ডা. এস এ মালেক

  ২৭ আগস্ট, ২০১৯

ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু

১৫ আগস্ট হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কালদিন। ওইদিন প্রত্যুষে বাংলার আকাশে-বাতাসে যে মহাদুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দিয়েছিল, তা থেকে বাংলাদেশ আজও মুক্ত নয়। স্বাধীনতাবিরোধী শকুনরা সেই থেকে আজ পর্যন্ত সুযোগ পেলেই ছোবল মারছে।

আগস্ট এলেই আমরা আতঙ্কিত হই। ১৫ আগস্টই ওদের শেষ আঘাত নয়। এই আগস্ট মাসেই ওরা ঘটিয়েছে ২১ আগস্টের মতো গ্রেনেড হামলা। ওইদিন ওদের লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। যিনি তার মহান পিতার অসমাপ্ত কাজ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন। ওদের কাছে বঙ্গবন্ধুর অপরাধ ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন করা। ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তানের সমাধির ওপর জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করা। সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত করা। স্বৈরাচারের বিকল্প হিসেবে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। শোষকের দুর্গ পাকিস্তান ভেঙে শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। উৎপাদন ও বিতরণ ক্ষেত্রে শুধু অগ্রগতি নয়, সমতাভিত্তিক সমাজ গঠন।

আসলে ১৫ আগস্ট তারা শুধু ব্যক্তি মুজিবকে হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি। তারা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল যাতে করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আর কেউ এগোতে না পারে। তাই নাবালক পবিত্র রাসেলকেও তারা রেহাই দেয়নি। ওদের ধারণা ছিল, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যা করতে পারলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনকেও হত্যা করতে সক্ষম হবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বঙ্গবন্ধুর চাইতে তার দর্শন যে কত শক্তিশালী তা আজ বাংলার প্রত্যেক মানুষ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে।

হত্যার পরপরই খুনি মোশতাক ও তার দোসররা প্রচার করে ছিল যে, ক্ষমতালোভী, দুর্নীতিবাজ, অসৎ, স্বৈরাচারী শাসক শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধু সরকারের দুর্নীতি ও অনিয়মতান্ত্রিকতা ও দায়িত্বহীনতার অনেক গল্প-গুজব প্রচার করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তার বিপুল সম্পত্তির মালিকানার কথা। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল, বঙ্গবন্ধুই বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে দরিদ্রতম শাসক। প্রমাণিত হয়েছে দুর্নীতি বলতে যা বোঝায় তা কখনো বঙ্গবন্ধুকে স্পর্শ করতে পারেনি। বাঙালির প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধ তার হৃদয়কে সামগ্রিকভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তাই দুর্নীতির স্পৃহা তার কাছে ছিল একেবারেই অকল্পনীয়। তিনি তার জীবন বাজি রেখে বারবার ফাঁসির মঞ্চে উঠেও বাঙালির জয়বাংলা স্লোগানে বাংলার আকাশ-বাতাস মুখরিত করেছিলেন। তিনি কী করে তাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ হতে পারেন।

গণমানুষের নেতা হিসেবে জনগণের মুক্তিদাতা হিসেবে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই মুক্তি ও স্বাধীনতা ছাড়া বাংলার জনগণের জন্য বঙ্গবন্ধুর আর কোনো চিন্তা ভাবনা ছিল না। তিনিই প্রথম বাঙালি নেতা, যিনি সঠিক সময়ে সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, পাকিস্তান বাঙালির জন্য কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল না। তাই বাঙালিকে পাকিস্তান নামক ধর্মরাষ্ট্রে চরমভাবে নির্যাতিত-নিপীড়িত হতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর একমাত্র লক্ষ্য ছিল ওই শোষণ ও বঞ্চনা থেকে বাংলাদেশের মানুষকে চিরদিনের জন্য মুক্ত করা। আর ওই কাজটি করতে গিয়ে তিনি যে মহাবিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন; সে কারণেই তাকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এ দেশে তাদের সহচর দিয়ে সপরিবার হত্যা করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির রায় তারা কার্যকর করতে পারত। কিন্তু তখন তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা শ্রেয় মনে করেনি। তাদের ধারণা ছিল, মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশীর্ষ ও বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আর্থসামাজিক কর্মসূচি গ্রহণের সাহস পাবেন না। তাই তারা তাকে সাড়ে তিন বছর সুযোগ দিলেন। বঙ্গবন্ধুও ৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন ও ৭৩-এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে বাংলাদেশের প্রথম সংসদীয় গণতন্তের প্রবর্তন করেন। প্রায় সাড়ে তিন বছর এই ধারায় দেশ শাসন করল।

একদিকে সংসদীয় গণতন্ত্র ও পূর্ণ স্বাধীনতা, অপরদিকে সেই গণতন্ত্রের অধিকার অপব্যবহার করে এমন এক বিশৃঙ্খলাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা, যাকে মোকাবিলা না করে জনগণের ভাগ্য উন্নয়ন কখনো সম্ভব ছিল না। ৫ জন সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হলো, আত্রাই থেকে সরকারের বিরুদ্ধে টিপু বিশ্বাস যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। থানা আক্রমণ, ব্যাংক লুট অব্যাহত রইল। জাসদের নেতৃত্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি আক্রমণ করা হলো। সিরাজ সিকদার নামক একজন কয়েক হাজার লোককে হত্যা করলেন। গণবাহিনী গঠন করে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করলেন। মেজর জলিলসহ জাসদের নেতারা সংযুক্ত হলেন। পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কস-লেনিন) যারা মক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুড়ের লড়াই বলে অভিহিত করলেন। তারাও সার্বিকভবে পরিস্থিতি এমন এক জটিল আকার ধারণ করালেন যে, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা সম্ভব ছিল না। সে কারণেই তিনি স্বাধীনতার স্বপক্ষের সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চাইলেন, তাই বাকশাল কোনো একদলীয় শাসন ছিল না। এটা ছিল জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই বঙ্গবন্ধুকে বাকশাল গঠন করতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হাতে প্রচুর ক্ষমতা ছিল। আরো ক্ষমতায়নের প্রয়োজন তার ছিল না, যারা বলেন ক্ষমতার লোভে বঙ্গবন্ধু একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারা তার প্রতি মহা-অবিচার করে থাকেন। সাধারণ অর্থে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিপ্লবের মহানায়ক জাতির জনক, সবকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। কারণ তিনি দেশ স্বাধীন করলেন তা ভেস্তে যেতে দেখে নীরুর মতো বাঁশি বাজাতে পারেননি। তাকে মুক্তির দূত হিসেবে প্রতি বিপ্লবীদের মোকাবিলা করতে হয়েছে।

গণতান্ত্রিক বিধিবিধান অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুকে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হয়। বিশ্বের ইতিহাসে সে এক বিরল ঘটনা। জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সমাজ বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ। সংসদ সদস্যরাই কিন্তু ভোট দিয়ে বাকশালের প্রতি সমর্থন জুগিয়েছিলেন। অধ্যাদেশের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রয়োগ করে একজন স্বৈরশাসক হিসেবে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ করেননি। প্রচলিত আইনের ধারা অনুযায়ী ওটা করা হয়েছিল। যেসব সংসদ সদস্য সেদিন চতুর্থ সংশোধনীতে সমর্থন জানিয়েছিলেন তারাই বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাকশাল পদ্ধতির সমালোচনা করেছেন ও এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। এভাবে ইতিহাসের কাঠগড়ায় বঙ্গবন্ধুকে দাঁড় করানো উচিত নয়। সেদিন সংসদে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা কখনো বঙ্গবন্ধুর ওপর অর্পণ করা সঠিক নয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংসদে সংবিধান সংশোধন করে সমাজ বিপ্লব সংঘঠিত করা যায় কি না; তা হয়তো বঙ্গবন্ধু বেছে থাকলে প্রমাণিত হতো। অবশ্য তার হত্যাকান্ড কখনো এ কথা প্রমাণ করে না যে, সংসদীয় পদ্ধতিতে যে ধরনের সমাজ বিপ্লব বঙ্গবন্ধু সংঘটিত করতে চেয়েছিলেন, তা সম্ভব ছিল না। দুঃখ হয় সেদিন যারা বঙ্গবন্ধুর ওই বাকশাল কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই আজ দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রসঙ্গ উঠলেই নীরব থেকে প্রতিপক্ষকে সমর্থন জানান। একবার ভেবে দেখুন তো এভাবে যদি ৭২-৭৫ বাংলাদেশে যেসব ঘটনা ঘটছিল এবং যার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন; সে ব্যাপারে মৌনতা কি ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর অবমূল্যায়নকে উৎসাহ জোগান দেবে না?

তাই বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত আদর্শের অনুসারীদের প্রতি আমার একান্তই আবেদন ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতাকে বিস্তৃতির অতল গর্ভে তলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। বরং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষ শক্তি হিসেবে তিনি যা করতে চেয়েছিলেন তার প্রকৃত ব্যবস্থা দিয়ে ঐতিহাসিক অবস্থান সূদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠাকরণ। তার জীবনের সবচেয়ে মহাপ্রয়াসকে ভ্রান্তির আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিকে এই বাংলদেশেই আর কখনো যেন হেয় করার চেষ্টা না করা হয়, ইতিহাসে যেভাবে তিনি প্রতিষ্ঠিত, সেটাই তার প্রকৃত অবস্থান।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ইতিহাসের মহানায়ক,বঙ্গবন্ধু,১৫ আগস্ট
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close