পঞ্চানন মল্লিক

  ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭

খ্রিষ্টীয় ধর্মীয় উৎসব

শিল্পীর তুলিতে শিশু যিশুর পাশে তিন বিজ্ঞ ব্যক্তি —ছবি : সংগৃহীত

আহ্নিক গতি বার্ষিক গতি সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি। নিজ অক্ষের ওপর পশ্চিম থেকে পূর্বে একপাক ঘুরে আসাকে পৃথিবীর আহ্নিক গতি বলে। অনুরূপভাবে পৃথিবী তার নিজ অক্ষের ওপর ঘুরতে ঘুরতে ৩৬৫ দিন বা এক বছরে একবার সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে আসে। একে বলা হয়, পৃথিবীর বার্ষিক গতি। বার্ষিক গতির ফলেই পৃথিবীতে দিন-রাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। দক্ষিণ গোলার্ধে সবচেয়ে ছোট দিন হচ্ছে ২৩ ডিসেম্বর। ২৩ ডিসেম্বরের পর দিন আবার আস্তে আস্তে বড় এবং রাত ছোট হতে থাকে। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের ধারণা মতে, ২৩ ডিসেম্বরের পর মূলত ২৫ ডিসেম্বর থেকে ক্রমান্বয়ে দিন বড় হতে শুরু করে তাই এই দিন বড়দিন। অর্থাৎ এইদিন থেকে বছরের দিন বড় হওয়া শুরু (তথ্য সূত্র : আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধান)।

বড়দিনের তাৎপর্য হচ্ছে এই দিনটি পালিত হয় খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন উপলক্ষে। যিশু জন্মগ্রহণ করেছিলেন বেথলেহেম শহরে মারিয়া নামে এক কুমারী মাতার গর্ভে। মারিয়া বা মেরি ছিলেন ইসরায়েলের নাজারেথবাসী সৎ, ধর্মপ্রাণ সাধু যোশেফের বাগদত্তা। যোশেফ পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। যিশুর জন্ম ছিল অলৌকিক। একদিন স্বর্গদূত গ্যাব্রিয়েল এসে মাতা মারিয়াকে সুসংবাদ দিলেন যে, তিনি মুক্তিদাতার মা হবেন। এ রকম সংবাদ শুনে মারিয়া প্রথমে ভয় পেলেও পরে ঈশ্বরের ইচ্ছা মনে করে তা মেনে নিলেন। বললেন, ‘আমি ঈশ্বরের দাসী। আমার জীবনে ঈশ্বরের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।’ এরপর তিনি মা হতে চললেন। বিয়ের আগেই মেরি সন্তানের মা হচ্ছেন জেনে যোশেফ খুব চিন্তিত হলেন। তিনি মেরিকে গোপনে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু স্বর্গদূত এসে ঈশ্বরের পরিকল্পনা যখন যোশেফের কাছে খুলে বললেন, তখন তিনি রাজি হলেন মেরিকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে। ঠিক সেই সময় রোম সম্রাট সিজার দেশের লোক গণনার জন্য সবাইকে শহরে গিয়ে নাম লেখাতে নির্দেশ দিলেন। মারিয়ার স্বামী যোশেফ ছিলেন দায়ুদ বংশের লোক। তিনি মারিয়াকে সঙ্গে নিয়ে নাম লেখাতে গেলেন বেথলেহেম শহরে। কিন্তু সেখানে পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে গেল। রাত কাটাবার জন্য তারা অন্য কোনো জায়গা খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিলেন এক গোশালে। সেখানে তীব্র শীতের গভীর রাতে যিশুখ্রিষ্টের জন্ম হলো অতি সাধারণ ও দীন বেশে।

যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিনকে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে প্রতি বছর পালন করে থাকেন। অবশ্য শুরুতে এমনটি ছিল না। যে যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন উপলক্ষে বড়দিন উদযাপন করা হয়, তার মৃত্যুর বহু বছর পর থেকে এটি পালন শুরু হয়েছে বলে জানা যায়। এটি খ্রিষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ উৎসব। মহামতি যিশুর আগমন উপলক্ষে তাকে সৎকর্ম ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত মেনে দিনটি উদযাপন করেন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা। তারা মনে করেন, জেরুজালেমের বেথলেহেম শহরে এক গোশালে মাতা মেরির কোলে জন্ম নেওয়া শিশুটিই ঈশ্বরের একমাত্র ছেলে। যিনি মানবজাতিকে পাপ থেকে উদ্ধারের পথ প্রদর্শক হিসেবেই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাই তার জন্মদিনটি উদ্যাপিত হয় বড়দিন হিসেবে। শান্তির বাণী পাঠ, শিশু যিশু আর মাতা মেরির প্রতীকী রূপের উপাসনার মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হয় এ দিনটি। দিবসটি উপলক্ষে গির্জাগুলো সাজে উৎসবের সাজে। বাড়িঘরে করা হয় বর্ণিল আলোকসজ্জা। বিভিন্ন চার্চ ও গির্জায় হয় আনুষ্ঠানিকভাবে কেক কেটে বড়দিনের উৎসব পালন। দেশ, জাতি, মানুষের কল্যাণ কামনায় করা হয় প্রার্থনা।

বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ। এখানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের ন্যায় খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব বড়দিনও নির্বিঘ্নে, আড়ম্বরের সঙ্গে প্রতিপালিত হয়ে থাকে। এদিন সরকারি ছুটি থাকে। দিনটি উপলক্ষে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা দিনব্যাপী নানান আনন্দ উৎসব ও প্রার্থনায় মেতে ওঠেন। গির্জার আশপাশ ও ক্রিসমাস ট্রি-টি সাজানো হয় রঙিন কাগজ ও অন্যান্য উপকরণে। বসে মেলা। আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধব বেড়াতে আসেন। সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়। আদান-প্রদান করা হয় ক্রিসমাস কার্ড। লোকজন বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরস্পর কুশল বিনিময় করেন। মেতে ওঠেন নানা হাসি, গল্প-আনন্দে। কখনো কখনো এ উপলক্ষে অনুষ্ঠান চলে কয়েক দিন ধরে। হয় নাটক, যাত্রাপালা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উৎসবমুখর এসব অনুষ্ঠানে অন্য ধর্মাবলম্বীরাও অংশ নেন সানন্দে। এতে বাড়ে সামাজিক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব। লালন, হাছন আর কানাইশীলের দেশে আমরা যা শত শত বছর ধরে পালন করে আসছি। প্রকৃতিই আমাদের শিখিয়েছে পৃথিবীর অরণ্যভূমিতে কিভাবে হাজার হাজার প্রজাতির বৃক্ষ ভালোবাসা বিনিময় করে পাশাপাশি বসবাস করতে পারে। তবে কেন আমরা মানবারণ্যের সদস্য হয়ে সে কাজে ব্যর্থ হব! মহামতি যিশুর দেখানো পথে চলতে পারলে সে ব্যর্থতা কেটে যাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

লেখক : কলামিস্ট ও কবি

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বড়দিন,শিশু যিশু,ধর্মীয় সম্প্রীতি,যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist