সাবিনা ইয়াসমীন

  ২৩ জানুয়ারি, ২০১৯

বুলবুলকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন ৪ গুণী সংগীতশিল্পী

গত বছরের শুরুতে একটি সিনেমার গান রেকর্ডিংয়ের সময় আমার সঙ্গে তার সর্বশেষ দেখা হয়েছিল, এরপর আর দেখা হয়নি। খুব কষ্ট লাগছে এই ভেবে যে, আমরা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি। এত কম বয়সে বুলবুল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তারপর বুলবুল এ দেশের একজন প্রথিতযশা সংগীত পরিচালক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু এমন একজন সংগীত পরিচালকের সঠিক মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি। এটাই আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। বুলবুলের সঙ্গে আমার প্রথম কাজ বিটিভির জন্য একটি অনুষ্ঠানে। ১৯৭৮ সালের কথা। সেই অনুষ্ঠানে মাঝি নাও ছাইড়া দেরে মাঝি পাল উড়াইয়া দে, এক দিন ঘুম ভেঙে দেখি তুমি নাই’সহ আরো দুটি গান গেয়েছিলাম বুলবুলেরই সুর সংগীতে। কিন্তু দুঃখ হলো, বিটিভি সেসব অনুষ্ঠান যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে না। যদি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করত, তাহলে নিশ্চয়ই এ প্রজন্মের শ্রোতারা, শিল্পীরা সেসব গান শুনে কাজে লাগাতে পারত। যাহোক সে কথা আজ বলে কোনো লাভ নেই। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল চলে গেল, যেন আমাদের সবই শেষ হয়ে গেল। আর কিছুই রইল না আমাদের। তার সুর সংগীতে আমি সব কটা জানালা খুলে দাও না গানটি গেয়েছি। বুলবুল এ গান দিয়েই বেঁচে থাকবে যুগের পর যুগ। বুলবুলের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ। আমি কিছু বলার আগেই বুঝে ফেলত সে আমি কী বলতে চাচ্ছি। আবার বুলবুল আর হারমোনিয়ামে হাত দিলেই আমি বুঝে ফেলতাম বুলবুল কী বোঝাতে চাইছে। এতটাই বোঝাপড়া ছিল আমাদের মধ্যে। বুলবুল আর আমার পরিকল্পনা ছিল তার করা আমার গাওয়া দেশের গানগুলো আবার নতুন করে রেকর্ড করার। কিছু গান করেছিও। কিন্তু সবগুলো করা হয়ে উঠেনি। আজ বুলবুল নেই। কিন্তু তার পরও ইচ্ছে আছে তার গানগুলো নতুন করে গাইবার। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়। সত্যি বলতে কী এগুলো ভাবছি আর নিজেকে সান্ত¦না দিচ্ছি। কারণ নিজেকে সান্ত¦না দেওয়া ছাড়া তো এখন আর কিছু করার নেই। বুলবুল সত্যিই চলে গেছে। আর কোনো দিন ফিরে আসবে না আমাদের মাঝে। আর কোনো দিন নতুন কোনো সুর সৃষ্টি করবে না। কিন্তু বুলবুল বেঁচে থাকবে আমাদের হৃদয়ে।

রুনা লায়লা

বুলবুলের সুর সংগীতে আমার প্রথম গান ছিল ও বন্ধুরে প্রাণও বন্ধুরে, কবে যাব তোমার বাড়ি পিন্দিয়া গোলাপি শাড়ি গানটি। প্রথম গানটিই সে সময় বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এরপর আরো অনেক গান গেয়েছি বুলবুলের সুর সংগীতে। যেহেতু বুলবুল নিজেই গান লিখত। তাই তার প্রতিটি গানের সুর সংগীতায়োজন একটু অন্য রকমই হতো; যা শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যেত। বুলবুুল তার নিজের সুরে আমার একটি অ্যালবামও করেছিল। একজন শিল্পীকে স্বাধীনতা দিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। শিল্পীকে গান বুঝিয়ে দিয়ে শিল্পীর নিজের মতো করেই গাইতে বলত। যে কারণে শিল্পী অনায়সে গান গাইতেন। প্রয়াত চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘শিল্পী’ সিনেমায় আমি অভিনয় করেছিলাম। এ সিনেমায় একটি উর্দু গান ছিল তেরি জুলফে। একটি ভার্সনে কণ্ঠ দিয়েছিলেন সুবীর নন্দী ও শাকিলা জাফর। আরেকটি ভার্সনে আমি গেয়েছিলাম। এ গানটির সংগীত পরিচালক হিসেবে বুলবুল কাজ করেছিল। এটা সত্যিই অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল একজন মেধাবী সংগীত পরিচালক ছিল। তার এ অকালে চলে যাওয়ায় সত্যিই আমাদের সংগীতাঙ্গনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। আমি বুলবুলের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। সেই সঙ্গে আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন, সেই দোয়াও করি।

এন্ড্রু কিশোর

গেল ডিসেম্বর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল আমার। বেশ কিছু নতুন কাজের পরিকল্পনা নিয়ে কথা হয়েছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা আর সফল হলো না। আমার সৌভাগ্য যে, বুলবুল ভাইকে শেষ দেখাটা দেখতে পেরেছি। কারণ আমার আজ সকালেই অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা ছিল। এটা সত্যি যে, বুলবুল ভাই চলে গেলেন এটা আমি ভাবতেই পারছি না। কারণ তার সঙ্গে আমি এত কাজ করেছি, এত সুন্দর পারিবারিক সম্পর্ক ছিল তার সঙ্গে আমি ভাবতেই পারছি না যে তিনি নেই। যতদূর মনেপড়ে বুলবুল ভাইয়ের সুর সংগীতে আমি প্রথম একটি ফোক সিনেমায় গান গেয়েছিলাম। তবে তার সুর সংগীতে আমার প্রথম হিট গান ছিল মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত ‘আঁখি মিলন’ সিনেমার আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে গানটি। এরপর আমি তার সুর সংগীতে বেলাল আহমেদ পরিচালিত আমার সারা দেহ খেওগো মাটি গানটি গেয়েছিলাম। অবশ্য এ গান যখন রেকর্ড করা হলো, তখন আমার কণ্ঠের অবস্থা ভালো ছিল না। কিন্তু তার পরও সেই গানই সিনেমার গল্পের পরিস্থিতির কারণে চূড়ান্ত করা হলো। এ গানও আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পেল। এরপর অসংখ্য গান গেয়েছি। আমার আরেক বন্ধু প্রয়াত সংগীতশিল্পী শেখ ইসতিয়াকের কথা বিশেষায়িত বলতেই হয়। কারণ শেখ ইশতিয়াকই আমাকে বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বুলবুল ভাইয়ের সুর সংগীতে একসময় যখন রিয়াজ অভিনীত মহম্মদ হাননান পরিচালিত ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’ সিনেমার পড়ে না চোখের পলক গানটি গাইতে হলো, তখন আমাকে বুলবুল ভাই বুঝিয়ে বলেছিলেন যে, রিয়াজের লিপে গানটি যাবে। যেহেতু রিয়াজ তখন একেবারেই যুবক। তাই গানটি তার গলার উপযোগী করেই গাইতে হয়েছিল। বুলবুল ভাই আর আমার মধ্যে সেই বোঝাপড়াটা ছিল যে, কীভাবে গাইতে হবে। বুলবুল ভাই চলে গেলেন সত্যি, তবে তিনি চলে গিয়ে আমাদের যে শূন্যতার মাঝে ফেলে গেলেন, সেই শূন্যতা আর কোনো দিন কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। দোয়া করি ঈশ্বর তার আত্মাকে শান্তি দিক।

কনকচাঁপা

আমরা এমন গুণী মানুষদের প্রয়াণের পর সাধারণত বলে থাকি, অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। বুলবুল ভাইয়ের হঠাৎ চলে যাওয়াটা সত্যি সত্যিই অপূরণীয় ক্ষতিই হয়ে গেল। আমরা জাতি হিসেবে খুব দুর্ভাগা জাতি। কারণ বুলবুল ভাইয়ের মতো এমন একজন সংগীত পরিচালকের কাছ থেকে অনেক কিছুই নিংড়ে নেওয়ার সুযোগ ছিল আমাদের। কিন্তু আমরা দুর্ভাগা বলেই তা পারিনি। বুলবুল ভাইয়ের সুর সংগীতে আমি অসংখ্য প্লেব্যাক করেছি। আমার কণ্ঠে গাওয়া জনপ্রিয় গান যেমনÑ তুমি মোর জীবনের ভাবনা, কত মানুষ ভবের বাজারে, প্রেমের তাজমহল, ঈশ্বর আল্লাহ বিধাতা জানেন, তুমি আমার এমনই একজন, বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম, সাগরের মতোই গভীর আকাশের মতোই অসীমসহ আরো অনেক গান গেয়েছি তার লেখা এবং সুর করা। মূলকথা হলো, বুলবুল ভাই নিজে গান লিখতেন বিধায় তার লেখা গানের প্রতি মায়া কাজ করত বলেই হয়তো এত সুন্দর সুর সৃষ্টি হতো। সব গানের কথা না হয় বাদই দিলাম, সাবিনা আপার গাওয়া বুলবুল ভাইয়ের সুর করা সব কটা জানালা গানটির কথাই যদি বলি, এই এক গান দিয়েই তিনি বাংলাদেশের বুকে বেঁচে থাকবেন, যত দিন বাংলাদেশ থাকবেÑ এটা আমি বিশ্বাস করি মনেপ্রাণে। আমি বুলবুল ভাইয়ের অনেক জুনিয়র। আমার স্বামী মইনুল তার খুব ভালো একজন বন্ধু। কিন্তু শুরুতেই আমাকে ভাবি বলেছিলেন বিধায় আমি এরপর বহুবার বলেও তা পরিবর্তন করাতে পারিনি। কত যে স্মৃতি আছে বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে তা বলে বোঝাতে পারব না। কত দিন কত রাত আমরা একসঙ্গে কাজ করে পার করেছি, কত সুন্দর সুন্দর গান সৃষ্টি হয়েছে। সেসবই আজ শুধুই স্মৃতি নয়, আমি বলব, সেসবই আমার কাছে আগামী দিনের পথচলার অনেক বড় পাথেয়। বুলবুল ভাই বেঁচে থাকবেন আমার প্রার্থনায়, আমাদের পথচলায়। বুলবুল ভাইয়ের মতো নিবেদিত সংস্কৃতি কর্মীদের এখনই সঠিক মূল্যায়ন করা উচিত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close