এস আর শানু খান

  ০৪ আগস্ট, ২০১৮

বিমানবন্দরে একদিন

২০১১ সালের ডিসেম্বরের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিশন দিতে কিছুদিনের জন্য রাজধানী ঢাকার শরণাপন্ন হয়েছিলাম। ঢাকার কথা শুনলেই কেমন যেন আলাদা একটা এক্সপ্রেশন কাজ করে যারা যায়নি । যাওয়ার পরেও অবশ্য এক্সপ্রেশন তবে আগের চেয়ে একটু ভিন্ন। আমার ভাইয়া ও ভাবী গাজীপুরের গার্মেন্টস শ্রমিক। দু’জনেই গার্মেন্টেসে কাজ করতো। আমি ফোনে বলা ভাইয়ার নির্দেশনা অনুযায়ী পৌঁছালাম বোর্ড বাজার গাজীপুর। ভাইয়া ওখান থেকে আমাকে নিয়ে গেলো। ভাইয়াকে পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি খুব নার্ভাস ফিল করছিলাম। আমার ভাইয়া লেখাপড়ার ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলেন। দু’দিন পরে পরীক্ষা। ভাইয়া ও ভাবী আমাকে তাদের বাসায় পেয়ে খুব খুশী হলেন। আমাকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভাই অফিস থেকে চার দিনের ছুটি নিয়েছিলেন। আমার ভালোই মনে আছে দিনটি ছিল শূক্রবার। পরীক্ষা সকাল ৯টায়। আমার সিট পড়েছিল ”শেখ বোরহার উদ্দিন পোস্টগ্রাজুয়েট কলেজে”। আমি আর ভাই খুব সকালে বের হলাম। গাজীপুর থেকে যেতে হবে বিধায় আগেই রওনা হলাম। ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না দুরত্বটা। কেননা গাড়ি কেমন যেন জাগায় দাঁড়ায় চলছিলো। যাইহোক, বহু চিন্তা ও বহু প্রতীক্ষার পরে খুঁজে পেলাম ”শেখ বোরহার উদ্দিন পোস্টগ্রাজুয়েট কলেজ”। গেট তখনও খোলেনি। আমি ভাইকে বললাম একটু মাইনাস করা লাগবে। ভাই আমাকে একটু এগিয়ে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে কাজ সারতে বললেন। আমি গেলাম চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। আশে পাশে মানুষের সমাগম। পারলাম না। ভাই কোনও উপায় না পেয়ে আমকে নিয়ে একটু এগোতে লাগলেন।একটা এটিএম বূথের গার্ডকে ভাই অনেক অনুরোধ করে রাজি করালেন। আমি আর ভাই জৈবিক চাহিদাটা সেরে নিলাম। প্রতিটা কাজ যেন কেমন করে ঢাকা সম্পর্কে ধারণাটা পাল্টে দিতে লাগলো। এত বড় ঢাকা শহর তাও আবার দেশের রাজধানী। আর সেখানে যদি এমন হয়। পরীক্ষা শেষ করে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম একটা হোটেল থেকে। পরে জগন্নাথের পরীক্ষা শেষ করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম দুজনে। সারাদিনের গরম ও গাড়ির শব্দ শুনতে শুনতে মাথা ধরে গিয়েছিল। সারা পথ বমি করতে করতে সাড়ে ১১টায় বাসায় পৌঁছালাম আমরা। কিভাবে যে রাত কেটে গেল জানিনা জেগে দেখি ১২টা বাজে।

ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা খাওয়ার পর ভাই বললেন, চল ঘুরে আছি। আমি বললাম আমি কমলাপুর রেল স্টেশনে যাবো।ভাইয়া রাজি হয়ে গেল। পরেরদিন সকালে আম্মু আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, আমার আর এক ভাই একজনকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্ট আসছে গাড়ি ভাড়া করে। আমি বললাম আম্মু আমি তাহলে ওদের সাথে চলে আসবো। ঐ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হলাম। আমার ভাইতো রাজি না আরও কিছু দিন থাকতে হবে এটা তার বায়না। আমি রাজি হলাম না । পরে ভাই আমাকে টাকা দিয়ে জানতে চাইলেন, আমি কি একা যেতে পারবো এয়ারপোর্ট? আমি বললাম পারবো। আমি বের হয়ে গেলাম বাসা থেকে। চলে গেলাম এয়ারপোর্ট। জীবনের প্রথম কোনও এয়ারপোর্ট বা কোনও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গেলাম। খুব ভালো লাগছিল। এয়ারপোর্টেও ভিতরে ঢুকে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করতে লাগলাম। কিছু সময় পর সেই ভাইকে ফোন দিলে সে জানালো এক দেড় ঘন্টার মধ্যে এয়ারপোর্ট পৌঁছে যাবে গাড়ি নিয়ে। আমার ঘাড়ে বড় একটা ব্যাগ। খুব ভারী। ব্যাগের ভিতর কিছু বই ও আমার কাপড় চোপড়। এয়ারপোর্টের ভিতরের অদেখা জিনিসগুলো দেখতে লাগলাম। এক জায়গায় দেখলাম কিছু লোক পেপার পেতে পেতে বসে আসে। আমি তাদের দিকে এগোলাম। তাদের মধ্যেও একজন আমাকে খালি জায়গায় বসতে দেখে একটা পেপার দিলো আমি বসলাম তার উপর। তাদের কথাবার্তা আর হাহাকার দেখে বুঝতে আর বাকি রইলো না যে তারা দালালের ছলচাতুরিতে ধরা পড়েছে। ৩/৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে ১৪/১৫ দিন এনাদের ৩ জনকে এয়ারপোর্টের বারান্দা দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। জীবনের শেষ সম্বল বাড়ির জমি বিক্রয় করা টাকা। কোনও উপায় না পেয়ে বেঁচে থাকার জন্য ফোনে দালালের কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করে শেষ চেষ্টাটুকু করছে।

কিছু সময় থাকার পর ক্ষিদে অনুভূত হওয়ায় ব্যাগটা কাঁধে বাধিয়ে উঠে পড়লাম। বের হয়ে আসলাম এয়ার পোর্টের গেটে। ১৫ টাকা দিয়ে একটা রুটি নিলাম। বিল পরিশোধের আগেই আমার হাত থেকে নিয়ে কালো ছোট বস্তা কাঁধে একটা পিচ্ছি দৌড়ে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকলাম। টাকা শোধ করে একটু এগিয়ে লক্ষ করলাম সেই পিচ্ছিটাকে। দেখলাম দুরে গিয়ে বস্তাটার উপর বসে রুটিটা খাচ্ছে। দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। রুটি খেতে আর মন চাইলো না। কেন যেন মনে হচ্ছিল আমারও খাওয়া হয়ে গেছে। খুব ভালো লাগছিল নিজের মধ্যে। একটু পরে ফ্রিজ থেকে একটা হাফ লিটারের প্রাণ ফ্রুটো নিলাম। ভাবলাম একটু এগিয়ে গিয়ে খাই। একটু এগোতেই চোখে পড়লো একটা পিচ্ছি রোডের পাশে জমে থাকা ময়লা আবর্জনা থেকে কি যেন খুটে খুটে বস্তায় রাখছে। আর একটু এগিয়ে গেলাম ভালভাবে দেখার জন্য। একটু আনমনা হয়ে বোতলেই মূখ খুলে একবার খাওয়ার পরই আমার বোতলটা ধরে বসলো সেই পিচ্ছিটা তার দিকে তাকাতেই ছেড়ে দিয়ে বললো খাওয়া হলে বোতলটা তাকে দিতে। আমি দেখতে পেলাম বোতলের গায়ে তার হাতের ময়লা লেগে ফ্রিজের পানির সাথে মিশে একটা ভাল কালার তৈরি হল বোতলের গায়ে। আমি দিয়ে দিলাম তাকে। আমার এক জামাইর কাছে শূনেছি এয়ারপোর্টে নাকি দুনিয়ার চিটার বাটপারের আখড়া। তিনি আরও বলেছিলেন গ্রামের মানুষ দেখলে নাকি তারা বুঝতে পারে। এয়ারপোর্টে টাকা চাওয়া লোকের অভার নেই ইনশাআল্লাহ। জানিনা এটা কোন ব্যাবসা নাকি পেশা নাকি কোনও প্রতিযোগিতা। একজনকে দিতে গেলে আরও দু’তিন জন হাজির হয়। কারও কোথাও কোনও ক্ষত নেই অথচ কপালে একটা সাদা টেপ । কারও বা রক্তের চিহ্ন নেই আবার ব্যান্ডেজ । ৫/১০ টাকা করে দিতে দিতে প্রায় ২০০ টাকা দিয়ে ফেললাম ঐটুকু সময়ে তবুও যেন কমছে না তাদের সংখ্যা। কেউবা অতিষ্ঠ হয়ে বকা দিচ্ছে ধমক দিচ্ছে । খাওয়ার স্বাদ আমার এখানেই মিটিলো। আস্তে আস্তে আবার ভিতরে গেলাম। জামাইর কথা মনে করে নিজে একটু চালাক চালাক ভাব নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমাকে যেন আরও বেশি বোকা লাগছিল। সেই ভাইকে ফোন দিতে চেষ্টা করলাম সুইচ অফ দেখালো। আবার একটু হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। সোজা হয়ে হাঁটতে পারছিলাম না। ঘাড়ের ব্যাগটা কেমন যেন পিছন দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো। সাথে সংগ্রাম করে চলতে হচ্ছিল আমাকে। কেউবা ফুলের মালা নিয়ে বরণ করছে, বুকে টেনে নিয়ে আদর করছে, কেউবা জড়িয়ে ধরে বিদায় জানাতে গিয়ে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। এয়ারপোর্টেও মসজিদের দিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দুটো লোক আমাকে ফলো করতে করতে আমার দিকেই আসলো। এসে আমার কাছে দাঁড়িয়ে পড়লো। কথা বলছে না। আমার ভর করছিল। হঠাৎ একটা দুজনের একজন আমার ব্যাগের চেইন ধরে টান দিলো। আমি বললাম ভাই আপনাদের কি সমস্যা? কিছু বললো না। আমি ওখান থেকে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালাম গাড়ি পার্কিং এর জায়গায় দায়িত্বে থাকা লোকটার কাছে। আমি উনাকে আমার ব্যাপারটা বললাম। উনার সাথে অনেক কথা বলতে লাগলাম। কিছু সময় পর উনি আমাকে বললেন, যাও সমস্যা নেই। দুই নম্বর গেটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো দেখবে তোমার ভাইয়াকে পেয়ে যাবে। বিকাল ৫টায় পেলাম দুই ভাইয়াকেই। পরে এক হোটেলে গিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে রওনা হলাম বাড়ির উদ্দেশে। রাত আড়াইটায় বাড়ি পৌঁছালাম। আর কখনও যাওয়া হয়নি এয়ারপোর্ট। ভেবেছি এখন মোটামুটি একটু চালাক হয়েছি। একদিন এয়ারপোর্ট যাবো। নতুন করে দেখবো সব মানুষগুলোকে।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিমানবন্দর,একদিন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist