আজাদ মণ্ডল

  ১৭ জানুয়ারি, ২০২০

সবুজ আফিম

সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে দুচোখে আসে রাজ্যের ঘুম। ক্লান্তিতে শরীরের সচল কোষ করে অবশ। স্পিডের কাজে আসে ধীর। কারণ খুঁজে পাই কাজের অস্পৃহার। ছোটবেলার স্মৃতিও মনে করিয়ে দেয় বিষয়টা। আপ্লুত হই। দল বেঁধে দূর গ্রামে রাত জেগে ভিসিআর দেখে, পরের সারা দিনে ঘুম চোখে ডুলোডুলো হয়ে থাকা ছাড়া ভাবনার তেমন কিছু ছিল না। যখন তখন ঘুমিয়েও নেওয়া যেত। কিন্তু একই কারণ বর্তমানের পরিস্থিতিতে আছে শঙ্কা। অফিসে বসে যখন-তখন তো আর ঘুমানো যায় না। বর্তমানটায় রুটিরুজির সঙ্গে উন্নত ক্যারিয়ার জড়িয়ে আছে। এই সময়টাতে অফিসের বসদের চোখে কৃত্রিমভাবে হলেও থাকতে হয় নিবেদিত কর্মপ্রাণ এক কর্মবীর।

কিন্তু কৃত্রিমভাবে কর্মবীর প্রমাণ করা গেলেও চোখের পাতা তো কৃত্রিমভাবে খোলা রাখা যায় না। চোখ-মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে হয়তো মুক্তি পাওয়া যায় সাময়িকভাবে। কিন্তু শরীর ইন্দ্রীয়গুলো সচল রাখতে যে পরিমাণ নিয়মের মধ্যে ঘুমাতে, খেতে, আনন্দ মনে থাকতে হয়। সেই পরিমাণের হয়তো অতিক্রম করে না তেত্রিশ শতাংশ। ফলে, শরীরে ঝেঁকে থাকে ক্লান্তি ।

খুঁজে পাওয়া কারণ পর্যবেক্ষণ করি। অফিস থেকে বাসায় ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে যখন বিছানায় গা এলিয়ে দিই। তখন ক্লান্তির নদীতে ভাটা পড়ে চোখ চলে যায় স্মার্টফোনের সবুজপুরের জাদুর স্কিনে। এ এক মারাত্মক নেশার জাদু জগৎ। এ নেশা নিকোটিনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। যারা নিকোটিনে আসক্ত তাদের যেমন কিছুক্ষণ পর পর রক্ত নিকোটেনের জানান দেয়। স্মার্টফোনের সুবজ স্কিনের জাদুও মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মায়ার জাল বিস্তার করে। এটা সবুজপুরের জাদু মন্ত্রের মায়া। এই মায়া দিনের আলোতে কিছুটা সুপ্ত থাকলেও রাতের বেলায় রুমের নিয়ন আলোতে মনের অন্তঃকোণে প্রবেশ করে রাস্তায় চলা গাড়ির কালো ধোঁয়ার মতো। ধোঁয়ায় আছন্ন করে অন্তপুর। নেশায় বুদ হয়ে ডুবে যাই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আত্মার কৃত্রিম শান্তির আরাধ্য পরমে। এই মায়ার প্রবল প্রতাপে সময় চুরি হয়ে যায়। ফলে গ্রামে বাবা, মা, ভাই, বোন কিংবা আত্মীয়স্বজনদের ঠিকঠাক খবর নেওয়া হয় না।

খোঁজখবর না নেওয়ার অভিযোগে আশ্রয় নিই মিথ্যার। মিথ্যা বাহানায় হই নির্লজ্জ। তখন উল্টো সান্ত¦না পাওয়া হয়, ‘ভাবিস না আমাদের কথা। পরিশ্রম করে যা, পরিশ্রমই সৌভাগ্যের প্রসূতি। আর খালি কাজ নিয়ে ডুবে থাকিস না। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস, ঘুম দিস। মনে রাখিস, কাজ আর বিশ্রাম একে অন্যের পরিপূরক। শরীর ঠিক না থাকলে তো পরিশ্রম করতে পারবি না।’

উপদেশ শোনার শেষে হাফ ছেড়ে বাঁচি। স্বজনদের তত্ত্ব কথা বিষাদ লাগে। জ্ঞান করি না সুখের। বরং বিরক্ত হই। আমি কী ছোট যে পই পই করে এত জ্ঞান দিতে হবে। তবে অভিনয় করে বুঝিয়ে দিই তাদের কথার যথেষ্ট গুরুত্ব আছে আমার কাছে। আশ্বস্ত হয় আপনজন। দূর থেকে তাদের অকৃত্রিম হাসির শব্দ শুনি। অভিনয় দক্ষতায় গর্বিত হই। কাছের জনেরা আমাকে বিশ্বাস করে।

সবুজপুরের জাদুমন্ত্রে গা ভাসিয়ে কৃত্রিম সুখে আবগাহন করি অবিশ্বাস্যভাবে। সবুজ স্কিনের অপর প্রান্তে অপরিচিত মানবীকে সরি বলি দীর্ঘক্ষণ পরে রিপ্লাই দেওয়ার হেতুতে। অপরিচিতার অভিমান কাটে না তবু। তার সন্দেহ বাড়ে। অভিযোগ করে, তাকে লাইনে রেখে আমি অন্যের সঙ্গে চ্যাটিং করছি। বাথরুমে গেছিলাম বলে অপরিচিতাকেও মিথ্যা বলি। সত্য-মিথ্যার ভেজাল মান-অভিমান চলে সমান তালে। চলে সময়ক্ষেপণ। অহেতুক চ্যাটিং লেনদেনে সময় গড়ায় অগভীর থেকে গভীরে।

সবুজপুরের মায়ার জগতে আপনজন যারা যুক্ত আছেন তাদের সঙ্গে হাই হ্যালোতেই শেষ। তাও আবার কালেভাদ্রে। ডিটেলস খোঁজ নেওয়া তেমন হয় না। অপরিচিতার সঙ্গে মান-অভিমানের পর্বই এখানেই মূল। সকালে উঠে মেসেজ না দিলে অভিমান! অফিসে পৌঁছে কেন জানালাম না, অভিমান! লাঞ্চের আগে না বললে, অভিমান! অফিস থেকে বেরোনোর আগে মেসেজ না করলে, অভিমান! বাসায় ফিরে জানালে না কেন, অভিমান! অমুকের পোস্টে লাইক দিলে কেন, অভিমান! তমুকের পোস্টে লাভ রিয়েক্ট দিলাম কেন, অভিমান! তার পরও অভিমান ভেঙে মান আসে। ততক্ষণে রাত গভীর হয়ে যায়।

একসময় শেষ হয় মান-অভিমানের বায়বীয় পর্বও। হঠাৎ অপরিচিতা সবুজপুরের জাদুর ভুবন থেকে নিরুদ্দেশের আবহ সুর-সংগীত বেজে ওঠে। তার স্মার্টফোনের স্কিনে সবুজটিপের মতো আলোক বিন্দু আর থাকে না। হাতড়িয়েও পাওয়া যায় না জবাবদিহির জন্য। অপরিচিতার সঙ্গে লেনদেন থাকে সবুজটিপ জ্বলা পর্যন্তই। সম্পর্ক বায়বীয় বলে উড়িয়ে দিতে হয়। শুকনো নদীর মতো দাগ হয়তো থাকে কিছুদিন। তার রেশে উল্টা-পাল্টা চলে ফেবুকের অন্য সব স্ট্যাটাসে। তখন জ্ঞানগর্ভ স্ট্যাটাসে দিই হাহা রিয়েক্টের মনোগ্রাম। কৌতুকপূর্ণ স্ট্যাটাসে দিই গম্ভীর রিয়েক্ট। কমেন্টও চলে এলোমেলো। স্ট্যাটাস না পড়েই জানান দিই গুড, বেটার, বেস্ট।

তারপর আবার সবুজপুরের মায়া জাদুর গুণে শুকনো দাগ মøান হতে বেশি দিন সময় লাগে না। পৃথিবীর ঘূর্ণন আবৃত্তের সঙ্গে সমান তাল রেখে চলে অপর কোনো অপরিচিতার সবুজটিপে টোকা দেওয়ার পালা। কখনো আবার আরাধ্য দেবী নিজে এসে ধরা দেয় মর্তের সবুজপুরে। দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে খেলা চলে মান-অভিমানের। আবার সবুজপুরের মায়ার আফিমে মত্ত হই।

কোনো অপরিচিতা আবার চোরের ওপর বাটপারির মতো করতে চায় বা করে। তখন নিম্নমানের অভিনেতার অভিনয় করি। অপরিচিতা যখন বুঝতে পারে অপজিট গোলকিপার নিতান্তই অপরিপক্ব। যেকোনো অ্যাঙ্গেল থেকে কিক মেরে বল জালে জড়ানো সম্ভব। তখন সে প্লান্টি কিক মারে। ‘বাবা এই মাসের হাত খরচ এখনো পাঠাইনি, হাত খালি। আপাতত কিছু টাকা দাও। আবার ভেব না এমনিই নিচ্ছি। ধার হিসেবে দাও। বাবা দিলে দিয়ে দেব।’ এরূপ করুণ আবেদনে অভিনয় ঠিকমতো করা যায় না। গুটিয়ে নিই। ব্লক মেরে অপরিচিতার সবুজ আলোর টিপ অফ করে দেই অট্টহাসি হেসে।

কখনো-সখনো আবার নিজেই সবুজপুরে অপরিচিতার ভূমিকায় অভিনয় করি। সুন্দরী ললনার নাম ও ছবি দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলি। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টে অফিসের বস সারা দেয় অবলীলায়। চলে বসের সঙ্গে প্রেমলীলা। বস পরিবারের চোখ ফাঁকি দিয়ে মত্ত হয়ে উঠে সবুজপুরের রঙ্গরসে। অফিসে কাজের ফাঁকে জিজ্ঞেস করি, ‘বস আপনার চোখ লাল কেন? রাতে ভালো ঘুম হয় নাই?’ বস আমার প্রশ্নের উত্তর দেয় না। তোষামোদ করছি ভাবে। ক্ষমতাবলে খিস্তি কাটে, ‘আমার চোখ লাল না হলুদ থাকুক, সেটা তোমাকে দেখতে বলছি? আমার কাছে কিন্তু তোষামদের ভাত নাই। মন দিয়ে কাজ কর।’ বসের কথায় রাগ হয় না উল্টো হাসি পায়। বসের রুম থেকে বের হয়ে হাসিও। ডেক্সে বসে মনে মনে বসের সঙ্গে রাতের চ্যাটিংয়ের প্ল্যান তৈরি করি।

তবে, এই সবুজপুরের আবহ সংগীতের সুরঝংকারে মাতোয়ারা পাবলিক কেবল আমি একা নই। মনে হয়, আমাদের মেসের প্রত্যেক মেম্বারের শিরা বা ধমনিতে এই একই সুর সমবহমান। রুমে ঢুকলে একটা সময়ের পর দেখা যায়, সবার চোখের সামনে স্মার্টফোনের সবুজ আলো। নিজেকেও সরিয়ে রাখতে পারি না। কর্মব্যস্ত দিনের কোনো এক ফাঁকে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি আর না। মিথ্যা ছলছাতুরীর মহামায়া থেকে আজ রাত থেকেই বের হয়ে যাবো। কিন্তু রাতের নিয়ন আলোতে প্রতিজ্ঞা ভুলে যাই। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই, মনের অজান্তে কোনো এক কুক্ষণে হাতে চলে যায় স্মার্টফোন নামক জাদুর বাক্সে। আর তাতে চোখ আর হাত বুলানো চলে গভীর রাত পর্যন্ত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close