প্রতীক ইজাজ

  ১৮ জানুয়ারি, ২০১৭

এখন ফাঁসির অপেক্ষা

নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলার রায়টি নিঃসন্দেহে বিরল। নানা কারণেই ব্যতিক্রমীও বটে। এত দ্রুত ও একসঙ্গে এত আসামির মৃত্যুদন্ডাদেশের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন স্বস্তি এসেছে দেশে; তেমনি বিচার বিভাগের প্রতি আরেক দফা আস্থা এসেছে মানুষের। নিহতদের স্বজনরা কিছুটা হলেও শান্তি পেয়েছেন। বিচারহীনতার শঙ্কা কাটিয়ে দেশে বিচার বিভাগ যে স্বাধীনÑএমন দাবিতে স্বস্তি এসেছে সরকারেও। এই প্রথম একটি রায়ে কোনো ধরনের বিরূপ মন্তব্য করেনি কোনো মহল। এমনকি র‌্যাবের মতো একটি এলিট ফোর্সের ২৫ শীর্ষ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন স্তরের সদস্যদের মৃত্যুদন্ডসহ বিভিন্ন সাজা হওয়ায় জননিরাপত্তা নিয়েও আশান্বিত সাধারণ মানুষ। এখন অপেক্ষা কেবল রায় কার্যকরের। অর্থাৎ দেশের মানুষ এখন অধির প্রতীক্ষা করছে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নৃশংস ঘাতকদের মৃত্যুদন্ড দেখার।

গত সোমবার রায় ঘোষণার পর থেকেই মৃত্যুদন্ডাদেশ হওয়া ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকরের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে দেশের মানুষ। সভা-সেমিনারে, পথেঘাটে, আলাপচারিতায় ফাঁসি কার্যকরের দাবিতে মুখর বিভিন্ন অঙ্গন। নিহতদের স্বজনদের প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে খুনিদের ফাঁসি কার্যকর দেখতে চেয়েছেন। তারা এ রায় কার্যকর করতে সরকারের প্রতি সনির্বন্ধ আবেদনও জানিয়েছেন। রায় কার্যকরে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সরকার ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরাও। যদিও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা সাজা মওকুফের জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করার ঘোষণা দিয়েছেন; কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও সরকার মনে করছে, উচ্চ আদালতেও এ রায় বহাল থাকবে এবং খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা যাবে।

যদিও রায় কার্যকরে বিভিন্ন মহল আশান্বিত; কিন্তু সেই সঙ্গে আলোচনায় আসছে নানা প্রশ্ন ও উদ্বেগ। শেষ পর্যন্ত কি উচ্চ আদালতে রায়টি বহাল থাকবে, নাকি খালাস পেয়ে যাবেন আসামিরাÑএমন প্রশ্ন যেমন উঠছে; তেমনি শেষ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি বিশেষ ক্ষমা ঘোষণা করেন কি নাÑসে নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন কেউ। নাকি দীর্ঘসূত্রতার কারণেও কোনো জটিলতা দেখা দিতে পারেÑআলোচনায় এসেছে এমন বিষয়ও।

বিভিন্ন মহলের এমন শঙ্কা ও প্রশ্ন নিয়ে গতকাল প্রতিদিনের সংবাদের সঙ্গে কথা হয় দেশের আইনজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মী ও

অপরাধ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। তারা মনে করছেন, যে দেশে এমন যুগান্তকারী রায় ঘোষণা হতে পারে, সে দেশে রায় কার্যকরেও নতুন দৃষ্টান্ত ঘটতে পারে। তবে একই সঙ্গে তারা রায় কার্যকর নিয়ে সম্ভাব্য কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও বলেছেন। তারা বলেছেন, দন্ডপ্রাপ্তরা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর। সেখানে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ও র‌্যাবের মতো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও রয়েছেন। সুতরাং নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া আইনগত দীর্ঘ প্রক্রিয়াও একটি বিষয়। সুতরাং সরকারকে এ রায় কার্যকর করতে হলে দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে ও বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। রাষ্ট্রের সদিচ্ছার ওপর এ রায় কার্যকর নির্ভর করছে বলেও মত দেন অনেকে।

নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন গত সোমবার এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে নারায়ণগঞ্জের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদন্ড এবং বাকি নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়। সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ২৫ জনই র‌্যাবের। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের পর ঠান্ডা মাথায় হত?্যা করে লাশ ডুবিয়ে দেওয়া হয় শীতলক্ষ?্যা নদীতে। ওই ঘটনা সে সময় পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেয়; হত্যাকান্ডে র‌্যাবের কয়েকজনের জড়িত থাকার তথ?্য বেরিয়ে এলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও শিরোনাম হয়। নৃশংসতায় শিউরে ওঠে মানুষ। নারায়ণগঞ্জ হয়ে ওঠে আতঙ্ক ও কান্নার শহর।

রায় নিয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য না করলেও গতকাল রায় কার্যকর নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিএনপি। রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসনে আলাল বলেন, রায় কার্যকর নিয়ে জনগণ শঙ্কিত। কারণ বর্তমান রাষ্ট্রপতির আমলেই অনেক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আর যাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে তাদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের। এ মামলায় যারা ফাঁসির আসামি, তাদের যদি আবার রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দেন, তাহলে আইনের শাসনের প্রকৃত কার্যকর হবে না এবং মানুষের প্রত্যাশাও পূরণ হবে না। তবে সে শঙ্কা কাটিয়ে নিম্ন আদালতের দেওয়া রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গতকাল তিনি বলেন, আদালত যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন; আমরা আশা করি নিম্ন আদালতের এ রায় উচ্চ আদালতেও একই থাকবে, বজায় থাকবে। বিচার বিভাগ যে স্বাধীন, তা এ রায় প্রমাণ। সুতরাং শঙ্কার কিছু নেই। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।

আইনজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে ফাঁসি কার্যকরের ক্ষেত্রে দুটি বিচারিক ধাপ ও অনেকগুলো প্রক্রিয়ার কথা জানা গেছে। তারা জানান, প্রথমেই মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মৃত্যু অনুমোদনের জন্য মামলাটি হাইকোর্টে ‘ডেথ রেফারেন্স’ হিসেবে আসবে। এ মামলার যাবতীয় নথি ও রায়ের কপি বিচারিক আদালত থেকে ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে পাঠাবেন রায় প্রদানকারী বিচারক। রায়ে স্বাক্ষর করার পরপরই এগুলো পাঠানোর রীতি রয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, নিম্ন আদালতের দেওয়া ফাঁসির রায় কার্যকর হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না হাইকোর্ট তা কনফার্ম (অনুমোদন) করেন। বিচারিক আদালতের রায় নথিসহ ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে আসবে। ডেথ রেফারেন্স হিসেবে আসার পর এ মামলার দ্রুত শুনানি শুরু করার চেষ্টা করা হবে।

ডেথ রেফারেন্স পাঠাতে কত সময় লাগেÑজানতে চাইলে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, অধস্তন আদালত থেকে ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর ওই রায়ে বিচারক স্বাক্ষর করার সঙ্গে সঙ্গেই তা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেবেন। এটাই প্রচলিত রীতি। এ ক্ষেত্রে ফাঁসির আদেশ দিয়ে ঘোষিত রায়ে বিচারকের স্বাক্ষর হওয়ার পর নথি পাঠাতে বিলম্ব করার কোনো সুযোগ নেই। রায় ঘোষণার দিনেই অনেক মামলা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে ওই জেলা জজ হাইকোর্টে পাঠিয়েছেন বলেও জানান তিনি। মামলাটি ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে আসার পাশাপাশি আসামিরা হাইকোর্টে আপিল দায়ের করতে পারেন। এ আপিল দায়েরের ক্ষেত্রে তারা আইন অনুযায়ী ৩০ দিন সময় পাবেন। আর যদি কেউ আপিল না করেন, তাহলে তাদের ক্ষেত্রে শুধু ডেথ রেফারেন্সেরই শুনানি হবে। এরপর হাইকোর্ট মামলাটি শুনানির জন্য প্রথমেই মামলার পেপারবুক (মামলার এফআইআর, চার্জশিট, বিচারিক আদালতের রায়সহ যাবতীয় তথ্যসংবলিত নথি) তৈরি করবেন। এটি তৈরি হলে প্রধান বিচারপতি যদি চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ ডেথ রেফারেন্স মামলাটি শুনানির উদ্যোগ নেন, সেক্ষেত্রেও শুনানি শুরু হতে প্রায় এক বছর সময় লেগে যেতে পারে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি না করলে এ সময় আরো বেশি লাগবে।

এ ব্যাপারে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ শ ম রেজাউল করিম বলেন, যদি অন্য মামলার মতো এই মামলাও একই নিয়মে চলে তাহলে চূড়ান্ত রায় পেতে সময় লেগে যাবে। মামলাটি সংবেদনশীল হওয়ায় দ্রুত নিরসন প্রয়োজন। এই আইনজ্ঞ বলেন, হাইকোর্টের রায়ের পর আপিল দায়েরের জন্য দুই মাস সময় পাবেন। এরপর মামলাজট আর বিচারব্যবস্থার ধীরগতির কারণে এই আপিলের শুনানি কত তাড়াতাড়ি বা কত দেরিতে হবে, তা বলা সম্ভব নয়। আপিলের শুনানি শেষে আপিল বিভাগও আসামিদের ফাঁসি বহাল রাখলে, তখন আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউয়ের) আবেদন জানানোর সুযোগ পাবেন আসামিরা। এ রিভিউ দায়ের করার ক্ষেত্রে তারা এক মাস সময় পাবেন। এরপর রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে তা খারিজ হওয়ার পর আসামিদের ফাঁসি কার্যকরের দিনক্ষণ গণনা শুরু হয়ে যায়। আদেশের কপি হাতে পেয়ে জেল কোড অনুযায়ী আসামিদের ফাঁসি কার্যকর করার ক্ষেত্রে ‘২১ দিনের আগে নয় এবং ২৮ দিনের পরে নয়’ বলে যে বিধান রয়েছে তা অনুসরণ করবে জেল কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি এ সময়ের মধ্যে আসামিরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগও নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করলে তারপর আসামিদের ফাঁসি কার্যকর হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল এ মামলার বিচার করা। কারণ সেখানে সরকারদলীয় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের আত্মীয়স্বজন এবং দলীয় লোকজন ছিল। র‌্যাবের মতো একটি সংস্থার লোকজনও ছিল। সেখানেই যখন সফল হয়েছে, তাই এখানেও সফল হবে। কত মানুষ কত রকমের আশঙ্কা করেছিল এ বিচার নিয়ে। সে শঙ্কা তো কেটে গেছে। বাধা থাকবে। সেটা অতিক্রম করতে হবে। সব বাধা অতিক্রম করেই তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে। সুতরাং এটাও হবে। আমি আশাবাদ। সে আশাবাদে অটুট থাকতে চাই।’

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, দেশে ভয়ের সংস্কৃতি কাটিয়ে তুলতে এ রায় অগ্রগতি। বেআইনি নির্দেশনা ও বাস্তবায়নকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, কেউ-ই যে আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং তাদেরও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় ও সাজা পেতে পারেনÑএ রায় সে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে আইনি প্রক্রিয়া শেষে ফাঁসি কার্যকর করতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কারণ এর সঙ্গে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি জড়িত। রাষ্ট্র যদি এ রায় কার্যকর করতে চায়, তাহলে স্বাভাবিক আইনি প্রক্রিয়ায় গেলে হবে না। দীর্ঘ সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে প্রভাবিত করার একটা সুযোগ থেকে যায়। তাই রাষ্ট্রকে বিশেষ ব্যবস্থায় দ্রুততার সঙ্গে রায় কার্যকর করতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সদিচ্ছার ওপর এ রায় কার্যকর নির্ভর করছে। এ বিশেষজ্ঞ এ কথাও বলেন, র‌্যাবের ভেতর আরো কোনো বিচ্যুতি রয়েছে কি না, প্রশাসনিকভাবে সেগুলোর তদন্ত করতে হবে ও বিচার করতে হবে।

পিডিএসও/মুস্তাফিজ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist