মিহির রঞ্জন তালুকদার

  ০৮ মার্চ, ২০১৯

নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে সমাজ বদলাবে

আধুনিক সভ্যতার এ চূড়ান্ত শিখরে তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে নারীরাও এগিয়ে চলেছে তাদের আপন মহিমায়। ‘নারী ঘরের লক্ষ্মী’ এই প্রবাদ দিয়ে তাদের ঘরবন্দি করে রাখার দিন শেষ। এ কুসংস্কার থেকে তারা বেরিয়ে এসেছে নিজ গুণে। তারা এখন স্বগৌরবে গৌরবান্বিত হতে চান। আমাদের দেশে এখন গুরুত্বপূর্ণ পদমযআদার স্থান দখল করে আছেন তারা। আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী নেত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং প্রশাসনিক অনেক বড় বড় পদে নারীরা রয়েছেন সম্মানের সহিত। গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও।

১৯০৮ সালে, ১৫ হাজার নারী নিউইয়র্ক সিটিতে স্বল্প কর্মঘণ্টা, উন্নত মজুরি এবং ভোটাধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাদের সম্মানে সোসালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা প্রথম ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নারী দিবস পালন করেছিল এবং ১৯১৩ সাল পর্যন্ত ফেব্রুয়ারির শেষ রোববার আমেরিকার নারীরা জাতীয় নারী দিবস উদযাপন করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশের নারী সংগঠনগুলোর আলোচনায় ১৯১৩ সালের ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পৃথিবীব্যাপী উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

বাংলাদেশ সংবিধানেও নারীর অবস্থান সুস্পষ্ট। একটি রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চাবিকাঠি হচ্ছে সেই রাষ্ট্রের সংবিধান। বাংলাদেশের সংবিধানে নারীদের অধিকার সুরক্ষা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিধান সন্নিবেশিত হয়েছে। সংবিধানের ২৭নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ সংবিধানের ২৮(১) ধারায় রয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না।’ ২৮(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবেন।’ ২৮(৩) এ উল্লেখ আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা বিশ্রামের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাবে না।’

২৮(৪) এ উল্লেখ আছে, ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হতে এ অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিভৃত করবে না।’ ২৯(১) এ রয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে।’ ২৯(২) এ বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হবেন না কিংবা সেক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।’ ৬৫(৩) ধারায় নারীর জন্য জাতীয় সংসদে আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে এবং এ ধারার অধীনে স্থানীয় শাসন-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।

মানিকগঞ্জে সাটুরিয়ায় এক নারীকে দুই দিন আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। অস্ত্রের মুখে ওই নারীকে মাদক সেবনেও বাধ্য করা হয়েছে বলে জানা গেছে। নারী ধর্ষণ এখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষিত হচ্ছেন কোনো না কোনো নারী। স্কুলশিক্ষিকা থেকে শুরু করে কর্মজীবী নারী, গৃহবধূ, বালিকা-প্রৌঢ়া এ নির্মমতার শিকার। আমাদের সমাজব্যবস্থা এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি পুরনো কুসংস্কার থেকে। আমাদের এই ঘুণে ধরা সমাজে এখনো নারীরা পণ্য।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমাদের দেশে ১৬ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষ রয়েছে (২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত)। এর মধ্যে নারী ও পুরুষের সংখ্যা যথাক্রমে ৮,১৭,৪০,০০০ ও ৮,১৯,১০,০০০ জন। দেখা যাচ্ছে যে, মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী এবং এদের অনুপাতিক হার পুরুষ-মহিলা ১০০.৩ : ১০০। এবং বাংলাদেশে নারী-পুরুষের সাক্ষরতার হার যথাক্রমে ৪৯ দশমিক ৪ ও ৫৪ দশমিক ১ শতাংশ (আদমশুমারি-২০১১)। বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম জনশক্তি ৫ কোটি ৬৭ লাখ।

এ শ্রমশক্তির মধ্যে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছে ৫ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ শ্রমশক্তি ৩ কোটি ৭৮ লাখ এবং নারী শ্রমশক্তি ১ কোটি ৬২ লাখ জন। পরিসংখ্যানটিতে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, আর্থসামাজিকভাবে নারীর অবস্থান পুরুষের তুলনায় বেশ অনগ্রসর। এ দেশের নারীরা বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার।

সেইসঙ্গে শিল্প খাতে নারীদের অবদান অনেক। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প পুরুটাই নারীশ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল। জরিপে দেখা গেছে, গার্মেন্টসে প্রায় ৮১ শতাংশই নারীশ্রমিক। বাংলাদেশর রফতানি আয়ের বড় একটি অংশ আসে তৈরি পোশাক হতে। কিন্তু এখানে নারীরা চরম অবহেলার শিকার। তাদের দেওয়া হয় না ন্যায্য মজুরি। জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত নিম্ন। কর্মক্ষেত্রেও নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে গৃহকর্মী নির্যাতন একটি ভয়াবহ প্রক্রিয়া। আর এ নিষ্ঠুর নির্যাতনটি চালায় এ সমাজের শিক্ষিত ব্যক্তিরা। গৃহকর্মী নির্যাতন বাসার ভেতরে সংগঠিত হয় বলে এটির খবরাখবর পাড়া-প্রতিবেশীরাও জানেন না।

আপনাদের গৃহকর্মী আদুরীর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। আদুরীর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত না হলে আমরাও জানতাম না আদুরীর দুর্দশার কথা। নির্যাতনের শেষ পর্যায়ে যেখানে তাকে ডাস্টবিনে ফেলে রাখা হয়েছিল, সেই ২০১৩ সালে। তবে এটা সত্যি যে, সমাজে নারীদের অবস্থান আগের তুলনায় অনেক ভালো। অনেক বড় বড় দায়িত্বে থেকে তারা তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছেন। ধর্মীও দৃষ্টিকোণ থেকেও আমরা জানি, প্রত্যেক নারী মায়ের প্রতীকী রূপ। মনে রাখতে হবে, নারীই হচ্ছে বৃক্ষের শেকড়স্বরূপ। অতএব আসুন, দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর মধ্য দিয়ে সমাজকে বদলানোর চেষ্টা করি।

লেখক : প্রভাষক ও কলামিস্ট

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নারী দিবস,নারী নির্যাতন,নারী শ্রমিক,নারী অধিকার
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close