জোবায়ের মিলন

  ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

প্রাজ্ঞজন সৈয়দ আবুল মকসুদ

সৈয়দ আবুল মকসুদ (২৩ অক্টোবর ১৯৪৬—২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১)

সমকালীন তটে তাকালে সৈয়দ আবুল মকসুদকে একজন টকশো আলোচক, সমসাময়িক বিষয়ের বিশ্লেষক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার এবং ন্যায্যতার পক্ষের প্রতিবাদী বক্তা হিসেবে আমরা অধিক চিনে থাকি। তাকে চিনে থাকি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আন্তর্জাতিক ব্যত্যয়ে সভা, সমাবেশ আর মানববন্ধনের সামনের সারির কণ্ঠ-ছাড়া সফেদ মানুষ হিসেবে। দেশ, রাষ্ট্র, অবক্ষয়, বিচ্যুতি, বিশ্বভাবনার সরল গদ্য লেখক হিসেবে বিগত বহু বছর সৈয়দ আবুল মকসুদকে প্রবল চিন্তক বা বুদ্ধিজীবী চিহ্নিত করা হলেও সৈয়দ আবুল মকসুদ যে একাগ্রে গভীর সাহিত্য গবেষক, জীবনীকার, সাহিত্যের বহু-মাত্রিকতায় বিজ্ঞ নিবন্ধক তা অনেকটা আড়ালেই ডুবোজাহাজের সুস্থির নাবিকের মতো।

সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন সাংবাদিকতায় এম আনিসুজ্জামান সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘নবযুগ’ পত্রিকায় কাজের মাধ্যমে। লেখার হাত এখানেই পাকে। পরে আরেক সাপ্তাহিক ‘জনতা’য় কর্ম বদল করেন। পরে স্বাধীন দেশে বাংলাদেশ বার্তা সংস্থায় যোগ দেন। সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ। প্রবন্ধে বিশেষ মনোযোগিতা তখনই তাকে বিশেষ পরিচিতি এনে দেয়। পেশাগত লেখালেখির সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরো মনোনিবেশ করেন ব্যক্তিগত বিভিন্ন মাত্রিক লেখালেখিতে।

ষাটের দশকেই এই প্রথিতযশা লেখক শুরু করেন তার নিয়মিত সাহিত্যচর্চা। তবে পারিবারিক বা রক্তপ্রবাহের মধ্যে সৈয়দ আবুল মকসুদের সাহিত্য প্রোথিত ছিল তারও আগে, তার পিতার সাহিত্যচর্চার সময়কাল থেকে। পিতার সাহিত্যপ্রীতির কারণে শৈশবেই তিনি দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকা ও তার সাহিত্যাংশ পড়ার সুযোগ লাভ করেন। সেসময়ে তাদের বাড়িতে নিয়মিত আসত কলকাতার আনন্দবাজার, দ্য স্টেটম্যান, ইত্তেহাদ, আজাদ, ইত্তেফাক, মর্নিং নিউজ। এসব পত্রিকায় সেই বয়সেই তিনি সম্পাদকীয় ও প্রবন্ধের প্রতি নজর রাখেন, গল্প কবিতার প্রতিও টান বোধ করেন, যা কৈশোরে স্থানীয় ছোট কাগজে তাকে লেখার প্রতি উৎসাহী করে তোলে। তারুণ্যে এসে প্রসারিত হতে থাকে লেখার হাত। সমানতালে তিনি লেখেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য। তা বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ পায় ধারাবাহিকভাবে। লেখাকে তিনি গ্রহণ করতে থাকেন আরেক পেশা হিসেবে।

২০০৮ সালের দিকে এসে পেশাগত সাংবাদিকতা থেকে বিদায় নিয়ে নিয়মিত কলাম লেখক হিসেবে ‘সহজিয়া কড়চা’ এবং ‘বাঘা তেঁতুল’ শিরোনাম দিয়ে নিয়মিত গদ্য, প্রবন্ধ লিখতে থাকেন সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐহিত্য নিয়ে। যাপিত জীবনে সুন্দরের ধারক ও বাহক মতো তিনি অন্যায়, অবিচার, অব্যবস্থা, অনিয়মের প্রতি সোচ্চার হয়ে উঠেন তার ক্ষুরধার লেখার মাধ্যমে। সুনাম অর্জন করেন। হয়ে উঠেন কিংবদন্তিতুল্য লেখক।


তাকে পুরো পাঠ না করলে অজানাই থেকে যাবে সৈয়দ আবুল মকসুদ। অনাদরে নষ্ট হবে আদরের সৃষ্টি, জ্ঞানের গড়িমা


নীরবে আপন মনে নিজ কাজ করে যাওয়া সৈয়দ আবুল মকসুদকে আন্দোলনে, আলোচনায় দেখা যায় বলে অনেকেরই জানা নেই, সৈয়দ আবুল মকসুদ সাহিত্যের ক্ল্যাসিকধর্মী গবেষকদের মধ্যেও অন্যতম। তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে গবেষণা করে লিখেছেন ‘রবীন্দ্রনাথের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন, প্রভৃতি’। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে নিয়ে গবেষণালব্ধ রচনা ‘গান্ধী, নেহেরু ও নোয়াখালী’। ঢাকায় বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে ‘ঢাকার বুদ্ধদেব বসু’। এ ছাড়াও ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা, অরণ্য বেতার, কাগমারী সম্মেলন’ ইত্যাদি তার অনন্য এক গবেষণাগ্রন্থ। প্রখ্যাত সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদদের জীবন ও জীবন-কর্মকা- নিয়ে জীবনীগ্রন্থ রচনায়ও সৈয়দ আবুল মকসুদ ভিন্নতার স্বাক্ষর রেখেছেন আপন সাহিত্যিক নিষ্ঠা ও মনন শুদ্ধতার গভীর অঙ্কনে।

বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবনগাথা নিয়ে লিখেছেন জীবনীগ্রন্থ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য (২০১১), স্মৃতিতে ওয়ালীউল্লাহ (২০১৪)। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জীবন নিয়ে লিখেছেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জীবন, কর্মকাণ্ড ও দর্শন (১৯৮৬), লিখেছেন ভাসানী কাহিনি (২০১৩)। তিনি লিখেছেন, গান্ধী মিশন ডায়েরি, পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ দার্শনিক, পথিকৃৎ নারীবাদী খায়রুন্নেসা খাতুন, মোতাহার হোসেন চৌধুরী ইত্যাদি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের ইতিহাস, প্রথম উপাচার্য হার্টগের জীবনী। এখন অনেকেই তাকে কলাম লেখক হিসেবে জানেন, কিন্তু তার মতো একনিষ্ঠ গবেষকের পুরো পরিচয় জানলে, তার বইগুলো পড়লে সবাই বিস্মিত হবেন নিঃসন্দেহে। এই তো সপ্তাহ এক আগে প্রকাশিত হলো তার আরেক কর্ম নবার সলিমুল্লাহ ও তার সময়। এ অঞ্চলের উচ্চশিক্ষা, বহুপক্ষীয় বুদ্ধিবৃত্তিক সাম্প্রদায়িকতার মুখ উন্মোচন করে গতানুগতিক ধারা পাল্টে দিয়ে এমন কষ্টসাধ্য কাজ সৈয়দ আবুল মকসুদ ছাড়া আর কার দ্বারা অত সহজ?

কাজের তাগিদে বা শখে বা সাহিত্যের প্রয়োজনে পৃথিবীর নানান প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোকে সৈয়দ আবুল মকসুদ কেবল বেড়ানো তো বন্দি করে রাখেননি। শান্ত পায়ের বিচরণকে পরিশ্রমী হাতের আঙুলে তুলে এনেছেন সাহিত্য রসোসান্নিধ্যে। দ্বিধাহীন তিনি লিখেছেন ভ্রমণকাহিনিও। সে কাহিনি শুধু কাহিনি না, চলা ও দেখার বর্ণনা না, তা নিখাদ সাহিত্য। সাহিত্য গুণে পরিপুষ্টতার ‘জার্নাল অব জার্মানি’ ভ্রমণ কাহিনি সমগ্র গ্রন্থটি পড়লে তা স্পষ্টত ধরা পড়ে। স্বদেশ ও মাতৃভূমির স্বপক্ষে নানান সংগ্রাম ও আন্দোলনেও এই লেখকের রয়েছে উজ্জ্বল ও অনবদ্য ভূমিকা। সে আলোচনা আরেক অধ্যায়।

কবিতায়ও সৈয়দ আবুল মকসুদ নিরলস কাব্যকর্মী। কবিতা দিয়েই শুরু হয়েছিল বিশাল সাহিত্য সভায় প্রবেশ। চটপটে তার কবিতা। ঝরঝরে, সময় বাস্তবতার স্পষ্ট ছবি। নিংড়ানো জীবনের অকথিত কথা, সত্য সভ্যতার চিত্র আঁকা তার কবিতার গায়ে। সৈয়দ আবুল মকসুদের কবিতাকেও এড়িয়ে যাওয়ার কোনো জো নেই। সুযোগ নেই অন্য লেখার কাতারে খাটো করার। ‘সামান্য কিছু জলজ গুল্ম দেখেই জানতে পারেন তিনি/সমুদ্রের সমস্ত সংলাপ,/লিখতে পারেন তিনি এক টুকরো সবুজ শৈবালে/সাগরের সকল গল্প;/... পাথরের পর্বতকে যখন তিনি কলমের নিব দিয়ে/সজোরে মারেন আঁচড়/দুভাগ হয়ে যায় গিরি—বেরোয় রক্তের ফল্গুধারা:/তার লেখার লোনা কালি;’ (কবি, বিকেলবেলা)। আবার ‘... হে মৎস্যকন্যা!/একদিন শুধু স্বপ্নেই তোমাকে পেয়েছিলাম/আধেক মাছ আর আধেক মানবী,/মোহন নীল টানা-চোখ,/রক্তিম কপোলে পৃথিবীর সূক্ষ্মতম কোমলতার ছোপ,/মায়াবী পুচ্ছে তোমার সবুজ ও নীল ডোরা,/চাঁদনী রাতে সমুদ্রে আমার একাকিত্বের সুযোগে/তুমি ভেসে উঠলে আর আমাকে পিঠে নিয়েই এক ডুবে/চলে গেলে জলের তলদেশে এক বিজনপুরীতে/যেখানে রত্নখচিত বিশাল প্রাসাদে/তুমি একা-তুমি একাকিনী।’ (মৎস্যকন্যা : আমার কবিতা, বিকেলবেলা)। তার প্রথম কবিতার বই ‘বিকেলবেলা’ প্রকাশ হয় ১৯৮১ সালে। এর পরিমার্জিত ও বর্ধিত সংকলন বের হয় ফের ২০১৯। ‘দারা শিকোহ ও অন্যান্য কবিতা’ বের হয় ১৯৮৭ আর ‘সৈয়দ আবুল মকসুদের কবিতা’ বের হয় ২০১২ সালে।

বর্ণাঢ্য এক লেখক-জীবনে আবুল মকসুদ অতীব নিশ্চুপে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন লেখার, সাহিত্যের মাঠে। কেউ জানেন, কেউ জানেনই না আবুল মকসুদ কতটা নিবিষ্ট ছিলেন একার কাজে। সৃজনশীল লেখার কাজে। সপ্তাহের এ-মাথায় ও-মাথায় দৈনিকের পাতায় চলমান কিংবা আলোচ্য বিষয় নিয়ে কড়কড়া প্রবন্ধ আর আলোচনা অনুষ্ঠানের সেটে তাকে দেখে অনেকেই ধরে নিয়েছি, সাদা চাদরের এই সৈয়দ বুদ্ধিবৃত্তির লোক। অন্তরালে যে এই সেই আবুল মকসুদ যার সারাটা জীবন গেল সৃষ্টিশীল রচনায়, গবেষণায়, প্রদীপ্ত প্রবন্ধ ও কবিতার বাক্সময়তায়; তাকে পুরো পাঠ না করলে অজানাই থেকে যাবে সৈয়দ আবুল মকসুদ। তার নিভৃতের কাজ নিয়ে আলোচনা না হলে আড়ালেই থেকে যাবে তা। অনাদরে নষ্ট হবে আদরের সৃষ্টি, জ্ঞানের গড়িমা।

তেইশে আগমন (জন্ম: ১৪৮৬, অক্টোবর) তেইশেই বিদায় (মৃত্যু: ২০২১, ফেব্রুয়ারি) হলেন এই অনাড়ম্বর লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ। আমরা তার আত্মার প্রশান্তি এবং সৃজনশীল সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই অবনত চিত্তে।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সৈয়দ আবুল মকসুদ,সাহিত্য,কবিতা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close