প্রতীক ইজাজ

  ২২ নভেম্বর, ২০১৭

এনজিও খাত

শৃঙ্খলা আনতে নজরদারি বাড়াচ্ছে সরকার

দেশে কর্মরত বেসরকারি সংস্থাগুলোকে (এনজিও) শৃঙ্খলায় আনা যাচ্ছে না। নানামুখী চাপ, যথাযথ আইন ও লোকবলের অভাবে নজরদারির বাইরে থেকে যাচ্ছে এসব সংস্থার কার্যক্রম। কাজে সমন্বয় আনতে এখনো সব এনজিওকে একই ছাতার নিচে আনা যায়নি। নিবন্ধন নিয়ে যেমন কাজ করছে না অনেক এনজিও, আবার নিবন্ধিত এনজিওগুলোও ঠিক কী কাজ করছে-সে ব্যাপারেও দেখভাল নেই নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর।

গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এনজিওদের মাধ্যমে ৬৭ কোটি ডলার অনুদান এসেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ পাঁচ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। এর ৯০ শতাংশ অর্থ কোথায় ও কীভাবে ব্যয় হচ্ছে, তা জানে না সরকার। আলাদা সংস্থার কাছ থেকে নিবন্ধন নিয়ে এনজিওগুলো জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে না জানিয়েই মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করছে। এক জেলার নামে নিবন্ধন নিয়ে কাজ করছে অন্য জেলায়। স্বেচ্ছাশ্রমের নামে চালাচ্ছে ব্যবসা। নিয়ম মেনে নিবন্ধন নবায়নও করছে না। আইনে না থাকলেও হাজার হাজার এনজিও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন।

একইভাবে এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ ও অনিয়মের অভিযোগও পুরনো। সরকারের সমবায় অধিদফতরের হালনাগাদ ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, এ মুহূর্তে দেশের তিন ধরনের ২৬৬টি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এসব এনজিও সমবায় অধিদফতরে নিবন্ধিত। নামে-বেনামে গজিয়ে ওঠা এসব সংস্থা বিভিন্ন সময় গ্রাহকদের ফাঁদে ফেলে বিশেষ কৌশলে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে।

এমনকি বিভিন্ন সময় নানা এনজিওর বিরুদ্ধে নেপথ্য রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে। সরকারবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কর্মকান্ডের পাশাপাশি জঙ্গি অর্থায়নেরও অভিযোগ রয়েছে এসব এনজিওর বিরুদ্ধে। সর্বশেষ এমন অভিযোগে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণকাজ চালাতে তিনটি বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) নিষেধ করেছে সরকার। সংস্থাগুলো হলো মুসলিম এইড, ইসলামিক রিলিফ ও আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন।

এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে এনজিওগুলোর সব ধরনের কার্যক্রম নজরদারিতে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি এ নির্দেশ দেন। বিশেষ করে এনজিওগুলোর ফান্ড কোথায় থেকে আসছে, তাদের কার্যক্রম কী ও সে ফান্ড কোথায় ব্যয় হয়; তা কড়া নজরদারিতে রাখতে বলেছেন তিনি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘যেসব এনজিওর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর ব্যাপারে আমরা খোঁজখবর রাখছি। এমন কিছু এনজিওর নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। অভিযুক্ত সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এনজিওগুলো যেন উন্নয়ন কর্মকান্ডের নামে রাজনৈতিকভাবেও ব্যবহার না হতে পারে, আমরা সে দিকটাও দেখছি।’

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময় বেশকিছু এনজিওর বিরুদ্ধে সরকার হঠানো তৎপরতার অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদে একটি প্রতিষ্ঠিত এনজিওর বিরুদ্ধে তৎকালীন বিরোধী দলের সঙ্গে মিশে সরকার হঠানোর কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার গুরুতর অভিযোগ ওঠে। তখন থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার এসব এনজিওর ওপর কঠোর নজরদারি বাড়িয়ে দেয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এনজিওদের অর্থের উৎস তালাশে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে নির্দেশ দেন। সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এনজিওগুলো নিজেদের গুটিয়ে নেয়। সতর্ক হয়ে পড়ে অন্য এনজিওগুলো। এবারও নির্বাচন সামনে রেখে সরকার এনজিওগুলোকে কড়া নজরদারিতে রাখতে চায়।

এর আগে ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পার্লামেন্ট ওয়াচ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বর্তমান জাতীয় সংসদকে পুতুল নাচের নাট্যশালা হিসেবে অবিহিত করে টিআইবি। অবিলম্বে নির্বাচনের দাবিও জানানো হয় প্রতিবেদনটিতে। এর আগে ‘অধিকার’ নামে একটি সংস্থা ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের সমাবেশে নিহতের তথ্য ও তালিকা প্রকাশ করলে এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছাড়ায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বেশ কিছু এনজিও সরকারবিরোধী গোপন তৎপরতাও প্রকাশ হয়েছে। বিষয়গুলো নজরদারিতে রাখতে সংস্থাগুলোর আয়ের উৎস, কী কাজে বিদেশ থেকে অর্থ আসছে, কোন দেশ থেকে আসছে, কী কাজে ব্যয় করা হচ্ছে, সঠিক কাজে ব্যয় করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা উচিত বলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন।

প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনজিও ব্যুরোর মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) শাহাদাৎ হোসাইন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এখনো প্রধানমন্ত্রীর কোনো নির্দেশনা ব্যুরোতে আসেনি। আশা করছি শিগগিরই আসবে। এলে যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হবে, সেভাবে কাজ করব। তবে আমরা এনজিওগুলোকে নিয়মিত তদারকি করছি। কোনো এনজিওকে নিবন্ধন দেওয়ার আগে আমরা ওই এনজিওর বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগকে জানাই। তাদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতেই নিবন্ধন দেওয়া হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট এনজিও তাদের প্রকল্প পেশ করে। স্বরাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি স্থানীয় জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষকে ওই এনজিও ফান্ডের ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলি। তারা প্রত্যয়নপত্র দিলেই প্রকল্প পাস হয়। এ ছাড়া মাসিক মনিটরিং ও বছরে অডিট করি। চুক্তি অনুযায়ী এনজিওগুলো পরিদর্শন করি। এনজিওগুলোর ফান্ড কই থেকে আসছে, কী কাজে ব্যবহার হচ্ছে, তা কয়েক স্তরে মনিটরিং হয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর নতুন কোনো নির্দেশ এলে আমরা সেভাবেই ব্যবস্থা নেব।

এনজিওগুলোর সব ধরনের কার্যক্রম নজরদারিতে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘যেসব এনজিও সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদে মদদ দেয়, বিদেশ থেকে গরিবদের নামে টাকা এনে নিজেরা আত্মসাৎ করে, সেসব এনজিওর কর্মকান্ডের ওপর কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। এনজিওগুলো কোথা থেকে ফান্ড নিয়ে আসে, তাদের কার্যক্রম কী, কোথায় সেই ফান্ড ব্যয় হয়-এসব বিষয়ে নজরদারি প্রয়োজন। কারণ বিভিন্ন সময় এনজিও কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বিভিন্নভাবে উসকানি দিয়ে আইনশৃঙ্খলারও অবনতি ঘটিয়েছে। এনজিওগুলো দেশে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে কি না, এ তথ্য সরকারের কাছে থাকতে পারে।

সমাজসেবা অধিদফতর সূত্রমতে, স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এনজিও ব্যুরো, জয়েন্ট স্টক এক্সচেঞ্জ, সমাজকল্যাণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যুব, নারী ও শিশু, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, পরিবেশ ও বনসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে নিবন্ধন নিয়েছে দেড় লাখের বেশি এনজিও। এদের মধ্যে ৯০ শতাংশ সংস্থা কী কাজ করছে তা তদারকি হচ্ছে না। ফলে আর্থসামাজিক উন্নয়নের বদলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে টাকা চলে যাচ্ছে জঙ্গি সংগঠনগুলোর কাছে। বিদেশি অনুদানের অর্থ ব্যবহার করা হচ্ছে ধর্মান্তরিত করার কাজে। বড় এনজিওগুলো ব্যাংক, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাচ্ছে। নিবন্ধন নেওয়ার সময় ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে না বলে এনজিওগুলো লিখিত অঙ্গীকারনামা জমা দেয়। কিন্তু একই সংস্থা জয়েন্ট স্টক এক্সচেঞ্জ বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয় থেকে নিবন্ধন নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ধরনের স্ববিরোধী কাজ কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না।

দেশে এনজিওর সঠিক সংখ্যা কত, তার কোনো হিসাব নেই। কারো কারো মতে, এই সংখ্যা ৫০ হাজার। কারো মতে, এক থেকে দেড় লাখ। তবে এনজিও ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রায় আড়াই হাজার এনজিও রয়েছে। এর মধ্যে ২৫০টি বিদেশি এবং দুই হাজার ২৪৪টি দেশি এনজিও। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যথাসময়ে নিবন্ধন নবায়ন না করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে এনজিও ব্যুরোর ৪৬৪টি বেসরকারি সংস্থার নিবন্ধন বাতিল করা হয়। অবশ্য শতাধিক এনজিও নতুন করে আবার নিবন্ধনও পেয়েছে এ সময়ে। এ ছাড়া গত সাত বছরে আন্তর্জাতিক সহায়তা পেত এমন ৫০০ এনজিওর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।

এনজিও প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, যারা অস্বচ্ছ কাজ করেন তাদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের অনুসন্ধান চালানো বা দেখভাল করার প্রয়োজন রয়েছে। যদি কাজকর্মে অস্বচ্ছতা দেখতে পান, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে এ ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। দেখা যায়, অনেক সময় এনজিওগুলোর যেভাবে কাজ করার কথা সেভাবে করে না। ফলে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হন। ক্ষতিগ্রস্ত হন গ্রাহকরা। সময়মতো সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিলে এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানো সম্ভব। কিন্তু যারা ভালো কাজ করছে, সেসব সংস্থা যাতে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হন; সে বিষয়েও খেয়াল রাখা প্রয়োজন। সরকারের এ ধরনের উদ্যোগের কারণে যাতে তাদের কর্মকান্ডে ব্যাহত না হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist