সতীর্থ রহমান

  ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭

বিশ্লেষণ

পক্ষতায় ভেসে গেছে মানবতা

মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ থেকে মানবাধিকারের জন্ম হয়েছে। আর সেই শ্রদ্ধাবোধ শুধু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়েছে। সহজ কথায় মানবাধিকার হলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানুষের অধিকার। মানব অধিকার হলো একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের অধিকার। ব্যক্তির ভালো থাকা, খাওয়া-পরা, অন্যের জুলুম থেকে নিরাপদ থাকা, কেউ কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা এবং ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা ও মুক্তবুদ্ধিকে সম্মান করার অর্থ মানবাধিকার। ব্যক্তি হিসেবে মানুষ যেসব অধিকার লাভের দাবিদার সেসব অধিকার সংরক্ষণ করার নাম মানবাধিকার। মানবাধিকার হলো ব্যক্তির নিরাপত্তা ও নিরাপদ জীবনের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক নীতিমালা দ্বারা স্বীকৃত। মানবাধিকার মানবের গুণাবলি সংরক্ষণ ও নিরাপদ জীবনের অধিকার। মানুষের মৌলিক চাহিদা যেমনÑ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা মানবাধিকারের আওতাভুক্ত। মানবাধিকারের দৃষ্টিতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বংশ, ধনী-গরিব ভেদাভেদ নেই। মানবাধিকারের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই।

১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয় এবং সেই থেকে প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। গুরুত্বপূর্র্ণ এ আন্তর্জাতিক দলিলটির মূল খসড়া তৈরি করেন কানাডার প্রফেসর জন হামফ্রে। এ কাজে আরো যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তারা হলেন এলিনিয়র রুজভেল্ট (যুক্তরাষ্ট্র), রেনে ক্যাসিন (ফ্রান্স), পি সি চাঙ্গ (চীন)সহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ। ৩০টি অনুচ্ছেদ সংবলিত এ দলিলটি মানব সভ্যতার ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক দলিল। এর বিজ্ঞ প্রণেতারা বিচক্ষণতার সঙ্গে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের সংমিশ্রণ ঘটান। যদিও এ ঐতিহাসিক দলিলটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তথা জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণযোগ্য কোনো দলিল নয়। তথাপি এটা সত্য যে, এটি মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দলিল এবং কনভেনশনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। ২০০৪ সাল পর্যন্ত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রটি মোট ৩৩০টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। যা ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’ অনুযায়ী একটি বিশ্বরেকর্ড। অন্য কোনো দলিল বা গ্রন্থ বিশ্বের এত ভাষায় অনূদিত হয়নি।

বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী ‘মানবাধিকার’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নন। অর্ধেকের বেশি লোক ‘মানবাধিকার’ শব্দটি শুনেছেন, তবে এর ব্যাখ্যা জানেন না। সিংহভাগ লোক জানেন না যে, মানবাধিকার আইন দ্বারা সুরক্ষিত। খুবই সামান্যসংখ্যক মানুষ জানেন, মানবাধিকারের বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের জরিপ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সমাজে সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকেন নারী। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মতে, নারীর প্রতি বৈষম্য বেড়েছে। যৌতুকের দাবিতে নারী নির্যাতনের হার সবচেয়ে বেশি। নারীর সাংবিধানিক ও আইনি অধিকার সম্পর্কেও খুবই সামান্যসংখ্যক মানুষ জানে। ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড এবং রাষ্ট্রীয় হেফাজতে নির্যাতন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তবে অধিকাংশ অংশগ্রহণকারীর মতে, ‘ক্রসফায়ার’ গ্রহণযোগ্য নয়। সুপারিশে বলা হয়েছে, র‌্যাব-পুলিশকে বুঝতে হবে কখন তাকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে এবং যাদের ধরা হচ্ছে তাদের বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। ইউএনডিপির কান্ট্রি ডিরেক্টর স্টিফেন প্রেইজলার বলেন, ‘মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সরকারের ‘রূপকল্প ২০২১’ সফল হবে না। সাধারণ মানুষকে আইনি সেবা প্রদানে বিচার বিভাগে সংস্কার প্রয়োজন। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা, পারিবারিক নির্যাতনের অনেক খবর গোপন থাকে। তারা পারিবারিক সম্মানের কথা চিন্তা করে বিচারপ্রার্থী হয় না। সরকারকে এ শ্রেণির জন্য নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। এজন্য সরকার ও মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে সমন্বিত নীতি প্রণয়নের আহ্বান জানান তিনি।’

একবিংশ শতাব্দীতেও দলিত ও হরিজনরা প্রতিনিয়ত অস্পৃশ্যতার শিকার হন বৃহত্তর সমাজের কাছ থেকে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই তাদের জীবনযাপন করতে হয়, ‘পাবলিক স্পেস’ ব্যবহারের সুযোগ তারা পান না। এই বিচ্ছিন্নতা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানবিক। হোটেল-সেলুনে তাদের ঢুকতে দেওয়া হয় না, কোনো কোনো জায়গায় ঢুকতে দিলেও তাদের জন্য নি¤œমানের প্লেট নির্ধারিত থাকে, চিহ্ন দেওয়া থাকে কিংবা তাদের নিজেদের কাপ সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। অন্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মেশার, নলকূপ থেকে পানি নেওয়ার, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার এবং ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। দেখা গেছে, নির্বাচনের সময় দলিত ও হরিজনদের জোর করে প্রভাবশালী ব্যক্তির পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য করা হয় অথবা ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয় না। সাধারণ পূজামন্ডপে তাদের প্রবেশাধিকার নেই, স্কুলে যেতে পারে না, কারণ তাদের পাশে অন্য সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা বসতে চায় না, শিক্ষকরাও প্রায়ই তাদের অবজ্ঞার চোখে দেখেন। আর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব বলে তারা চাকরি পায় না। মজুরির ক্ষেত্রেও তাদের বৈষম্যের শিকার হতে হয়। হরিজনরা পুরুষানুক্রমে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসহ বিভিন্ন পাবলিক/প্রাইভেট সেক্টরে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে নিয়োজিত, কিন্তু তাদের মজুরি খুবই কম। তাদের চাকরিও স্থায়ী করা হয় না, মাস্টার রোলে কাজ করতে হয়। তারা তাদের কাজের মাধ্যমে সমাজকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে, অথচ তাদেরকেই সমাজ সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন মনে করে এবং অস্পৃশ্য করে রাখে। শহর বা গ্রামের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় তারা থাকতে বাধ্য হয়। মুচিপাড়া, ঋষিপাড়া, তূরীপাড়া, রবিদাসপাড়া, মেথরপট্টি, সুইপার কলোনি, কলুপাড়া নামকরণ এভাবেই হয়ে থাকে।

সমাজের একটি শ্রেণিকে কিছুতেই সামাজিক কাঠামোতে যুক্ত করা যাবে না, অথচ তাদের না হলেও সমাজের চলে নাÑএ ধরনের পরস্পরবিরোধী মনোভাব সমাজে বিদ্যমান। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের তৈরি সবচেয়ে বিপর্যয়কর, ঘৃণ্য এবং অনৈতিক এই অবকাঠামোর ফলে ওইসব অবহেলিত সমাজবিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী এই সভ্য ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজেও ক্ষুধা, দারিদ্র্য, হতাশা, বঞ্চনা আর ঘৃণায় জর্জরিত। এসব জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যপীড়িত বলে অস্পৃশ্য নয়, বরং অস্পৃশ্য বলেই দারিদ্র্যে নিপতিত। এই অস্পৃশ্যতার মূলভূমি ধর্ম এবং রাজনীতি, যা মানুষের বেঁচে থাকার গন্ডিকে সীমাবদ্ধ করেছে। মানুষের মানবিক মর্যাদাকে ক্ষুণœ করেছে। মানুষের বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণা তৈরি করেছে। ঐতিহাসিকভাবে দলিত ও হরিজনরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করলেও তাদের কাজ ও পেশা নিশ্চিত ছিল। বর্তমানে হয় সেই পেশার অস্তিত্ব নেই (যেমনÑপালকি বহন), অথবা থাকলেও বর্তমানে কর্ম নিশ্চিত নয়, কিন্তু বিচ্ছিন্নতার ফলে সামাজিক অস্পৃশ্যতা থেকেই গেছে। বাংলাদেশে হরিজন ও দলিত সম্প্রদায়গুলো স্বাধীনতা-উত্তরকালে সবসময়েই জাতীয় উন্নয়নের সব পরিকল্পনা থেকে বাদ পড়েছে। তাদের উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য একটি জাতীয় উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি এবং ওই উন্নয়ন নীতি বা অন্তর্ভুক্তকরণ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাদের উন্নয়ন তখনই সফলভাবে হবে যখন তারা স্থানীয় ও জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। তাই জাতীয় সংসদসহ সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে এ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা আবশ্যক।

সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম’-এর তৃতীয় সম্মেলনে এ বিশ্বকে নিরাপদ ও উন্নত হিসেবে গড়তে সবার ঐক্যের বিকল্প নেই উল্লেখ করে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেন, ‘মানুষ ও দেশ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু মানবতা ও মানুষের সমস্যা একই।’ কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে বিশ্বব্যাপী হইচই পড়ে যায়। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে সামাজিক অনাচার, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাবে। শান্তি ও উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হলে সমাজে সর্বত্র মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুখী-সমৃদ্ধ-শান্তিকামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে সবার আগে মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে শ্রদ্ধা, ভক্তি আর ভালোবাসায় সমৃদ্ধ হোক সবার জীবন।

লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট

রহভড়.ংশপনফ@মসধরষ.পড়স

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist