নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৪ জুন, ২০১৭

ভোগান্তি সত্ত্বেও আনন্দের যাত্রা

রোদ-বৃষ্টি কিংবা খানাখন্দে বেহাল সড়কের চিরায়ত ভোগান্তি ও দীর্ঘ যানজট উপেক্ষা করেই ছুটছে মানুষ। বাস-ট্রেন-লঞ্চ টার্মিনালে যেন চলছে ঈদ আনন্দের মহাযাত্রা। নাড়ির টানে গ্রামের বাড়ি যেতে ঢাকা ছাড়ছে লাখো মানুষ। ঈদের আগে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস শেষ হওয়ার পর থেকে ঘরমুখো মানুষের ঢল নেমেছে রাজধানীর বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল ও রেল স্টেশনে। বৃহস্পতিবার পেরিয়ে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে রাজধানীর তিনটি আন্তঃনগর বাস টার্মিনাল ও কমলাপুর রেল স্টেশনে মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। এবার ঈদের সরকারি ছুটি ২৫ থেকে ২৭ জুন। সামনে ছুটির দিন শুক্রবার ও শনিবার থাকায় কার্যত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই শুরু হয় ঈদযাত্রা।

গতকাল শুক্রবার ভোর থেকেই রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট লঞ্চঘাট ও গাবতলী-সায়েদাবাদসহ প্রতিটি বাস টার্মিনালে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। বিশেষ করে দুপুরের পর থেকে টার্মিনালগুলো পরিণত হয় মানুষের বড় জটলায়। এ ছাড়াও নগরীর কলাবাগান, শ্যামলী, ফকিরাপুল ও মালিবাগসহ বিভিন্নস্থানে পরিবহনের কাউন্টারেও ছিল উপচেপড়া ভিড়। শেকড়ের টানে গ্রামে ছোটা নগরবাসীর কারো সঙ্গে বিশাল পরিবার-পরিজন, কেউ বা একাকী। ভাঙাচোরা সড়কে পদে পদে ভোগান্তি, যানজট, পরিবহন সংকট ও বাড়তি ভাড়াসহ পথের নানা ভোগান্তি তুচ্ছ করেই পথে নেমেছেন তারা। ঈদের আর মাত্র দুই কি তিন দিন বাকি। তাই আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করতে চাইছেন না কেউই। অনেকে অফিসে হাজিরা দিয়েই রওনা হন নির্দিষ্ট গন্তব্যে।

গতকাল দূরপাল্লার বাসগুলো মোটামুটি নির্বিঘেœই ছেড়ে যায়। তবে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দ থাকায় গাড়ি চলেছে ধীরগতিতে। কিছুটা একই চিত্র ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেও। এতে গন্তব্যে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় যাত্রীদের। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা সেতুতে যানজট দেখা গেলেও গতকাল শুক্রবার ভোরে কমে এসেছিল। কিন্তু সকালে সেতুতে একটি ট্রাক বিকল হওয়ায় ফের লেগেছে জট। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানজটও কমে আসে।

এদিকে, মাওয়া মহাসড়কেও তেমন যানজট নেই বলে সায়েদাবাদ থেকে বরিশাল-খুলনা অঞ্চলগামী বাসগুলোর কাউন্টারকর্মীরা জানিয়েছেন। উত্তরের পথে টাঙ্গাইলে মহাসড়কে গাড়িগুলোর গতি ধীর হওয়া ছাড়া আর তেমন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। একইচিত্র মহাখালী থেকে ময়মনসিংহগামী বাসের ক্ষেত্রেও। আর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বিভিন্ন রুটের যানবাহনের ভিড় থাকলেও সকালে নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় তেমন যানজট দেখা যায়নি। মহাসড়কে ট্রাক, কভার্ডভ্যান বন্ধ রাখার সরকারি সিদ্ধান্ত থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। সকালে ঢাকা বাইপাস সড়কে প্রচুর ট্রাক-কভার্ড ভ্যান চলতে দেখা গেছে। সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে ভিড় বাড়ে দুপুরের পর। দক্ষিণাঞ্চলগামী লঞ্চগুলো দুপুরের পর থেকে ঘাট ছাড়তে শুরু করে।

টার্মিনালগুলো থেকে সকালে ঠিক সময়ে বাস ছেড়ে গেলেও রাস্তার যানজটের আশঙ্কা নিয়েই রওনা হয়েছেন যাত্রীরা। গাবতলীর কয়েকজন কাউন্টার ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, সকাল ৯টা পর্যন্ত তারা নির্ধারিত সময়ে বাসগুলো ছাড়তে পেরেছেন। তবে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলাচলে ধীরগতির কারণে পরে সমস্যা দেখা দিতে পারে। টিআর ট্রাভেলেসের এ জি এম মনসুর হেলাল বলেন, সকাল ৯টা পর্যন্ত ঠিক সময়ে ছাড়তে পেরেছি। কিন্তু যানজটের কারণে গতকাল বিকালের দিকে যাওয়া গাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে। এরপর থেকে লেট হচ্ছে। রাস্তার যে যানজট সেটাকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন শ্যামলী পরিবহনের কল্যাণপুর কাউন্টারের ব্যবস্থাপক ইমাম গাজ্জালী। উত্তরবঙ্গমুখী বাসের এই কাউন্টার ব্যবস্থাপক বলেন, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানজট যেটা আছে সেটা স্বাভাবিকই বলতে হবে। কালকের যাওয়া গাড়িগুলো অনেকটা ঠিক সময়ে ফিরে আসছে। রাস্তায় যে পরিস্থিতি আছে সেটা অন্যান্য সময়ের মতোই। রাস্তা একেবারে ক্লিয়ার না থাকলেও গাড়ি ভালোভাবে ফিরে আসছে। এটা বজায় থাকলে ঠিক সময়ে গাড়ি ছেড়ে যেতে পারবে। শ্যামলীর এই কাউন্টার থেকে নওগাঁ, গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, পাবনা রুটের গাড়ি ছাড়ে। গাবতলী ও কল্যাণপুরের কাউন্টারগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, অগ্রিম টিকেটের যাত্রীরা সকাল থেকে ঠিক সময়ে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা করতে পেরেছেন। তবে অন্য কাউন্টারগুলোর সামনে ঘরমুখো মানুষের ভিড় দেখা গেছে অনেক।

ট্রেনের ছাদে ঘরমুখো মানুষ : গত মঙ্গলবার সময়সূচি এলোমেলো হয়ে গেলেও পরদিনই সামলে উঠেছিল রেলওয়ে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে ট্রেনগুলো মোটামুটি সময় ধরে ছাড়ছে। গতকাল সেটা অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। সময় ধরেই ছাড়ছে ট্রেন। কমেছে ভোগান্তিও। যাত্রী সংখ্যা বেশি হওয়ায় ভেতরে গাদাগাদির পাশাপাশি বেশিরভাগ ট্রেনের ছাদে করে ঝুঁকি নিয়ে বহু মানুষ ভ্রমণ করছেন। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার সময়ও কেউ কেউ দৌড়ে উঠছেন।

কমলাপুরের স্টেশন ম্যানেজার সিতাংশু চক্রবর্তী বলেন, সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ১৪টি ট্রেন ছেড়ে গেছে। অধিকাংশ ট্রেনে যাত্রীর প্রচ- চাপ লক্ষ করা গেছে। এই সময় পর্যন্ত প্রায় সবগুলো ট্রেন নির্ধারিত সময়ে স্টেশন ছেড়ে যায় বলে তার দাবি; যদিও রংপুর এক্সপ্রেসকে নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা পর ছাড়তে দেখা যায়। একতা এক্সপ্রেসের যাত্রী প্রতীক ইজাজ বলেন, ভোর বেলায় স্টেশনে এসেছি। ট্রেনগুলোতে ভিড় দেখা যাচ্ছে। যেভাবেই হোক বাড়ি যেতে হবে।

এদিকে, গতকাল কমলাপুর রেল স্টেশন পরিদর্শন শেষে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেছেন, সব ট্রেন সঠিক সময়ে যাত্রা করেছে। বিভিন্ন রুটের ট্রেনের যাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, সঠিক সময়ে ট্রেনে যেতে পারছেন। এ জন্য তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ঝুঁকি নিয়ে রেলের ছাদে যাত্রী পরিবহনের বিষয়ে রেলমন্ত্রী বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলেছি, যাত্রীদের গায়ে হাত বুলিয়ে বোঝাতে, যেন তারা ছাদে না ওঠেন। এর আগে দুপুর পৌনে ৩টায় স্টেশনে অপেক্ষমাণ সুবর্ণ এক্সপ্রেসের একটি বগিতে ওঠে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন রেলমন্ত্রী। চট্টগ্রামের উদ্দেশে সুবর্ণ এক্সপ্রেস বিকেল ৩টায় ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও মন্ত্রীর বগি পরিদর্শনের কারণে তা নয় মিনিট দেরিতে ছাড়ে।

কমলাপুর স্টেশনের নিরাপত্তাকর্মীরা জানিয়েছেন, খুলনার উদ্দেশে সকাল ৬টা ২০ মিনিটে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ছেড়ে গেছে। এরপর সিলেটের উদ্দেশে সকাল ৬টা ৩৫ মিনিটে পারাবত এক্সপ্রেস, চট্টগ্রামের উদ্দেশে সকাল ৭টায় সোনার বাংলা এক্সপ্রেস, কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে এগারসিন্দুর ৭টা ১৫ মিনিটে, দেওয়ানগঞ্জের উদ্দেশে তিস্তা ৭টা ৩০ মিনিটে, চট্টগ্রামের উদ্দেশে মহানগর প্রভাতি ৭টা ৪৫ মিনিটে ছেড়ে গেছে। চিলাহাটির উদ্দেশে নীলসাগর এক্সপ্রেস নির্ধারিত সকাল ৮টার পরিবর্তে ৮টা ২০ মিনিটে ছেড়ে যায়।

ভিড় বাড়ছে সদরঘাটেও : গতকাল শুক্রবার সকালে সদরঘাটে লঞ্চ যাত্রীর চাপ দেখা গেলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা কমে যায়। বিকেলের পর আবার চাপ বেড়েছে। সাধারণত সকালে চাঁদপুরসহ নিকট গন্তব্যের লঞ্চগুলো ঢাকা ছেড়ে যায়। মাঝে বিরতির পর বিকেলে শুরু হয় বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালীসহ দূর গন্তব্যের লঞ্চগুলোর যাত্রা। ছাড়ার সময় প্রতিটি লঞ্চই অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই করে যাত্রা করছে। বিআইডব্লিউটিএ-এর পরিবহন পরিদর্শক (টিআই) হুমায়ূন কবির বলেন, ভোর থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত যাত্রীর চাপ ছিল। সকাল ১০টা পর্যন্ত ২৫টি লঞ্চ ছেড়ে যায় সদরঘাট থেকে। বৃহস্পতিবার সারা দিনে লঞ্চ ছেড়েছিল ৮২টি। বরিশালগামী এমভি টিপু লঞ্চের কর্মী তাজুল বলেন, দুপুরের দিকে যাত্রী এমনিতেই কম থাকে। বিকেলে যাত্রীর চাপ বেড়ে যায়। তখন আপনারা (সাংবাদিক) পন্টুনে দাঁড়াতেই পারবেন না।

এদিকে, যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে ঘাটে পুলিশ পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানান, কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মওদুদ হাওলাদার। তিনি জানান, পুলিশের ২৩৬ সদস্য দায়িত্ব পালন করছে সদরঘাটে। এ ছাড়া নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড, র‌্যাব সদস্যের সঙ্গে বিএনসিসির স্বেচ্ছাসেবকরাও রয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ-এর যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদীন জানান, ঘাটের পরিস্থিতি সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে দেখছেন তারা। কোথাও অপ্রীতিকর কিছু দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে তার সমাধান করা হচ্ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist