রায়হান আহমেদ তপাদার
অশোভন বার্তায় ইন্টারনেট
ইন্টারনেট ব্যবহার করে যে অপরাধ করা হয়, তাকে সাইবার ক্রাইম বলে। উন্নত বিশ্বে সাইবার অপরাধকে অপরাধের তালিকায় শীর্ষে স্থান দেওয়া হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে সাইবার অপরাধীদের জন্য নতুন নতুন আইন। বর্তমান বিশ্বে বহুল আলোচিত কয়েকটি সাইবার ক্রাইম হলো—এক. সাইবার পর্নোগ্রাফি, দুই. হ্যাকিং, তিন. স্প্যাম, চার. বোমাবাজি, পাঁচ. অ্যাকশান গেম ইত্যাদি। বাংলাদেশে সাইবার ক্রাইমের পরিচিতি বা এ-সংক্রান্ত অপরাধ দমনের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনটি অনেকেরই জানা নেই। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ আমাদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়। এই আইনে ইন্টারনেট অর্থ এমন একটি আন্তর্জাতিক কম্পিউটার নেটওয়ার্ক-যার মাধ্যমে কম্পিউটার, সেলুলার ফোন বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতি ব্যবহারকারীরা বিশ্বব্যাপী একে-অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্যের আদান-প্রদান এবং ওয়েবসাইটে উপস্থাপিত তথ্য অবলোকন করতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি জনসাধারণের বা কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে বা ক্ষতি হবে মর্মে জানা সত্ত্বেও এমন কোনো কাজ করেন-যার ফলে কোনো কম্পিউটার রিসোর্সের কোনো তথ্যবিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তিত হয় বা তার মূল্য বা উপযোগিতা হ্রাস পায় বা অন্য কোনোভাবে একে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এমন কোনো কম্পিউটার সার্ভার কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করার মাধ্যমে এর ক্ষতিসাধন করেন, যাতে তিনি মালিক বা দখলদার নন, তাহলে তার এই কাজ হবে একটি হ্যাকিং অপরাধ।
ইন্টারনেটের ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি অনলাইনে শিশুদের নিরাপদ রাখার চ্যালেঞ্জ ও অনলাইনের হুমকি থেকে তাদের সুরক্ষিত রাখার গুরুত্বও বাড়ছে। দেশের ৪৯ শতাংশ স্কুলশিক্ষার্থী সাইবার বুলিং বা ইন্টারনেটে অশোভন বার্তা পাওয়ার মতো ঘটনার শিকার হচ্ছে। দেশের শীর্ষ সেলফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের সিংহভাগ শেয়ারের মালিক টেলিনর। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোয় ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী ১ হাজার ৮৯৬ শিক্ষার্থীর মধ্যে ইন্টারনেটবিষয়ক জ্ঞান নিয়ে জরিপ চালানো হয়। এর ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। টেলিনরের হেড অব সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি ওলা জো বলেন, নিরাপদে ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে টেলিনর। বিশেষ করে শিশু ও তরুণদের মধ্যে এটির গুরুত্ব রয়েছে। টেলিনরের দেশভিত্তিক এ গবেষণা ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি ইতিবাচক মা-বাবা ও শিক্ষকদের নিরাপদ ইন্টারনেটের গুরুত্ব বোঝার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। পাশাপাশি এ গবেষণা, মা-বাবাকে শিশুদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা এবং এই নিয়ে তাদের পরামর্শ দেওয়ার বিষয়ে উৎসাহ জোগাবে।
সাইবার বুলিংসহ ইন্টারনেট সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে স্কুলশিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করে টেলিনর এ গবেষণা করে। এতে বলা হয়, শিশুদের ইন্টারনেটে সহজে প্রবেশাধিকারের কারণে মা-বাবার কাছে আলোচিত ও শঙ্কার একটি বিষয় হচ্ছে সাইবার বুলিং। বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ স্কুলশিক্ষার্থীর একই ব্যক্তি দ্বারা উৎপীড়নের শিকার হওয়া অথবা অনলাইনে উত্ত্যক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাংলাদেশের ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তারা অনলাইনে অশোভন কোনো বার্তা পাঠাবে না। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অভিভাবকদের এই নিয়ে শিশুদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা, আলোচনা করা ও অনলাইনে এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলে যেন শিশুরা তাদের মা-বাবার কাছে সাহায্য চাইতে পারে-এ ধরনের পরিবেশ তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারীর মধ্যে ৭৩ শতাংশ নানা ধরনের সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে এবং ৪৯ শতাংশ স্কুলশিক্ষার্থী সাইবার হুমকির শিকার। তবে ২৩ শতাংশই অভিযোগ করে না। ইন্টারনেট ব্যবহার করে কিছু পোস্ট করাই স্মার্টনেস নয়, স্মার্টনেস হচ্ছে নিজেকে নিরাপদ রাখা।
ইন্টারনেটের দুটি দিক আছে—একটি গঠনমূলক, অপরটি ধ্বংসাত্মক। গঠনমূলক দিকটি শিক্ষার্থীদের সমৃদ্ধ করবে, জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর জন্য অবশ্যই ইন্টারনেটের ব্যবহার প্রয়োজন। একই সঙ্গে দেশ ও সমাজকে নিরাপদ রাখার দায়িত্বও সবার। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে লাভবান করেছে সত্যি; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তরুণদের একটি বড় অংশ এর অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের মেধা ও যোগ্যতার অপচয় করছে। আমরা যদি ফেসবুকের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব তারা এক ধরনের একাকিত্বে ভুগছে, সমাজের বাস্তব ও মূলধারার সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি করে ফেসবুকের বন্ধু-বান্ধবী, ফেইক বন্ধু ও বান্ধবীদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাচ্ছে। সারা রাত এ কাজ করতে করতে অনেকেই ক্লাস মিস করে কিংবা ক্লাসে উপস্থিত হলেও মনোযোগী হতে পারে না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজশিক্ষার্থীদের মধ্যে এ প্রবণতা যেন আরও বেশি। বিষয়টি তাদের অলস, কর্মবিমুখ ও বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে তারা মাদকেও আসক্ত হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে। এসব বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, অভিভাবক ও জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। ডিজিটাল যুগে তাদের ভূমিকাও ডিজিটাল হতে হবে, শুধু ট্র্যাডিশনাল দায়িত্ব পালন করলে চলবে না।
আমাদের মতো শুধু উন্নয়নশীল দেশই নয়, উন্নত বিশ্ব ও শিল্পোন্নত দেশও সাইবার হামলার শিকার হয়। আমরা একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টির ভয়াবহতা অনুমান করতে পারি। দক্ষিণ কোরিয়ায় ইংরেজি শিক্ষার সবচেয়ে জনপ্রিয় লিডারস এডুর ওয়েবসাইটটি হ্যাক করেছে চীনারা। এখন পর্যন্ত হওয়া সবচেয়ে বড় সাইবার হামলাটি হয়েছে গেল মার্চের প্রথম সপ্তাহে। ওই সময় চীনা হ্যাকাররা দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে বড় রিটেইলার লোটের ডিউটি ফ্রি শপের ওয়েবসাইটে হামলা করে। এতে প্রতিষ্ঠানটির কোরীয়, ইংরেজি, চীনা ও জাপানি ভাষার চারটি ভার্সনের ওয়েবসাইট বন্ধ হয়ে যায়। এতে চীনে লোটে মার্টকে প্রায় ৪ লাখ ৩১ হাজার ডলার লোকসান গুনতে হয়। এমনকি হামলার ব্যাপ্তি এতটাই ছিল যে, প্রতিষ্ঠানটি এর ওয়েবসাইট সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
হ্যাকাররা সাধারণত দুইভাবে এ হামলা পরিচালনা করছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে এর সৌন্দর্যহানির মাধ্যমে তারা হামলা করছে। এতে সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটের অ্যাপিয়ারেন্স বদলে যায়। পাশাপাশি কনটেন্টসহ বিভিন্ন ধরনের বিকৃতি ঘটানো হয়। ফলে ওয়েবসাইটটির নিয়মিত ট্রাফিক আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। এছাড়া আরেক ধরনের হামলা করা হয়, যাকে ‘ডিস্ট্রিবিউটেড ডিনাইয়াল অব সার্ভিস’ সংক্ষেপে ডিডস নামে অভিহিত করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন অনলাইন সার্ভিসের প্রাপ্যতায় ব্যাঘাত ঘটানো হয়। এই দুই ধরনের হামলাই করা হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়ানোর উদ্দেশ্যে। কোরিয়া ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ইনফরমেশন সিকিউরিটির অধ্যাপক লিম জং-ইন বলেন, হ্যাকাররা যদি ব্যাংক, বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন গণঅবকাঠামোর ওপর হামলা শুরু করে, তাহলে এটি একটি বড় সংকটের সৃষ্টি করবে। এতে ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হবে, যা দুই দেশকে সাইবার যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
এসব নতুন নতুন সামাজিক সমস্যা গোটা বিশ্বের সমাজ বিজ্ঞানী ও ধর্মীয় নেতাদের ভাবিয়ে তুলছে। এসবের সমাধানও খুঁজছেন। যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে বা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো
ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। তাই আমাদের প্রজন্মদের জন্য প্রগতির এই উৎকর্ষের ব্যাপারে সবারই সতর্ক থাকার এখনই সময়।
লেখক : কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য প্রবাসী [email protected]
পিডিএসও/হেলাল