ষতার সাথে। ‘বেনারসী বৃষ্টির জল’ কবিতায় কবি বেনারসী বৃষ্টি নামক যে চরিত্র তৈরি করে উপমার সাহায্যে একটি রোমান্টিকতায় পরিপূর্ণ এবং আধ্যাত্মিক ভাব ধারার এক প্রগাঢ় নৈপূণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। ‘পারো তো ছুঁয়ে দাও’ কবিতায় প্রিয়সীর সাথে মসকরায় অংশগ্রহণ করে বলেছেন ছুঁয়ে দেখতে আর তার পরিণতি কী হবে তাও কিন্তু ভেবে দেখতে। কবি তার কষ্টকে চেপে রাখার মধ্যে কোনো সুখ খুঁজে পান না বরং নিজেকে ভালো রাখতে পারলে সমাজের যাদের দায়িত্ব ভার বহন করছেন তাদের জন্য হলেও তো ভালো থাকতে হবে। কবি নিজেকে গালি দিতেও ভুলেন নাই ‘ভালো তোকে থাকতেই হবে’ কবিতায়। একটি বাস্তবসম্মত সত্যকে কবিতায় রূপদান তিনি সফলতার সাথে করেছেন। কবি ‘তিল’ কবিতায় প্রিয়সীর মনোমুগ্ধকর তিলক সদৃশ্য চোখ দু’টি কবিকে দিয়ে দিতে বললেন, বিনিময়ে কবি নিজেকে উৎসর্গ করতেও রাজি আছেন। ‘সময়ের কোলাজ’ কবিতায় কবি চারিদিকের প্রতিনিয়ত যে বিশ্বাস ও আস্থার সংকট চলছে তাকেই কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছেন। বর্তমান সময়ের বিরূপ অথচ বাস্তব সত্যকে তুলে ধরতে কবি বলেছেন অপাঙক্তেয়দের কোন দাবি কিংবা আবেদন থাকতে নেই। এক সময় অবস্থা খারাপ ছিল তখন কবির মূল্যানও ছিল, আর এখন অবস্থা ভালো হয়েছে বলে কবির প্রতি তার আগের মতো অনুরাগ নেই। তাই তো কবি ‘জেগে উঠেছে উতলা চর’ কবিতায় তার মনোকষ্টের কথা তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। ‘ভালো থেকো দুখিনী ভালোবাসা’ কবিতায় কবি তার প্রিয়জনকে মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিদায় দিয়েছেন, অনেক প্রতীক্ষার পর পেয়েও প্রিয়জনকে বিদায় দেয়া যে কতো কষ্টের, তা কেবল যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন তারাই বুঝতে পারবেন। আমরা পদ ও পদবীর পিছনে ঘুরে মানুষ যে কতো রকমের অন্যায়/অবিচার করতে বাধ্য হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তারই একটি চিত্র ‘জয় পাড়া থেকে জিন্দাগ্রাম’ কবিতায় কবি ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি নিজেও একজন সভাপতি একটি সংগঠনের, তবুও তিনি অনুভব করেন মানুষের মনের আবেগ। ‘সবটাই দেবো এনে’ এক ফোঁটা নিখাঁত সুখের আশায় তিনি সব কিছুকে উজাড় করে দিতেও প্রস্তুত। ‘তবু রাত কেটে যায় রাত’ কবিতায় কবি উলঙ্গ ইঁদুর কে উপমা হিসেবে ব্যবহার করেছেন, যারা স্বার্থপর এবং অন্যের ধন-সম্পদকে ভুলন্ঠিত করে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত, তাদেরকেই মূলত কটাক্ষ করেছেন।

এতো কিছুর পরেও যারা সবসময় বঞ্চিত, নির্যাতিত তাদের দিন ঠিকই কেটে যাচ্ছে হরহামেশায়, সেটা যতই কষ্টের দিন বা রাত হোক না কেন। ‘তোমার কারণে তুমি’ প্রিয়সীকে একটি ভালো অবস্থানে দেখতে কে না চায়? কবি নিজেও এর ব্যতিক্রম নয়, কিন্তু যাকে নিয়ে সুন্দর একটা পৃথিবী কল্পিত হয়ে আছে, সে যদি তা পায়ে ঠেলে ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো নিন্দনীয় পরিবেশে থাকতে চায়, তবে কবি কী আর করবেন, আফসোস্ করা ছাড়া আর কিছুই করার নাই! ‘তাকাও দেখো’ কবিতায় কবি প্রিয়সীকে কতটা ভালবাসেন, তা বুঝানোর জন্য এক প্রাণান্ত চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘ভালো নেই বলে’ কবিতায় কবি সমাজের এক শ্রেণির হীন স্বার্থপর লোকদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে, কিছু লোক আছে যারা কখনো কারো সুখে থাকা দেখতে পারেন না। কাউকে ভালো থাকতে দেখলেই নানা রকম ফন্দি/ফিকির ও কুচিন্তায় ভর করে সমাজকে অস্থিতিশীল করতে বদ্ধপরিকর। তাদের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। ‘তবে যাও’ প্রিয়জন যখন ভুল বুঝে দূরে চলে যেতে চায়, তবে তাকে ফেরানো খুবই দুষ্কর। তবুও প্রাণের আবেগে কবি সর্বশেষ চেষ্টা করছেন প্রিয়সীকে ফিরাতে। যদি সে না ফেরে তবে তার পরিণতি কত ভয়ানক খারাপ হতে পারে, সেটা বলার চেষ্টা করেছেন। তবুও যদি সে ফিরে আসে। ‘তবু কাঁদতে পারিনি’ কতিায় কবি প্রিয় শখের জিনিস হারিয়ে বাকরূদ্ধ হয়ে গেছেন বলে কাঁদতেও পারেননি। ‘তুমি তো ঈশ্বর সব দেখো’ কবিতায় কবি শাসক শ্রেণির লোকদের ব্যঙ্গ করেছেন, তারা চাইলে সবই পারেন, মানুষকে কষ্ট দিয়ে অথবা বঞ্চিত করে কখনো মুচকি হাসেন, কখনো হাততালি দেন, যা ইচ্ছা করেন। কারণ তারাতো ঈশ্বর। কবিতাটি বর্তমান সময়ের খুব আলোচিত কিশোর আন্দোলনের যে পটভূমি, তার সাথেও মিলে যায়; যদিও কবিতাটি অনেক আগের লেখা। আর এখানেই কবি মানসের স্বার্থকতা। ‘কষ্ট আছে পৃথিবী’ কবিতায় কবি বর্তমান পৃথিবীর নষ্ট রাজনীতির নোংরা ও কলুষিত আগ্রাসি মনেবৃতিকে দায়ী করে এক অপরিণামদর্শী চিত্র ফুটিয়ে তুলতে প্রয়াস পেয়েছেন। আর কবি নিজে সাক্ষী গোপালের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন, যেন কিছুই করার নেই। বর্তমানে কবিতার যে জরাজীর্ণ অবস্থা তার বেশীদিন স্থায়ী থাকবেনা, একদিন অকবিরা ঝড়ে পড়বে আর কবিরা পরম তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে টিকে থাকবে আনন্দের সাথে, আসবে সুদিন কবিতার সেটাই কবির প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন ‘ভালো নেই কবিতা’ নামক কবিতায়। ‘পিতা তখনো নিথর পড়েছিলো’ কবিতায় কবি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির সূর্যসন্তান-কে কিভাবে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল এবং তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করার পর, হত্যাকারীরা নিজেরা কে কী সুবিধা ভোগ করবে, তার মহড়া চলছিল। আর সে ঘটনা কতো যে মর্মান্তিক ও পাশবিক তারই একটা খন্ডচিত তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছেন কবি তার বিখ্যাত কবিতায়। উক্ত পাশবিক ঘটনা মুহুর্তে কবি বয়সে এতো ছোট ছিলেন যে, কাঁদতেও পারেননি। প্রতিশোধ নেয়ারও সুযোগ পাননি। ‘মানুষগুলো কি করে দানব হয়ে যায়’ কবিতায় কবি মানুষের দু’টি বিশেষ চারিত্রিক গুণাবলি’র যথা পাশবিক ও নির্মম খুন খারাবী করার মতো মনোবৃত্তি এবং অন্যদিকে ভালো মনোবৃত্তির স্বরূপ উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। কবি ভাবতেই পারেনা যে মানুষ কী করে এতো পাষাণ ও অমানবিক কাজ করে সমাজকে অস্থির করছে প্রতিনিয়ত। ‘নদীর একুল কাঁদে, কাঁদে ওকুলও’ দুনিয়ার চিরায়ত একটি সত্যকে ফুটিয়ে তুলেছে কবি তাঁর কবিতায়। নদী থেকে মানুষ কতো রকমের উপকার পেয়ে থাকে। উপভোগ করে নিজের প্রয়োজন মতো। কিন্তু নদীর যে কষ্ট লুকায়িত আছে, তা অধরায় থেকে যায়। কেউ সেটা উপলব্ধি করে না, এটাই নদীর সবচেয়ে বড় কষ্ট। ‘অসিয়ত’ কবিতায় কবি মৃত্যুর মতো নিদারুণ অথচ মর্মান্তিক ও ধ্রুব সত্যকে তুলে ধরেছেন কাব্যিকভাবে। মানুষ মরে গেলে কতো কী যে আয়োজন হয়। তবে সবি নিজেদের স্বার্থে। বিশেষ করে কোন সাম্রাজ্যবাদী নেতা হলে তো কথাই নেই। কবি নিজেকে সাম্রাজ্যবাদী ভাাবতে পছন্দ করেন না। তার মৃত্যুর পর অহেতুক ও অকারণে শোভাযাত্রা বা শোক র‌্যালি যেন না হয়, আর তিনি তা কখনো কামনাও করেন না। কারণ তিনি সাম্রাজ্যবাদী পেশী শক্তির বিরুদ্ধে কলম চালিয়েছেন বহুকাল। ‘ভোগ দখলের হিসেব নিকেশ’ মানুষ নিজের মতো করেই সব সময় হিসেব-নিকেশ করতে অভ্যস্ত, তা যাহাই ঘটুকনা কেন। তবে শত্রুপক্ষ অবশ্য সক্রিয় থাকে ফলাফল উল্টিয়ে দিতে। আর এতে কবির কোন আক্ষেপ নেই, কারণ তিনি তা ভালো করেই জানেন। দেশের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী কিছু তদন্ত হবে। আবার কখনো কখনো সেটা লোক দেখানোও হতে পারে। তবে কবি তার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে নেমে যারা মনগড়া প্রতিবেদন দিবে, তাতে তার কোন মাথাব্যাথা নেই, কষ্টও নেই। যেটা আমরা সমাজে প্রতিনিয়ত দেখছি, আর সেটা কবিকে ভাবিয়ে তুলছে। তিনি তার কাব্যিক নান্দকিয়তায় ফুটে তুলেছেন সমাজের এক বাস্তব পরিষ্ফুটন।

এছাড়াও আরো বেশ কিছু কবিতা রয়েছে বইটিতে, যা পাঠককে কিছুটা হলেও আলোড়িত করবে। সব কবিতাগুলি আলোচনা করলে লেখার কলোবর বেড়ে যাবে। তাই পুরো আমেজটা উপভোগ করতে কবিটার বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। আরো যা আছে-কবিতার শিরোনাম: ‘আমার জন্যই তোমাকে ভালোবাসা’ ‘নিরুদ্দেশ হলো যে’ ‘ঠিক তা নেই’ ‘অনুনয় ভালোবাসা’ ‘তুলতুলে শামুকের সাথে’ ‘আমি এবং অভিশাপই দেব’ ‘আদর করে আপন করেছি’ ‘নিষিদ্ধ প্রেমের উত্থান এবং’ ‘হাত ধরা হলো না যদিও’ ‘ভালোবাসার সেইসব দিনরাত্রী’ ‘পারো তো স্পর্শ করো’ ‘বেহায়া চোখে কান্নাহীন জল’ ‘বলো ভালোবাসি’ ‘রাতভর ভাবনা শেষে’ ‘এখনো আছে সময়’ ‘তুমি এমনই রয়ে গেলে’ ‘চারিদিকে কষ্টের প্রতিচ্ছবি’ ‘অভিমানী ভুল যে ছিল’ ‘বর্ষা আসার বয়সে, ‘তুমি পেলে চাঁদের কঙ্কাল’ ‘যুদ্ধে বসবাস’ ‘তুমি তোমাকে সাজিয়ে নিও’ ‘বিন্দু বিন্দু সুখ ফোঁটা’ ‘তার সব পুড়েছে’ ‘তুমি কোনো প্রেতাত্মা না হলে’ ‘পৃথিবীর মালিকানা’ ‘ঠিকানা নিও’ ‘বলে দিলাম হেরে গেলে যথা নিয়মে’ ‘এক চিলতে আধীর অক্ষমতা’ ‘কতো নিবিড় সে কষ্টের বাসা’ ‘আমি মানুষ নাকি ছাই’ স্মৃতিগুলো তোমারই হবে’ ‘কবিতাগুলো’ ‘সখ্যতা হলো বলে’ ‘নিলর্জ্জ নগ্নতা’ ‘রাত এবং আমি’ ‘শিলা কুড়োতেই সুখ’ ‘এভাবেই যতো বেঁচে থাকা’ ‘পদকের বাজার’ ‘এ এক নিদারুণ শূণ্যতা’ ‘হাহাকার’ ‘আমার অজান্তে তোমার বাস’ ‘কথা একটাই’ ‘তারপর’ ‘কঙ্কালসার সেই মানুষটি’ ‘ভালো থেকো কবিতা’।

এতে মোট কবিতার সংখ্যা: ৮৪টি; বইটিতে পৃষ্ঠার সংখ্যা-৮৫; প্রচ্ছদ করেছেন-সাফিক ডিয়ার; বিনিময় মূল্য রাখা হয়েছে-২০০/-; গ্রন্থটিতে মতামত লিখেছেন-অধ্যাপক ড. নীলিমা চৌধুরী (কবি ও রবীন্দ্র গবেষক) এবং আনিসুল হক (কবি ও ছাড়াকার), প্রকাশনার দায়িত্ব পালনে-জাতীয় কবিতা পরিষদ, বিভাগীয় শাখা, রংপুর। পরিশেষে, কবি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপমার আশ্রয় নিয়েছেন। যা কবিকে এক স্বতন্ত্র মহিমায় উপনিত করেছে। গুনেধরা সমাজের নানান নৈতিক চরিত্রের স্খলন কবিকে তাড়িত করে ফেরে। কবি নিজের অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে যা দেখতে পেয়েছেন, তাকেই উপজীব্য করেছেন কবিতায়। নিজেকে আড়াল করার প্রাণান্ত চেস্টা কবির এক নতুন বৈশিষ্ট পাঠক মনে নাড়া দিবে, যা কবিকে সুদীর্ঘকাল পাঠক হৃদয়ে স্থান করে নেয়ার সুযোগ পেয়েছেন নিস্বার্থভাবে। কবি ব্যর্থ প্রেমিকের মতো নিজেকে পর্দার আড়ালে রাখতে ব্যর্থ হয়ে অনিচ্ছা সত্বেও উজাড় করার সম্যক প্রয়াস এক নান্দনিক সোন্দর্যের অবগাহনে কাব্যিকতায় পাঠকের জন্য তুলে ধরার এক সফল পথভ্রমণের চেষ্টা জাগরূক থাকুক অনন্তকাল। পাঠকের মনে দোলা দিলেই কবিমন স্বার্থকতায় পরিপূর্ণ হবে বলে মনে করছি। পাঠক ও কবির মেলবন্ধন রচনার পথ সুগম হোক, সেই প্রত্যাশায় আজকে রাখলাম।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
গ্রন্থ আলোচনা,বেনারসী বৃষ্টির জল
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close