বিশেষ প্রতিনিধি

  ১৭ জানুয়ারি, ২০১৮

ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচন এখনো অনিশ্চিত

তফসিল ঘোষণা শেষে এখন নির্বাচন কমিশন ব্যস্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। ভোটযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বড় দুই রাজনৈতিক দলÑ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো। ইতোমধ্যেই বিএনপি মেয়র পদে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। গতকাল রাতে প্রার্থী ঘোষণা করার কথা ছিল আওয়ামী লীগের। কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীও চূড়ান্ত সব দলের। বাম ও অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও মেয়র পদে প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে। রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। কাউন্সিলর প্রার্থীরা আগেভাগেই নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে গেছেন। আজ-কালের মধ্যে মাঠে নামবেন মেয়র প্রার্থীরাও। ফলে নির্বাচনী উৎসবে মেতে উঠবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকা এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে যুক্ত হওয়া নতুন ওয়ার্ডগুলো।

এমন প্রস্তুতি সত্ত্বেও এখনো নির্বাচন নিয়ে সংশয় কাটছে না মানুষের। দুই সিটি করপোরেশনে যুক্ত হওয়া নতুন ৩৬টি ওয়ার্ডে নির্বাচন নিয়ে আইনি জটিলতার কথা বলা হচ্ছে শুরু থেকেই। আশঙ্কা করা হচ্ছিল, নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডের বাসিন্দারা ভোটার হতে পারলেও প্রার্থী হতে পারবেন নাÑ নির্বাচন কমিশনের এমন সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ যে কেউ আদেশ বাতিল বা সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের আগ পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত চেয়ে আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন। নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে আসছে বিএনপি ও দলের মেয়র প্রার্থী। সম্ভাব্য জটিলতা নিরসনে নানা পরামর্শ দিয়ে আসছেন স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তবে আইনি জটিলতা নেই বলে, বলে আসছে নির্বাচন কমিশন। ক্ষমতাসীনরা শঙ্কার কথা আমলে নেয়নি। আর জটিলতা থাকলেও তা নিরসনের দায়িত্ব কমিশনের বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী।

এমন অবস্থার মধ্যেই আজ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনের তফসিল স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে দায়ের হওয়া পৃথক দুই রিটের আদেশের দিন ধার্য করেছেন আদালত। এই আদেশের ওপর নির্ভর করছে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ। রিট দুটিতে নতুন ওয়ার্ডগুলোতে প্রার্থী হওয়ার বিধান না রাখা এবং মেয়র পদ গঠনে সিটি করপোরেশন আইন মানা হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী, আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নতুন যুক্ত হওয়া ৩৬টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে নির্বাচন হওয়ার কথা। তফসিল অনুযায়ী, বর্তমান সিটি করপোরেশনের মেয়াদ যতদিন বাকি আছে, নির্বাচিত নতুন কাউন্সিলরদের মেয়াদ হবে ততদিন। চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ভোটাররা এই নির্বাচনে ভোট দিতে পারলেও প্রার্থী হতে পারবেন না।

নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, উপনির্বাচন নির্দিষ্ট মেয়াদেই করতে হবে। নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোতে কাউন্সিলর পদেও ভোট গ্রহণ করতে হবে। যদি এ দুটি পদের (মেয়র ও কাউন্সিলর) একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিতে ভোট গ্রহণ করা হয় অথবা নতুন ভোটারদের ভোট দেওয়া বা প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়া না হয়, সেক্ষেত্রে জটিলতার নিরসন হবে না। তা ছাড়া নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মেয়াদকাল কত হবে, সেটা একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্ধারণ করে দিতে পারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

তবে এই নির্বাচন বিশ্লেষক নির্বাচন স্থগিত চেয়ে আদালতে দায়ের হওয়া রিটের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, এটি আদালতের বিষয়। আদালত যা ভালো মনে করছেন আদেশ দেবেন। কোনো কারণে নির্বাচন স্থগিত হলে করপোরেশন কিভাবে চলবে- সেক্ষেত্রে তারমতো, সেটিও আদালত ঠিক করে দেবেন। কে চালাবেন বা কিভাবে চলবে, নির্বাচন কমিশন নাকি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত জানাবে, সেটিও আদালত ঠিক করে দেবেন।

তবে সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, কোনো কারণে নির্বাচন না হলে সিটি করপোরেশন কিভাবে চলবে, সেটি নির্ভর করবে সরকারের ওপর। যদি সরকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, তাহলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চালাবে। আর যদি প্যানেল মেয়র দিয়ে চালাতে চায়, সেটি হবে সংবিধান ও আইন পরিপন্থী।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, নির্বাচন নিয়ে কোনো আইনি জটিলতা নেই। জটিলতা থাকলে স্থানীয় সরকার থেকে কমিশনকে নির্বাচন করার জন্য অনুরোধ জানানো হতো না। কোনো জটিলতা নেই বলেই কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে।

নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, আইনি জটিলতায় শেষ পর্যন্ত নির্বাচন আটকে যায় কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। পাশাপাশি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কৌশলও এই নির্বাচনের জন্য বড় ফ্যাক্টর। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন থাকায় এই নির্বাচন ঘিরে সরকারি দলে কিছুটা অস্বস্তি আছে। রংপুরে দলীয় মেয়র প্রার্থীর ভোটের বড় ব্যবধানে পরাজয়ের পর এখন রাজধানী ঢাকা নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় নয় বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। মূলত এই দুই কারণেই নির্বাচন নিয়ে এমন শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তফসিল ঘোষণার পর বিএনপি নির্বাচন নিয়ে প্রথম এমন শঙ্কা প্রকাশ করে। গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, হঠাৎ আইনি মারপ্যাঁচ দেখিয়ে নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা হয় কি নাÑ তা নিয়ে জনমনে গভীর সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া আদৌ নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না এমন প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে। এমনকি দলের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়েও সংশয় প্রকাশ করা হয়। এর আগে গত মঙ্গলবার অনুরূপভাবে ‘শঙ্কা’ প্রকাশ করেন দলের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। তিনি বলেন, অবিশ্বাস-আস্থাহীনতার জায়গায় যা বিরাজ করছে তা হচ্ছে নির্বাচনটা আদৌ হবে কি না? আর কেন নির্বাচনটা হবে না তা সকলেরই জানা। নতুন ১৮টি করে ওয়ার্ড ঢাকা দুই সিটি করপোরশেনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। সীমানা জটিলতা নিয়ে আদালতে দুইটি রিট ফাইল হয়েছে। ওই রিটের কোনো সুরাহা এখনো হয়নি। নির্বাচন কমিশন যদি সুস্পষ্ট করে বলে দিত আইনি বাধা মোকাবিলা করে নির্বাচন হবে। তাহলে জোর দিয়ে বলা যায় নির্বাচনটা করা যাবে।

তবে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতিম-লীর সদস্য ও দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ফারুক খান বলেন, নির্বাচন নষ্ট করে বিএনপি-জামায়াত। তারা নির্বাচন বর্জন করলে নানা প্রশ্ন ওঠে। নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও রংপুরে বর্জন করেনি বলে প্রশ্নও ওঠেনি। আইনি জটিলতার বিষয়ে তিনি মন্তব্য করেন, ‘এটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। এটা দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।’ একইভাবে দলের সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম বলেন, নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন কমিশন যা করার করবে। আমার জনসংযোগ আমি চালিয়ে যাব।

বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনে ওয়ার্ড সম্প্রসারণ করা হলে সেগুলোতে নির্বাচনের সময়সীমার বিষয়ে স্পষ্ট বিধান নেই। সেখানে নতুন সিটি করপোরেশন গঠনের ক্ষেত্রে ১৮০ দিন, করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার ক্ষেত্রে আগের ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া করপোরেশন গঠন বাতিল ও করপোরেশন বিভক্তির ক্ষেত্রেও ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বিধান রয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের সঙ্গে নতুন ওয়ার্ড অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে সেগুলোতে কত দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে এবং সেসব ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধিদের মেয়াদ কত দিন হবে সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। মূলত এ কারণেই ঢাকা উত্তর সিটিতে নতুন যুক্ত হওয়া ১৮টি ওয়ার্ডে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইনগত জটিলতার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, একই আইনে মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীদের যোগ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রার্থী হিসেবে তিনি যোগ্য হবেন, যদি তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হন, তার বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হয়, মেয়রের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের যেকোনো ওয়ার্ডের ভোটার তালিকায় তার নাম লিপিবদ্ধ থাকে এবং সংরক্ষিত মহিলা আসনের কাউন্সিলরসহ অন্য কাউন্সিলরদের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ভোটার তালিকায় তার নাম লিপিবদ্ধ থাকে। সংবিধানে বলা আছে, প্রতি এলাকার জন্য একটিমাত্র ভোটার তালিকা থাকবে। কিন্তু এই নির্বাচনে দুটি ভোটার তালিকা ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে প্রার্থী মনোনয়ন হবে বিদ্যমান ভোটার তালিকায় আর ভোটাররা ভোটদান করবেন নতুন ভোটার তালিকায়। এখানে জটিলতা রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist