রেজাউল করিম খোকন

  ২৪ জুলাই, ২০১৮

চিঠি দিও প্রতিদিন...

‘চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও/নইলে থাকতে পারবো না/চিঠিগুলো অনেক বড় হবে/পড়তে পড়তে সকাল দুপুর আর রাত্রি চলে যাবে/কোথায় থাকো, কেমন থাকো একে একে সবই লিখো। সেই তো হবে মোর সান্ত্বনা।’ আশির দশকের বাংলা ছবি ‘অনুরোধ’-এর একটি জনপ্রিয় গানের কয়েকটি কলি এখানে উদ্ধৃত করা হলো। গানটি গেয়েছেন প্রখ্যাত গায়িকা সাবিনা ইয়াসমীন। নায়কের অনুপস্থিতিতে বিরহকাতর নায়িকা গানের মাধ্যমে তার হৃদয়ের একান্ত আবেগ প্রকাশ করছে। গানের সেই সূত্র ধরে বলতে হয়, এখন কি কেউ প্রিয়জনকে আবেগের আবির মাখানো চিঠি লেখে? কিংবা প্রিয়জনের চিঠির জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করে? এসব প্রশ্ন আমাকে কেবলই তাড়িত করে।

সময়ের আবর্তনে ধীরে ধীরে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। এখন আর আগের মতো চিঠি লেখার প্রচলন নেই। বলা যায়, চিঠি লেখার দিন বিদায় নিয়েছে, চিঠিরও প্রয়োজন ফুরিয়েছে। মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের যুগে এখন আর কেউ কাগজ-কলম নিয়ে একজন আরেকজনের কাছে চিঠি লিখতে বসে না। সেই সময় বা ফুরসত কোথায়? সবাই তুমুল ব্যস্ত হরেক রকমের কাজে। যে যেখানেই থাকুক না কেন, কারো সঙ্গে কথা বলতে চাইলেই মোবাইল ফোনে প্রয়োজনীয় কথা সেরে ফেলছেন ঝটপট। শহর থেকে গ্রামে কিংবা গ্রাম থেকে শহরে এমনকি সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে প্রবাসী প্রিয়জনের সঙ্গে মুহূর্তেই যোগাযোগ করতে পারছেন। মন খুলে কথা বলতে পারছেন, নিজের সমস্যা, আবেগ অনুভূতি, চাহিদা সবকিছুই মোবাইল ফোনে জানাতে পারছেন ওপ্রান্তের প্রিয়জনের কাছে। আগে যেখানে চিঠি লিখে পোস্ট অফিসে গিয়ে পোস্ট করার পর নির্দিষ্ট ঠিকানায় প্রাপকের কাছে পৌঁছাতে সপ্তাহ এমনকি মাস পেরিয়ে যেত আর এখন মোবাইলের মাধ্যমে যখন খুশি তখনই দূর-দূরান্তে থাকা প্রিয়জনের সঙ্গে মুহূর্তেই কথা বলতে পারছেন সবাই। শুধু কথা বলেই সন্তুষ্ট থাকতে পারছেন না, কেউ কেউ ফোর-জি মোবাইল সার্ভিস চালু হওয়ায় স্মার্টফোন সেটের মাধ্যমে কথা বলার সময় অন্য প্রান্তে থাকা মানুষটিকেও সরাসরি দেখতে পারছেন। একইভাবে স্কাইপি, ভাইভার, ইমো প্রভৃতির কথা বলা যায়।

আজকাল ভিডিও কলে তেমন খরচ হয় না বলে অনেকে এভাবেই মোবাইলে অন্যপ্রান্তে থাকা মানুষটির সঙ্গে খোশগল্পে মেতে উঠছেন। ঈদ কিংবা নববর্ষ এলে এখন আর আগের মতো দোকানে কার্ড কেনার ধুম পড়ে না। ফেসবুক, ই-মেইল, মোবাইল এসএমএস, এমএমএসের মাধ্যমে একজন আরেকজনকে শুভেচ্ছা জানাতে দেরি করছেন না। অতীত দিনের চিঠির একুশ শতকীয় সংস্করণ, ই-মেইল আর এসএমএসেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন সবাই। আজকাল কারো পক্ষে নিরবচ্ছিন্ন জীবন কাটানোর উপায় নেই। এক চিলতে অলস হলুদ কিংবা নীল মায়াবী চিঠির খাম এখন অতীত স্মৃতিময় উপাদানে পরিণত হয়েছে। চিঠি লেখা এবং পড়ার দিনগুলো এখন নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত করে আমাকে, আমার মতো আরো অনেককে।

করপোরেট কিংবা নন-করপোরেট দুনিয়ায় সবাইকে ই-মেইলের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ ছাড়া আছে মোবাইল ফোনে এসএমএসে লুকোচুরি খেলা, ফাঁকিবাজির নিত্যনতুন কৌশল প্রয়োগ। প্রিয় মানুষটির বিরহ যন্ত্রণায় হৃদয়ে তোলপাড় হলেও কেবল কয়েকটি শব্দের কথা ‘মিস ইয়্যু’ অথবা ‘লাভ ইয়্যু’ লিখেই ক্ষ্যান্ত দেয় ইন্টারনেট যুগের মানুষ। কেউ বাড়তি শব্দ প্রয়োগের দিকে পা বাড়ায় না, যত সংক্ষিপ্ত আকারে মনের ভাব প্রকাশ করা যায়, তার প্রতিযোগিতা যেন লেগে আছে, পৃষ্ঠাভর্তি চিঠি লেখা এবং পড়ার ধৈর্য এখন আর নেই কারো। মেদহীন, স্লিম এসএমএসই এখন সবার পছন্দ, যেখানে আবেগের প্রকাশ থাকলেও সেটা অনেকটাই ফর্মাল। আগের মতো পত্রমিতালীর জোয়ার কিংবা উচ্ছ্বাস নেই। ফেসবুকের বন্ধু-বান্ধবীদের সামাল দিতে দিতে একেকজনের বেকায়দা অবস্থা। সবার সঙ্গে প্রতিদিন চ্যাট করার সুযোগ কোথায়, তারপরও ‘হাই’ ‘হ্যালো’ বলে কেউ পার পেয়ে যেতে চেষ্টা করেন। এসএমএস, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপে কি তা সম্ভব? কিংবা ই-মেইলেও? একটা খাম কেনার আয়োজন থেকে আরম্ভ করে চিঠির নীল, হলুদ-রঙের কাগজ, হাতের লেখা কলমের কালি-প্রিয় মানুষের হাতের ছোঁয়া, একান্ত সৌরভ, সব মিলিয়ে চিঠির মধ্যে যে অফুরন্ত আন্তরিকতা, অকৃত্রিমতা, স্বতঃস্ফূর্ততা, প্রাণময়তার প্রকাশ ছিল, এখনকার ই-মেইল কিংবা এসএমএসের ক্ষেত্রে তা কোথায়?

সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া সেই বিখ্যাত গান ‘চিঠি দিও প্রতিদিন’ গানের আবেদন এখন আর নেই। এখন প্রেমিকা কিংবা বিরহকাতর স্ত্রীকে প্রেমিক কিংবা স্বামীর চিঠির জন্য প্রতীক্ষা করতে হয় না দিনের পর দিন। ইচ্ছে করলেই মোবাইলে, ফেসবুকে, ই-মেইলে তাৎক্ষণিকভাবে মনের একান্ত আবেগ অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে পারে। মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট এখন প্রত্যেককে অন্যের খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। এখন বিকাশ ওয়ালেট, ই-ক্যাশ, ইএফটি, শিওর ক্যাশ-মোবাইল ব্যাংকিংসেবার প্রসার ডাক বিভাগের মানি-অর্ডার ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়েছে। এখন কেউ কারো কাছে মানি অর্ডারের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর কিংবা পাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ডাকঘর চেনে না, কেউ জীবনে কোনোদিন ডাকঘরে গেছে কি না—সেটাও গবেষণার বিষয়। কেউ কেউ চাকরি-বাকরির দরখাস্ত পাঠানোর জন্য কয়েক বছর আগেও ডাকঘরে যেত। পরে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে তা পাঠানোর জন্য কুরিয়ার সার্ভিসের ওপর ভরসা করেছে। আর এখন চাকরি-বাকরির জন্য অনলাইনে দরখাস্ত করতে হয়। ফলে ডাকঘরে যাওয়ার প্রয়োজন আছে কি?

আমরা দেখেছি একসময়ে ডাকপিওন আর পোস্টমাস্টার সাহেব দেশের সব এলাকায় শহর, বন্দর, গ্রাম, মফস্বলে সর্বত্রই সবার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন। সবার বাড়িতে যাতায়াত ছিল ডাকপিওনের। বহুল প্রতীক্ষিত অনেক প্রত্যাশিত চিঠি কিংবা মানি-অর্ডারের টাকা নিয়ে আসতেন বলে ঘরে ঘরে তার বেশ-খাতির যত্ন হতো। এখন চিঠির আদান-প্রদান কমে যাওয়ায় ডাকঘর, পোস্টমাস্টার, ডাকপিওন তথা পোস্টাল সার্ভিসের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। মোবাইল-ইন্টারনেটের এই যুগে কমেছে চিঠি বিলির সংখ্যা, ডাক বিভাগের লোকসান গত ১৫ বছরে ১৩০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ২০০০ সালেও যেখানে ডাক বিভাগের বিলি করা চিঠির পরিমাণ ছিল ২৪ কোটি ৪ লাখ ২৭ হাজার, সেখানে ২০১৪ সালে বিলি হওয়া চিঠির সংখ্যা নেমে এসেছে ৪ কোটিতে। অর্থাৎ দেড় দশকে ডাক বিভাগে চিঠি বিলির সংখ্যা কমেছে ২০ কোটি বা প্রায় ৮৫ শতাংশ। অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী ডাক বিভাগে বছরে ২২ শতাংশ হারে লোকসান বাড়ছে। গত ১৫ বছরে ডাক বিভাগের লোকসান প্রায় সাড়ে ১৩০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও আধুনিকায়নের সুবাদে এশিয়া মহাদেশের চীন, থাইল্যান্ড, ইউরোপের স্পেন, গ্রিসসহ অনেক উন্নত দেশে সরকারি ডাক বিভাগ এখনো লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে আছে। বাংলাদেশেও ডাক বিভাগ আধুনিকায়নের লক্ষ্যে একাধিক প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত ধীরগতিতে চলা এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন হার মাত্র ১০ শতাংশ। অথচ ডাক বিভাগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসগুলো আধুনিক ও দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থার কারণে লাভজনক ব্যবসা করে যাচ্ছে। তাদের ব্যবসা দিনে দিনে রমরমা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দেখেও যেন না দেখার ভান করছে। পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক হতে না পারলে ডাক বিভাগ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে না। একটা কথা বুঝতে হবে, তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগেও ডাক বিভাগ অপ্রয়োজনীয়, অচল, অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েনি, সাধারণ মানুষের কাছে এখনো এর চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গ্রাহকের প্রয়োজন বিবেচনা করে সে অনুযায়ী নতুন সেবা চালুর পাশাপাশি সহজে, দ্রুত ও কম সময়ের মধ্যে সেবা পৌঁছে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবহেলা, খামখেয়ালি কিংবা অমনোযোগিতার কোনো সুযোগ নেই।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
চিঠি,কলাম,মতামত,ডাকঘর
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist