গাজী মো. রাসেল
জার্মানির মধুর প্রতিশোধ
প্রতিটি বিশ্বকাপই কোনো কোনো কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে। ব্যতিক্রম নয় ১৯৯০ ইতালি বিশ্বকাপও। বিশ্বকাপের চতুর্দশ আসরটি অমর হয়ে আছে কয়েকটি কারণে। পরপর দুইটি বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট থাকল একই। মেক্সিকোর পর ইতালি বিশ্বকাপেও ফের দেখা হয়ে গেল আর্জেন্টিনা ও পশ্চিম জার্মানি। যেখানে রোমের ফাইনালে আর্জেন্টাইনদের ১-০ গোলে হারিয়ে মধুর একটা প্রতিশোধই নিল বেকেনবাওয়ারের জার্মানি। পশ্চিম জার্মানির সেটাই হয়ে থাকল শেষ বিশ্বকাপ। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত শুধু জার্মানিকেই দেখেছে ফুটবল বিশ্ব।
শিরোপা অর্জনের চেয়ে ধরে রাখাটাই যে বেশি কঠিন সেটা গ্রুপ পর্বের শুরুতেই টের পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা প্রথম রাউন্ডের ম্যাচে হেরে বসল ক্যামেরুনের কাছে! ইতালির বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় অঘটন বলতে আর্জেন্টাইনদের হেরে যাওয়াটাই। ওই হারটা অবশ্য তাতিয়ে দিয়েছিল ডিয়েগো ম্যারাডেনার দলকে। ফাইনালে পৌঁছে যায় আর্জেন্টিনা।
বিশ্বকাপে তখন অন্য মহাদেশের দলগুলো অংশ নিলেও বিশ্বকাপের আসর সীমাবদ্ধ ছিল ইউরোপ ও আমেরিকার গন্ডিতেই। তাই আমেরিকা ঘুরে পুনরায় ইউরোপে ফিরে যায় ফুটবল মহাযজ্ঞ। এবারও একাধিক দেশ বিশ্বকাপ আয়োজনের ইচ্ছা প্রকাশ করে। ইংল্যান্ড, গ্রিস, ইতালি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন আয়োজক হওয়ার লাইনে দাঁড়ায়। ভোটের লড়াইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ছয় ভোটে পরাজিত করে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায় ইতালি।
ইতালি বিশ্বকাপের বাছাই পর্বও অঘটন দেখেছে বেশ কয়েকটি। মূল পর্বের টিকিট পায়নি মেক্সিকো, হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, পর্তুগালের, পোল্যান্ডের মতো বড় বড় দলগুলো। অঘটনে মধ্যে চমক হিসেবে নতুন দল হিসেবে অভিষেক হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত, কোস্টারিকা এবং আয়ারল্যান্ডের। শেষ অবধি অংশ নেওয়া দলগুলো হচ্ছে ইতলি (স্বাগতিক), আর্জেন্টিনা (চ্যাম্পিয়ন), দক্ষিণ কোরিয়া, আরব আমিরাত, মিসর, ক্যামেরুন, কোস্টারিকা, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, উরুগুয়ে, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চেকোস্লোভাকিয়া, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, রোমানিয়া, স্কটল্যান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, স্পেন, সুইডেন, জার্মানি ও যুগোস্লাভিয়া।
১৯৯০ ইতালি বিশ্বকাপ ফুটবলে যোগ করে নতুন এক মাত্রা। রক্ষণাত্মক কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল প্রায় সব দলই। এই রক্ষণনীতির সঙ্গে বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দেয় আর্জেন্টিনা ও নেদারল্যান্ডস। যেটার শেষ পরিণাম ২৪ দলের বিশ্বকাপে সবচেয়ে কম গোল হয়েছে ইতালি বিশ্বকাপে।
বিশ্বকাপের চর্তুদশ আসরে আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুনের উত্থান হয়েছিল। অভিষেক আসরে সবাইকে চমেক দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গিয়েছিল রূপকথার ক্যামেরুন। ইংল্যান্ডের হাত ধরে বিদায় নেয় আফ্রিকান দেশটি। তবে নবাগত দলটিকে হারানোর আগে ইংলিশদের কী অগ্নিপরীক্ষাটাই না দিতে হয়েছিল! ম্যাচের একটা পর্যায়ে তো ২-১ গোলে এগিয়েও ছিল ক্যামেরুন। তবে নির্ধারিত সময় শেষে ম্যাচটা ২-২ গোলে ড্র ছিল। শেষ অবধি ১০৫ মিনিটের পেনাল্টি গোল ম্যাচের ভাগ্য ইংলিশদের পক্ষে গড়ে দেয়। থ্রিলার ম্যাচটায় ক্যামেরুন হারল ৩-২ গোলে।
আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা এই আসরেও ছিল ফেভারিট। ম্যারাডোনা, ক্যানিগিয়া, পম্পেদো, বুড়িচেগার মতো তরকাদের নিয়ে বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু করে আবিসেলেস্তেরা। কিন্তু দলীয় শিবিরে চোটাঘাত অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। পম্পেদো পা ভেঙে ছিটকে যান বিশ্বকাপ থেকে। বুড়িচেগাকেও একই দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়। কিন্তু ম্যারাডোনার আগুনঝরা পারফরম্যান্সের ওপর দাঁড়িয়ে ফাইনালে উঠে যায় আর্জেন্টিনা।
সেমিফাইনালে স্বাগতিক ইতালির মুখোমুখি আর্জেন্টিনা। শুরুতে একটা গোলও হজম করতে হয়েছিল ল্যাটিন দেশটিকে। আর্জেন্টাইনদের সমতায় ফেরান ক্লদিও ক্যানিগিয়া। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির সেই গোলটা এখনো ভেসে ওঠার কথা অনেক ফুটবলপ্রেমীদের চোখে। ১-১ ব্যবধানে লড়াইটা অমীমাংসিত থাকায় ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানেই ৪-৩ গোলে বাজিমাত করে আর্জেন্টিনা।
মেক্সিকো বিশ্বকাপটা যেখান থেকে শেষ হয়েছিল ইতালির আসরটারও সমাপ্তি হলো আর্জেন্টিনা-জার্মানি মহাযুদ্ধ দিয়ে। নব্বইর সেই ফাইনালকে বলা হয়ে থাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে ফাইনাল। টান টান উত্তেজনার ম্যাচটার প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলখরায়। স্নায়ুঠাসা ম্যাচটার নির্ধারণ হয়ে যায় ৮৫ মিনিটে রেফারির একটা বিতর্কিত সিদ্ধান্তে। আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার পেদ্রোকে সরাসরি লালকার্ড দেন রেফারি কৌডিসেল মিন্ডেস। এর সঙ্গে ‘উপহার’ হিসেবে পেনাল্টি পায় জার্মানি। সুবর্ণ সুযোগটা কাজে লাগাতে ভুল করেন আন্দ্রেস ব্রেহমে, স্পট কিক থেকে ম্যাচের একমাত্র ও জয়সূচক গোলটি করেন তিনি।
"