জুবায়ের চৌধুরী

  ০৫ অক্টোবর, ২০১৯

শীর্ষ সন্ত্রাসী দুবাইয়ে গ্রেফতার

জিসানকে আনতে তৎপরতা শুরু!

বাংলাদেশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ মন্টি ওরফে আলী আকবর চৌধুরীকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহর থেকে গ্রেফতার করেছে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ২ অক্টোবর রাতে দুবাই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে বলে জানিয়েছে ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। দীর্ঘ ১৩ বছর পলাতক থাকার পর গ্রেফতার হলেন জিসান। গ্রেফতারের সময় নিজের নাম বদলে আলী আকবর চৌধুরী পরিচয়ে সেখানে অবস্থান করছিলেন। তার পাসপোর্ট অনুযায়ী তিনি ভারতীয় নাগরিক।

ঢাকায় সাম্প্রতিক অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো কারবারের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে যখন জিসান সম্পর্কে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে, ঠিক তখনই শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে গ্রেফতার করা হলো। জিসান বাংলাদেশে পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী। তাকে গ্রেফতারে বছরখানেক আগে ইন্টাপোলের সহযোগিতা চেয়েছিল বাংলাদেশ পুলিশ। এ নিয়ে কয়েক দফা চিঠি চালাচালিও হয়।

ধারণা করা হচ্ছে, ইন্টারপোলের তথ্যের ভিত্তিতেই দুবাই পুলিশ জিসানকে গ্রেফতার করে থাকতে পারে। যদিও তাকে গ্রেফতারের কারণ সম্পর্কে এখনো সঠিক কোনো তথ্য নেই কারো কাছেই। জানা গেছে, জিসানকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সঙ্গে এরই মধ্যে চিঠি চালাচালি শুরু করেছে পুলিশের বিশেষায়িত একটি ইউনিট। ইন্টারপোলের সবুজ সংকেত পেলে পুলিশের একটি প্রতিনিধিদল দুবাই যেতেও প্রস্তুত।

তবে পুলিশ সদর দফতরের একটি সূত্র জানিয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দিবিনিময় চুক্তি নেই। তাই তাকে দেশে ফেরাতে বেশ জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে ঢাকাকে। কারণ পাসপোর্ট সূত্রে জিসান এখন ভারতের নাগরিক। তবে ভারতে ফেরত পাঠানো হলে বাংলাদেশ তাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চালাতে পারে। সে ক্ষেত্রে জিসানকে ফেরত পেতে সহজ হবে।

যেভাবে গ্রেফতার হলেন জিসান : পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) এআইজি মহিউল ইসলাম জানিয়েছেন, জিসানকে গ্রেফতারের বিষয়ে দুই মাস আগে থেকে দুবাইয়ের সঙ্গে এনসিবি যোগাযোগ শুরু করে। এনসিবি গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মাধ্যমে জিসানের লেটেস্ট ছবি ও তথ্য পাঠানোর পর তারা জিসানকে শনাক্তের কাজ শুরু করে। এরপর দুবাই এনসিবি ঢাকাকে জানায়, তারা জিসানকে নজরদারির মধ্যে রেখেছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য এনসিবি দুবাই জিসানের সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য চায় এবং ঢাকাকে জানানো হয়, জিসান ভিন্ন নাম ব্যবহার করে দুবাইতে আছেন। একইসঙ্গে অন্য দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন। এ তথ্য জানার পর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মাধ্যমে সেগুলো যাচাই করা শুরু হয়।

এআইজি মহিউল ইসলাম বলেন, একপর্যায়ে জানা যায়, জিসান বর্তমানে ভারতীয় পাসপোর্টে ‘আলী আকবর চৌধুরী’ নামে দুবাইতে আছেন। জিসানের মধ্য আমেরিকার ডমিনিকান রিপাবলিকের পাসপোর্টও রয়েছে। সেটাও শনাক্ত করা হয়। এরই মধ্যে জিসানের ব্যাপারে ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট নোটিসটি আপডেট করা হয়। দুই দেশের এনসিবির তদেন্ত বেরিয়ে আসে জিসান ও তার ভাই এখনো দুবাইয়ে বসে ঢাকার অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণে রাখছে। এসবের মধ্যেই সম্প্রতি রাজধানীর খিলগাঁওয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের দুই সহযোগী অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়। সব আপডেট তথ্য দুবাই এনসিবিকে পাঠনো হলে তারা জিসানকে গ্রেফতার মাঠে নামে।

এনসিবির কর্মকর্তা মহিউল জানান, জিসানকে গ্রেফতারের ঢাকার এনসিবি আইপি ফোনে যোগাযোগ করে তাকে শনাক্ত করে। জিসানকে এখন দুবাইয়ে জুডিশিয়াল কাস্টডিতে নেওয়া হয়েছে। জিসানকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচার কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে মহিউল ইসলাম বলেন, নির্দিষ্ট ডকুমেন্ট চেয়ে চেকলিস্ট পাঠিয়েছে দুবাই। শিগগিরই মামলা-সংক্রান্ত তথ্যাদি বিনিময় শুরু হবে। এরপর মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে লিগ্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট করার চেষ্টা চলছে। দীর্ঘদিন জিসানের পেছনে লেগে থাকার কারণে তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে তাকে দ্রুত বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হবে।

জিসানকে ছাড়াতে দৌড়ঝাঁপ : দুবাই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে ছাড়াতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন তার সহযোগীরা। এতে সহযোগিতা করছে দুবাইয়ে থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী টিএনটি নাদিম। এরই মধ্যে তিনি এরাবিয়ান সিআইডির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। টিএনটি নাদিম ছাড়াও, হত্যা মামলার আসামি শাকিলসহ বেশ কয়েকজন চেষ্টা করছে জিসানকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়াতে। জানা যায়, জিসানকে ছাড়াতে যত টাকাই দরকার হোক বা যত বড় লবিস্ট নিয়োগের প্রয়োজন হোক না কেন, তা করতে নাদিমকে অনুরোধ করে শামীম। জিসানকে যাতে কোনোভাবেই বাংলাদেশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা না হয় সেজন্য বাংলাদেশেও যোগাযোগ করছেন তারা।

এদিকে ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ও জি কে শামীম গ্রেফতার হন। তাদের স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে, দুবাইতে বসেই ক্যাসিনোর টাকার ভাগ নিতেন জিসান। সম্প্রতি ‘টেন্ডারবাজ’ জি কে শামীমকে ঘিরে ঢাকার যুবলীগের এক শীর্ষ নেতার বিরোধ সৃষ্টি হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে জিসানের সঙ্গে সমঝোতা বৈঠকের আয়োজন করে আরেক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া । গত জুন মাসের মাঝামাঝিতে সিঙ্গাপুরে যান জি কে শামীম, যুবলীগের ওই শীর্ষ নেতা এবং খালেদ। আর জিসান দুবাই থেকে সিঙ্গাপুরে যান। সিঙ্গাপুরে মেরিনা বে এলাকার একটি বিলাসবহুল হোটেলে তাদের বৈঠক হয়। তবে তাদের কাক্সিক্ষত ফল ছাড়াই দেশে ফিরতে হয়।

এমন প্রেক্ষাপটে কিলিং মিশিনে অংশ নিতে দুবাই থেকে ঢাকায় আসেন জিসানের সহযোগীরা। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, গত ২৬ জুলাই রাতে খিলগাঁও থেকে অস্ত্রসহ তিন সন্ত্রাসী গ্রেফতারের পর। তিনজনের দুজনই ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সহযোগী। তারা দুবাই থেকে একটি বিশেষ কিলিং মিশনে অংশ নিতে ঢাকায় আসেন। এ নিয়ে ডিবি পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও তারা জিসানের পরিকল্পনার তথ্য তুলে ধরেন। এদিকে র‌্যাবের হাতে সাত অস্ত্রধারী দেহরক্ষীসহ গ্রেফতার হন জি কে শামীম। তিনিও জানিয়েছিলেন, আগে কখনো এত দেহরক্ষী রাখেননি। মূলত জিসানের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হওয়ার পর থেকে ‘ভয়ে’ বড় নিরাপত্তা টিম গঠন করেন এই টেন্ডারবাজ।

উল্লেখ্য, গত এক দশকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত দেশের শীর্ষ ২৩ সন্ত্রাসীর একজন হলো জিসান। তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। রাজধানীর গুলশান, বনানী, বাড্ডা, মতিঝিলসহ বেশ কিছু এলাকায় তার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করতেন তিনি। ইন্টারপোল তার নামে রেড অ্যালার্ট জারি করে রেখেছে। ২০০৩ সালের ১৪ মে ঢাকার মালিবাগে জিসানকে গ্রেফতারের অভিযানকালে তারই সহকর্মীদের ব্রাশফায়ারে নিহত হন ডিবি পুলিশের দুই কর্মকর্তা। তৎকালে ওই হত্যাকাণ্ডে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। অপারেশন ক্লিনহার্ট চলাকালে ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান নিহত হলে দীর্ঘ সময় আত্মগোপনে থেকে ২০০৫ সালে জিসান ভারতে চলে যান।

২০০৯ সালে কলকাতা পুলিশের হাতে আটকও হন জিসান। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে কলকাতায় বসেই নিয়ন্ত্রণ করতেন ঢাকার চাঁদাবাজি। একপর্যায়ে ভারতীয় পাসপোর্টে দুবাই পাড়ি জমান। জিসান ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে দুবাই যান বছর দুয়েক আগে। পরে সেখান থেকেই ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন তিনি। সেখান থেকে ভারতের পাসপোর্ট ব্যবহার করে জার্মানিতে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পান বলেও জানা যায়। সেখান থেকেই মূলত ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে বেড়াতেন জিসান।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শীর্ষ সন্ত্রাসী,জিসান আহমেদ,সন্ত্রাসী,দুবাই
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close