ইমরান হোসেন সুজন, নবাবগঞ্জ (ঢাকা)

  ১৩ আগস্ট, ২০১৮

নবাবগঞ্জের বান্দুরাবাজার

টোল আদায়ের নামে চাঁদাবাজি

স্ট্যান্ডের লিজ নিয়ে সড়ক ও সেতুর ওপর থেকে দৈনিক ১২ হাজারের অধিক চাঁদা আদায়

সরকার থেকে ইজারা দেওয়া না হলেও ঢাকার নবাবগঞ্জের বান্দুরা সড়ক ও সেতুর ওপর থেকে নিয়মিত টোল আদায়ের নামে মাসে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। স্থানীয় এন মল্লিকের পরিবহনের স্বত্বাধিকারী নার্গিস মল্লিকের নামে এই ‘টোল’ আদায় করা হচ্ছে। এন মল্লিক পরিবহনের সঙ্গে চুক্তিতে বান্দুরা ইউনিয়ন যুবলীগের নেতাকর্মীরা সেতু ও স্টেশন এলাকায় টাকা আদায় করছে বলে ভুক্তভোগী চালক ও যাত্রীদের অভিযোগ। তবে চাঁদাবাজি বন্ধে প্রশাসন থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ তাদের।

প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত ১ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১৪২৫ বঙ্গাব্দে উপজেলার বান্দুরা ইউনিয়নের পুরাতন বান্দুরা বাজারের পূর্বপাশের পুরাতন লঞ্চঘাট সংলগ্ন ২১ শতাংশ খাসজমি ইজারার জন্য দরপত্র আহ্বান করেন নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কার্যালয় (ইউএনও)। এতে ২৫ লাখ টাকায় এক বছরের জন্য ইজারা নেয় এন মল্লিক পরিবহনের কর্ণধার নার্গিস মল্লিক। বর্তমানে জমিটি এন মল্লিক পরিবহনের বাসস্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। সূত্র আরো জানায়, ১৪২২ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত নিয়মিত ইজারা দেওয়া হতো। তবে সেতুর ওপর থেকে টোল আদায় ও ইজাদারদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে গত দুই বছর ইজারা বন্ধ রাখে উপজেলা প্রশাসন। চলতি বছরে পুনরায় ইজারা দেওয়া হয়।

নিয়মানুযায়ী ইজারাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান কেবল নির্দিষ্ট জায়গায়ই টোল তুলতে পারবে। কিন্তু এন মল্লিক কর্তৃপক্ষ বাসস্ট্যান্ডের পাশের রাস্তায় মোটরযান ও ভ্যান থেকেও টোল আদায় করছে। বান্দুরা সেতু ও সড়ক ব্যবহার করে উপজেলার বেড়িবাঁধ, বারুয়াখালী, শিকারীপাড়া, জামসা, হাটিপাড়া এলাকার ৪০০-৫০০ ইজিবাইক প্রতিদিন নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর ও দোহার উপজেলায় যাতায়াত করে। বান্দুরা এলাকা দিয়ে যেতে প্রতিটি ইজিবাইক থেকে দিনে ২০ টাকা করে আদায় করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকা থেকেও আসা সিএনজি চালিত থ্রি-হুইলার থেকে ৩০ টাকা, ট্যাক্সি ও ট্রাক থেকে ৫০ টাকা আদায় করা হয়। এ হিসেবে দৈনিক ১২ থেকে ১৩ হাজার ও মাসে প্রায় চার লাখ টাকা আদায় করেন তারা।

বিশ্বস্ত সূত্র ও নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক যুবলীগ নেতা জানান, এন মল্লিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তিতে টাকা তোলার দায়িত্ব নিয়েছে যুবলীগের কিছু নেতাকর্মীরা। কিছুদিন পূর্বেও প্রতিদিন আদায়কৃত টাকা থেকে এন মল্লিক কর্তৃপক্ষকে দৈনিক আট হাজার টাকা দিতে হতো। এখন পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বাকি টাকা কর্মচারী ও নেতাদের। এভাবে সেতুর ওপর থেকে দৈনিক ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আদায় করা হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, নার্গিস মল্লিকের পক্ষে সেতুর ওপর থেকে টাকা আদায় করছেন হাসনাবাদ এলাকার ইকবাল ও চৈত্যন্তসহ আরো দু-তিনজন। শুধু সেতুর ওপর নয়, নতুন বান্দুরা বাজারসহ পুরো এলাকাতেই রাস্তার ওপর গাড়ি থামিয়ে আদায় করা হচ্ছে এই টাকা। এতে সেতু ও বাজার এলাকায় দীর্ঘ যানজট লেগে থাকে। তবে পরিবহনগুলো বাধ্য করায় হয় টাকা দিতে। কেউ টাকা দিতে দেরি বা অস্বীকার করলে লাঞ্ছিত পর্যন্ত করা হয়। প্রকাশ্যে এমন চাঁদা তোলা হলেও প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাউ কেউ দেখা যায় না। ভুক্তভোগী ইজিবাইক চালকরা জানান, এন মল্লিকের পক্ষে ইকবাল, অচিন্ত, চৈত্যন্ত ও মামুনসহ ১২-১৪ জন ব্যক্তি চাঁদা তোলে। বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, চাঁদা আদায়ের অভিযোগে এর আগে ইকবালকে একাধিকবার আটক করেছিল পুলিশ। প্রতিবারই এন মল্লিক কর্তৃপক্ষ বন্ড সই দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনে। তবে ‘টাকা আদায়ের বিষয়টি আমার জানা নেই’ দাবি করে থানার ওসি মোস্তফা কামাল বলেন, ‘কেউ আমাদের লিখিত দিলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ প্রতিদিনের সংবাদ সূত্রে এই তথ্য জানার পর বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন। এ সময় তিনি ইকবালকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে ইউএনওর সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করেন।

‘বিগত সরকারের সময় থেকে টোল আদায় করা হয়’ দাবি করে এন মল্লিক কর্তৃপক্ষের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আগে যেভাবে টোল আদায় করা হতো, আমরাও সেভাবে আদায় করছি। আগে ব্রিজের ওপর থেকে আদায় করত, তাই আমরাও আদায় করি। এতে আমাদের কী দোষ?’

একাধিক চালক প্রতিদিনের সংবাদকে অভিযোগ করেন, ‘চালকদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত অর্থ টোলের নামে জোরপূর্বক আদায় করা হচ্ছে। ইজারাদারের লোকজন টোলের নামে চাঁদাবাজি করছে।’ ইজিবাইক চালক আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। দিন আনি, দিন খাই। আমাগো কাছ থেইক্যা জোর কইর‌্যা প্রতিদিন ২০ টাকা করে নেয়। টাকা দিবার না চাইলে মা-বাপ তুইল্যা বকা দেয়। মাঝে মাঝে গায়েও হাত তোলে। কিন্তু কিছু কইবার পারি না।’

দোহারের বাসিন্দা অটোরিকশাচালক কাসেম মিয়া বলেন, ‘আমরা সাধারণত বান্দুরা ভাড়া নিয়ে আসি না। রিজার্ভ পেলে দু-একটা আনি। কিন্তু বান্দুরা সেতু পার হতে গেলেই ২০ টাকা দিতে হয়। আমরা কিন্তু ব্রিজে স্ট্যান্ডও করি না। সরাসরি চলে যাই। তাহলে আমাদের টাকা দিতে হবে কেন?’

সিএনজিচালক হাবিব বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি সিএনজি থেকে জোরপূর্বক প্রতিদিন ৩০ টাকা তোলে। দিতে না চাইলে হুমকি দেয়। বাধ্য হয়ে ওদের টাকা দিয়ে দেই। কী আর করার?’

টাকা আদায়ের বিষয়টি স্বীকার করে বান্দুরা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মো. মাসুদ জানান, দৈনিক সাড়ে পাঁচ হাজার চুক্তিতে এন মল্লিকের কাছ থেকে সেতুর ‘টোল’ আদায়ের লিজ নিয়েছেন। যদি পরিবহন কর্তৃপক্ষ লিজ বাতিল করে তাহলে তিনি আর টাকা তুলবেন না। ৭-৮ জন মিলে কাজ করে তিন শেষে ৩০০-৪০০ টাকা থাকে দাবি করেন তিনি।

এ ব্যাপারে কথা বলতে এন মল্লিক পরিবহনের কর্ণধার নার্গিস মল্লিকের মুঠোফোনে প্রতিনিধি ও প্রতিদিনের সংবাদ অফিস থেকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে একাধিক মেসেজ দিলেও উত্তর পাওয়া যায়নি।

নুবাবগঞ্জ ইউএনও তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘আমি এখন একটি মিটিংয়ে এ ব্যস্ত আছি। একটু পরে কথা বলব।’ পরবর্তীতে প্রতিদিনের সংবাদ অফিস থেকে ফোন করে এবং মেসেজ পাঠিয়েও উত্তর পাওয়া যায়নি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close