আশরাফুল ইসলাম

  ২৬ জুলাই, ২০১৯

রূপাহীন এই নগরে

রাস্তার পাশে একটি সাদা টয়োটা এসে থামলো। জানালার গ্লাস নেমে গেল। কেউ একজন মিষ্টি কণ্ঠে ডাকলো, হিমু ভাই... এই হিমু ভাই?

রাস্তার পাশ থেকে একজন যুবক উদাস চাহনিতে গাড়ির জানালায় তাকাল। একজন তরুণী জানালা দিয়ে মুখ বের করে আছে।

-হিমু ভাই, আপনি এখানে কি করেন? আপনার তো ময়ূরাক্ষীর তীরে থাকার কথা। এই পল্টনের কাদাপানি ভরা রাস্তার পাশে বসে বসে পান খাচ্ছেন কেন? গাড়িতে উঠুন।

হিমু কণ্ঠে খুব আন্তরিকতা মিশিয়ে বলল, জেসমিন, আমি একটা কাজে এসেছি। এখন কোথাও যেতে

পারব না।

তরুণী মেয়েটি একটু কঠিন স্বরে বলল, হিমু ভাই, আমি আপনাকে অনেকবার বলেছি আমার নাম জেসমিন না, আমার নাম রিমি।

-ওহ তাইতো। রিমি। গত সাতটা বছর আমার সবকিছু এলোমেলো। কারো নাম মনে রাখতে পারি না। উল্টাপাল্টা বলে ফেলি। আমার স্রষ্টা তো এই পৃথিবীতে নেই, হুমায়ূন স্যার যতদিন ছিলেন, আমি একটা ছকে বাঁধা ছিলাম। জীবনটা সেভাবেই চলত। প্রতি বইমেলায় আমার নতুন নতুন কাহিনি বের হতো। তবে আমার সবকিছু ছিল পুরনো ছকে বাঁধা। পকেটবিহীন পাঞ্জাবি, স্যান্ডেল ছাড়া পা ইত্যাদি। এখন দেখছো আমার পায়ে স্যান্ডেল। আমি কিনিনি। মাজেদা খালা গাউছিয়া থেকে কার জন্য কিনেছিল। তার পায়ের মাপে খাটেনি বলে আমাকে দিয়েছে। আমার পায়েও খাটেনি। তবু পরছি আর কি। আচ্ছা রিমি, বাদলের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে? যদি থাকে একটা ফোন করব বাদলকে। নাম্বার আছে?

-কোন বাদলের কথা বলছেন?

-কি বলছো, মাজেদা খালার ছেলে। আমেরিকায় থাকে এখন। তোমার সঙ্গে রিলেশন ছিল না? এক বৃষ্টির রাতে কত কা- হলো। তুমি রাগ করে বাদলের সঙ্গে যোগাযোগ অফ করেছিলে, বাদল আবার সেই রাতে বৃষ্টিতে ভিজেপড়ে তোমার বাসার সামনে গেল আমাকে নিয়ে, তোমার জন্মদিন না কি যেন ছিল। এইসব

আর কি।

-হিমু ভাই, আপনি আমাকে এখনো চিনতে পারেননি। আমি রিমি। আমি রূপার বান্ধবী। বাদলের ওই ঘটনা রূপার কাছে শুনেছি। সেই মেয়ের নাম শিউলি। আপনার সঙ্গে কথা বলাটাই ভুল হয়েছে আমার। এখন বলুন পল্টনে কী কাজে এসেছেন।

-ওইযে ক্যামেরা ঠিক করতে এসেছি। পানি ঢুকেছে।

-আপনি ক্যামেরা কিনেছেন হিমু ভাই? ছবি তোলার শখ কবে হলো আপনার? রূপা তো আমাকে কিছু বলেনি। বলবে কীভাবে? বিদেশে থাকে। কত ব্যস্ততা। পড়াশোনা, গবেষণা। সপ্তাহে একবার মেসেঞ্জারে কল দেয়, সব কথা বলাও হয়ে ওঠে না। যাই হোক, ক্যামেরা কিনলেন কবে?

-ক্যামেরা কিনিনি। বাদল পাঠিয়েছে আমেরিকা থেকে। গত সপ্তাহে খালুজান আর মাজেদা খালা সিলেটে গেছিল। জাফলঙে ছবি তোলার সময় ক্যামেরা পানিতে ভিজিয়েছে। আমাকে বলল পল্টনে ক্যামেরা ঠিক করার দোকান আছে। তাই আসলাম। ঠিক করতে দুঘণ্টা লাগবে। এই দুই ঘণ্টা কি করবো? তাই রাস্তার পাশে বসে মানুষজন চলাচল দেখছি। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কতদিন পর। রাস্তার পাশে বসে না থাকলে তো

দেখা হতো না।

-আপনি গাড়িতে উঠুন হিমু ভাই। আমি দুঘণ্টা পর আপনাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে যাব।

গাড়ি চলছে হাইওয়ে ধরে। গাড়ির মিউজিক প্লেয়ারে বাজছে মিষ্টি একটা গান। যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো এক বরষায়। হিমুর মনে হলো, এই গানে কিছুটা সীমাবদ্ধতা আছে। মন কাঁদলে যেকোনো সময় চলে আসা যায়। বর্ষায় কেন আসতে হবে? আর কদমগুচ্ছ খোঁপায় জড়ানো ব্যাপারটা কেমন খাপছাড়া। খোঁপায় বেলী, বকুল ফুলের মালা জড়ানো যেতে পারে। কদমগুচ্ছ খোঁপায় জড়ানোর কোনো সিস্টেম নাই। আজ পর্যন্ত হিমু একজনকেও দ্যাখেনি যে কদমগুচ্ছে খোঁপায় জড়িয়েছে।

রিমির ডাকে হঠাৎ করে এসব ভাবনায় ছেদ পড়ল।

-হিমু ভাই, আমরা কোথায় যাচ্ছি অনুমান করেন।

-মাওয়া ঘাটে।

-মাওয়া ঘাটে কেন?

-এই বৃষ্টির দিনে তোমার ইলিশ মাছ ভাজা খাইতে ইচ্ছে করেছে। তোমার বাসায় কেউ ইলিশ মাছ খায় না। এইজন্য তুমি নিজে যাচ্ছো মাওয়া ঘাটের সুস্বাদু ইলিশ খাইতে।

-উত্তর সঠিক। তবে আরেকটা কারণ আছে। সেটা বলতে পারবেন?

-হ্যাঁ।

-বলেন।

-সামনের সপ্তাহে তোমার ফ্লাইট। স্বামীর সঙ্গে বিদেশে চলে যাচ্ছো। তোমরা অস্ট্রেলিয়ার সিটিজেনশিপ পেয়েছো তো, দেশে হয়তো আর আসবা না। এইজন্য পদ্মা সেতু দেখতে যাচ্ছো। কিছু পিলার কিছু স্প্যান বসানো হয়েছে। সেগুলো নিজ চোখে দেখে রাখবা। পদ্মা সেতুর এই ডিজাইনটা করার ক্ষেত্রে তোমার কিছু অবদান রয়েছে। অথচ তোমার নাম কেউ বলেনি। ঠিক যেমন শহীদ মিনারের ডিজাইনে শুধু হামিদুজ্জামানের নাম আছে, নভেরা আহমেদের নাম নেই। মেয়েরা চিরকালই অবহেলিত।

-আপনার ধারণা ভুল। আমি বুয়েট আর্কিটেকচারের ছাত্রী, এটা ঠিক। অনেক বিল্ডিংয়ের নকশা করেছি। পদ্মা সেতুর নকশায় আমার কোনো অবদান নেই। ওসব বড় বাজেটের কাজ। আমাদের মতো ছোটখাটো মানুষের কাছে পৌঁছায় না। তবে আমি পদ্মা সেতু দেখতেই যাচ্ছি। এটা দেশবাসীর একটা স্বপ্নের প্রজেক্ট তো, সেই স্বপ্নের সঙ্গে কিছুটা একাত্মতা পেতে আর কি। আর হয়তো দেশে আসা হবে না। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো হলো। রূপা গত সপ্তাহে একটা চিঠি পাঠিয়েছে আপনাকে। হাতে লিখে স্ক্যান করে আমাকে মেইল করেছে। আমি প্রিন্ট দিয়েছি। এই নিন খাম। এটা নিয়ে বেরিয়েছি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল আপনার সঙ্গে দেখা হবে। আমার সিক্সথ সেন্স আপনার মতো অত প্রবল না, তবে কিছুটা আছে। প্রত্যেক মেয়েরই কিছু কিছু সিক্সথ সেন্স থাকে।

হিমুকে পল্টন মার্কেটে নামিয়ে দেওয়া হলো। সে চিঠির খামটা খুলে দেখল একটা পরিচিত হাতের লেখা। চিঠিতে একটা বাক্যই লেখা।

হিমু, তুমি কেমন আছো?

হঠাৎ করে হিমুর মনে হলো রূপা দেশে থাকলে মন্দ হতো না। এই যেমন একটু আগে সে একজন রিকশাওয়ালাকে পঁয়ত্রিশশত টাকা দিয়েছে, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে সে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, তার চিকিৎসা খরচ। এই টাকাটা ক্যামেরা ঠিক করা বাবদ মাজেদা খালা তাকে দিয়েছে। রূপা থাকলে ফোন করে বলা যেতÑ রূপা, পঁয়ত্রিশশত টাকা নিয়ে পল্টন মার্কেটে আসো, ক্যামেরা ঠিক করার দোকানে। তোমাকে কতদিন দেখি না। রূপা এসে দেখতো হিমু সেখানে নেই। রূপা ক্যামেরার বিল মিটিয়ে ক্যামেরা নিয়ে চলে যেত। হিমুর এইসব পাগলামির সঙ্গে রূপা পরিচিত।

হিমু জিভে কামড় দিল। সে এইসব কী ভাবছে? কোনো নারীর মায়ায় জালে জড়ানো তার জন্য নিষেধ। সে এখন রূপার কথা কেন মনে করল?

ক্যামেরা দোকানে থাকুক। তার কাছে টাকা নাই। সে ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করল। মাথাটা কেমন ধরেছে। জ্বর আসবে বলে মনে হচ্ছে। সে রমনা পার্কের বেঞ্চিতে গিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close