রফিক আহমদ খান, ফ্রিল্যান্স লেখক

  ২৬ জুলাই, ২০১৮

'ক্রিস্টাল গোল্ডের' পারকি সমুদ্র সৈকত

একঘেয়েমি কাটাতে কিছুদিন পর পর মুক্তবাতাসে ঘুরতে না গেলে মন-মেজাজ ফুরফুরে হয় না। শরীরে মুক্ত হাওয়া লাগানোর জন্য সমুদ্র সৈকতের মত ভালো জায়গা আর কী হতে পারে। হোক না সেটা চেনাজানা জায়গা। বার বার যাওয়া জায়গা। আমাদের জন্য এমনই এক জায়গা 'পারকি সমুদ্র সৈকত।'আমাদের পাশের ইউনিয়নেই বঙ্গোপসাগরের উপকূলে পারকি সমুদ্র সৈকত ও পারকি ঝাউবাগান।

এই তো সেদিন স্বস্ত্রীক ঘুরতে চলে গেলাম চেনাজানা পারকি সমুদ্র সৈকতে। সৈকতের বালুচরে মৃদুপায়ে হেঁটে হেঁটে শরীরে সাগরের মুক্ত হাওয়া মেখে এলাম। আমরা যখন সৈকতে গিয়ে পৌঁছি তখন জোয়ার ছিলো। বালুচর ভেজা ভেজা। কারণ, একটু আগে জোয়ারের পানি আরো বেশি ওপরের দিকে ছিল। ভেজা বালুতে পায়ে পায়ে হাঁটতে সত্যিই অন্যরকম অনুভূতি জাগে। পায়ের ছাপে ভেজাবালুতে পায়ের চিহৃ হয়ে মুহূর্তেই দাগ মিলিয়ে সমান হয়ে যায়। দেখতে ভালোই লাগে।

দিনটি ছিলো একুশে বৈশাখের বিকেল, কিছুটা মেঘলা আকাশ। সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ; ঢেউগুলো অদূর সমুদ্র থেকে খেলতে খেলতে এসে গড়িয়ে পড়ছে সৈকতের বালুচরে জলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের পায়ে। হাজারো নারীপুরুষ পর্যটক পা ভেজাচ্ছেন সমুদ্রের ঢেউয়ের লোনাজলে। শিশু কিশোর আর নারীদের আনন্দের ঢেউ আর সমুদ্রের ঢেউ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কেউ কেউ হাঁটুজলে নেমে জলের সাথে খেলছে। কেউ কেউ লোনাজলে স্নান করছে মনের সুখে। কেউ বা দূর সমুদ্রের পানে তাকিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সৈকতে পর্যটকদের ছবি তুলে জীবিকানির্বাহ করা তরুণদের ক্যামরার ক্লিক ক্লিক চলছে চারিদিকে। সেলফি তো আছেই।

দিনটি শুক্রবার হওয়ায় নারীপুরুষ শিশুকিশোরে মুখরিত পারকি সৈকত। আসলে যে কোনো পর্যটন এলাকায় গেলে চারিদিকে উল্লাসিত মানুষের মুখ দেখলে যে কোনো মানুষেরই মনের কালো মেঘ ক্ষণিকের জন্য হলেও উধাও হয়ে যায়। ফুরফুর হয়ে ওঠে মনমেজাজ। পারকি বীচের অন্যতম বিশেষত্ব হলো এখানে সৈকতের বালুচরে দাঁড়িয়ে দূর সমুদ্রে বড় বড় জাহাজ দেখা যায়; যা কক্সবাজার সৈকত থেকে দেখা যায় না। এখানে বহির্নোঙরে সমুদ্রজলে ভাসতে থাকা অসংখ্য জাহাজ দেখা যায়। যে জাহাজগুলো পৃথিবীর বহু দেশের বহু বন্দর ঘুরে আসা। বলতে পারি, নোঙরে থাকা জাহাজগুলো ছুৃঁয়ে এসেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বড় বড় সাগর মহাসাগর উপসাগরের জল। এই জাহাজগুলোর নাবিকের জন্য এই বহির্নোঙর কারো জন্য স্বদেশের জল, আবার কারো জন্য বিদেশের জল।

পারকি সমুদ্র সৈকতে আট একর এলাকাজুড়ে রয়েছে ঝাউবাগান। সারি সারি অসংখ্য ঝাউগাছ শুকনো বালিতে শেকড় ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝাউবাগান ঘেষে আছে ছোট ছোট অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট; আর ঝাউগাছের ফাঁকে ফাঁকে আছে রেস্টুরেন্টগুলোর পাতানো চেয়ার-টেবিল। আরেক পাশে বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠেছে পুকুর, ঝাউগাছ, ফুলবাগান, বাঁশের সেতু, রেস্টুরেন্ট ও রিসোর্টসহ পিকনিকের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে 'লুসাই পার্ক' নামে মনোরম একটি স্পট।

এই পারকি সমুদ্র সৈকত যেমন প্রকৃতি প্রদত্ত, তেমনি বিশাল একটি জাহাজ প্রকৃতি ঠেলে এনে বসিয়ে দিয়েছে সৈকতের বাম পাশের বালুচরে। দুই হাজার সতের সালে ঘূর্ণিঝড় 'মোরা'র আঘাতে 'ক্রিস্টাল গোল্ড' নামে বিশাল বড় একটি জাহাজ আটকা পড়েছিলো পারকি সৈকতে। সেটি-ই হয়ে ওঠেছে পারকি সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের অন্যতম আর্কষণের বিষয়। আমরা যারা দূর থেকে বহির্নোঙরে বড় জাহাজ দেখি, তা কেবল ভাসমান জাহাজের ওপরের অংশটাই দেখি। কিন্তু, পারকির বালুচরে আটকে থাকা জাহাজটি একেবারে নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ একেবারে আস্ত একটি বিশাল জাহাজ চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যে জাহাজের পাশে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে একটু দূর থেকে দেখে পিঁপড়ার সমান দেখাচ্ছে। সব পর্যটকই ছবি তুলছেন 'ক্রিস্টাল গোল্ড' নিয়ে। আমিও মন ভরে দেখলাম জাহাজের বিশালত্ব। ছোট বেলায় শুনতাম, কারো ঘর খুব বড় হলে মানুষ চাঁটগা ভাষায় বলতেন 'জাহাজ পান ঘর' (জাহাজের সমান ঘর)। ঘরের আকারের বিশালত্ব বোঝানোর জন্য কেনো জাহাজের উদাহরণ দিতেন সেটা বোঝলাম পারকি সৈকতে বিশাল বড় 'ক্রিস্টাল গোল্ড' জাহাজটি দেখে।

পারকির পর্যটকদের জন্য বাড়তি সুবিধা হচ্ছে সেখানে যাওয়ার সময় আপনি দেখতে পাবেন দেশের অন্যতম বড় সারখানা 'সিইউএফএল' ও 'কাফকো'। কর্ণফুলী তৃতীয় সেতু দিয়ে আসলে আপনি যাবেন কোরিয়ান ইপিজেট এর পাশ দিয়ে। আপনি দেখতে পারবেন-জানতে পারবেন কর্ণফুলী টানেল এপাড়ে কোথায় উঠবে, দেখবেন চীনা অর্থনৈতিক জোনের দু'পাশে ধানী জমির মাঝ দিয়ে নবনির্মিত বিশাল সড়ক। পারকি সৈকতে যাওয়া-আসার পথটিও অসাধারণ সুন্দর। সিইউএল আর আগের থেকে পারকি পর্যন্ত সড়কের দুপাশে আছে অসংখ্য গাছ। এই গাছের ভিড়ে মাঝে মাঝে ফোটে আছে লাল-টুকটুকে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল। কোথাও বা সোনালু ফুল। সিইউএফল কলোনির পর থেকেই পথ চলতে চলতে পশ্চিমে সারি সারি ঝাউগাছ। আর চোখ দুটো ঝাউ গাছের ওপরে একটু দূরে তাকালে সমুদ্র দেখা যায়। সড়কের পূর্বে উপকূলীয় মানুষের ঘরবাড়ি ও জমি। পারকি বাজারের পর একটু আঁকাবাঁকা পথ দেখে কিছু ভিন্নতা ভাব লাগে। এ সবকিছু দেখতে দেখতে পারকি সমুদ্র সৈকতে গিয়ে মুক্ত হাওয়া গায়ে মেখে ভালোই লেগেছে। ঝাউবাগান, অর্ধেক শুকনো অর্ধেক ঢেউয়ের জলে ভেজা বালুচর, ক্রিস্টাল গোল্ড, লুসাই পার্ক, সমুদ্রের ঢেউ, সামনে বিশাল সমুদ্র আর অদূরে ভাসমান জাহাজ - সব মিলিয়ে খুব আনন্দময় পারকি ভ্রমণ। মন ভালো করার মত একটি জায়গা।

কোথায় এবং যাবেন কীভাবে

যারা 'পারকি সমুদ্র সৈকত' কোথায় জানেন না তাদের জন্য বলছি, এটি হলো বন্দর নগরী চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার পশ্চিমাংশে। অর্থাৎ কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরের পশ্চিম পাশে। চট্টগ্রাম শহর থেকে আপনি যেতে পারেন কর্ণফুলী নদীর পতেঙ্গা পনের নম্বর ঘাট পেরিয়ে। আবার যেতে পারবেন তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু দিয়েও। যদি দক্ষিণ চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার থেকে আসেন, তাহলে ক্রসিং থেকে আনোয়ারার পথ ধরে চলবেন। আর ঢাকা থেকে কেউ যদি বিমানে আসেন, তার জন্য তো ভীষণ সহজ। শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে কর্ণফুলীর পাড়ে একটু বামে এগিয়ে গেলেই মিলবে পনের নাম্বার ঘাট। ওপাড়ে গিয়ে সিএনজি বা অটোরিকশায় পনের বিশ মিনিটে যাওয়া যায় পারকি সমুদ্র সৈকতে।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ক্রিস্টাল গোল্ড,পারকি,সমুদ্র সৈকত
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist