ডা. এস এ মালেক

  ১৯ নভেম্বর, ২০১৭

মতামত

দ্বন্দ্ব নয় ঐক্যেই সমাধান

সম্প্রতি সংবাদপত্রে এমন কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যা পড়ে অনেকেই বিস্মিত ও চিন্তিত হয়েছেন। রাজনীতিতে পরস্পর সমালোচনা দোষের নয়। কিন্তু সমালোচনার প্রকৃতি যদি এমন হয় যে, জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে, তবে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিশেষ করে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে যতটুকু ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করেছে তা যদি বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, বিশেষ করে একটি সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে যদি এরূপ ঘটনা ঘটে তা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হতে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি বিভিন্ন সময়ে এমন সব তৎপরতার দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হয়, যা না হলে স্বাধীনতাবিরোধীরা এতদিনে যে শক্তি সঞ্চয় করেছে ও জাতীয় রাজনীতিতে যেসব অপতৎপরতা এবং সহিংসতা অব্যাহত রেখেছে, তা তাদের পক্ষে করা সম্ভব হতো না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনগুলো, যাদের অধিকাংশই মুক্তিযোদ্ধা ছিল তারা আওয়ামী ও জাসদপন্থিতে বিভক্ত হয়ে এক পর্যায়ে পরস্পরবিরোধী সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এতে দুই পক্ষের প্রায় ৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়। এরা সবাই ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রকৃত দেশপ্রেমিক।

যুদ্ধ শেষ হলে একটা গ্রুপ যারা রেডিক্লাইস বলে নিজেদের মনে করত এবং সমাজতন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। তারা বুঝেই হোক, আর না বুঝেই হোক, তাদের একপক্ষ অন্যপক্ষকে সহযোদ্ধাদের শ্রেণিশত্রু বলে নিধন প্রক্রিয়া শুরু করে। ফলে সরকার সমর্থিত ছাত্রলীগের প্রায় ১৮ হাজার কর্মী বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদীদের হাতে নিহত হয়। অপরদিকে তৎকালীন রক্ষীবাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের অনেক সদস্য প্রায় ১৮ হাজার জাসদ ছাত্রলীগের সদস্যকে হত্যা করে। দু’পক্ষে প্রায় ৪০ হাজার ছাত্র যদি সেদিন এভাবে নিহত না হতো এবং একটু সহনশীল হয়ে নিজেদের ও দেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতার কথা বিবেচনায় নিয়ে যুক্তিসঙ্গত আচরণ করা যেত, তাহলে এই ৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে অনর্থক জীবন দিতে হতো না। আর তারা বেঁচে থাকলে রাজাকার-আলবদররা সম্মিলিতভাবে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতায় যুক্ত হয়ে একটা পর্যায়ে প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারত না। সেদিনের রাজনীতির প্রকৃত পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে স্পষ্টই বোঝা যায় তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের যতটা ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল, তা বোধহয় তারা দেখাতে পারেনি।

অপরদিকে সমাজতন্ত্র (জাসদ) হয়তো বেশ কিছুটা আবেগের বশবর্তী হয়ে বাস্তবতাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পেরে, যে নেতার কারণে তাদের হাতে অস্ত্র উঠল, সেই অস্ত্র দিয়ে তারা সেই নেতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। কেন জাসদের জন্ম হলো, কেন হঠাৎ করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান উঠল, কেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা তাতে জড়িয়ে পড়লেন, এই নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আলোচনা হয়েছে। তবে এ কথা সত্য, সেদিনের রাজনীতি জাতীয় ঐতিহাসিক প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। ২৩ বছর সংগ্রাম করে জীবনের বিনিময়ে যিনি দেশ স্বাধীন করলেন, তাকে হঠাৎ অবিশ্বাস করে, রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে, একই শ্রেণিতে অবস্থানরত, একই ধরনের স্বার্থ ভোগকারী, একে অপরের প্রতি বিধ্বংসী হয়ে যে চরম অবস্থার সৃষ্টি করে, তারই ফলশ্রুতিতে প্রতিবিপ্লবের অনুপ্রবেশ সম্ভব হয়েছে।

দ্বন্দ্ব-সংঘাত এমন পর্যায়ে গেল যে, প্রায় ৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে প্রাণ দিতে হলো। যখন দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন নির্মমভাবে তাকে পরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে শূন্যতা সৃষ্টি করা হলো। তারপর শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। ওই প্রতিবিপ্লবের কারণে ক্ষমতা যাদের হাতে যায়, তারা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন করা বাংলাদেশকে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে যেতে শুরু করে। আবার তারাই এখন বিরোধী শক্তি হয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দোহাই দিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক দেরিতে হলেও এখনো স্বাধীনতার পক্ষের বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের প্রাক্তন নেতৃত্বের কয়েকজন জীবিত থাকায় ও রাজনীতিতে সক্রিয় অবস্থান নেওয়ায় বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা লাভের পর বেশ কিছুটা কাছাকাছি অবস্থান নিতে পেরেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে ফিরিয়ে এনে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন তারা। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এ কারণেই শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় একসময় আ স ম রব (জাসদ নেতা) আর এখন হাসানুল হক ইনু দায়িত্ব পালন করছেন।

ভিন্ন সংগঠনের লোক হলেও রাশেদ খান মেনন ত্যাগী ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসেবে মন্ত্রিসভায় স্থান করে নিয়েছেন। তবে এ কথা ঠিক, স্বাধীনতার সপক্ষের অনেক ত্যাগী ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা এখনো বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে আছেন। ঠিক স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিগুলো যেভাবে সুসংহত হলে স্বাধীনতাবিরোধীরা কখনো বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছাতে পারত না, সে ধরনের ঐক্য গড়ে তোলার মতো মানসিকতা এখনো অনেকের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে এক বড় বাধা হচ্ছে প্রগতিশীল সমাজবাদীদের যুক্তিহীনভাবে গণতান্ত্রিক শক্তির বিরোধিতা করা। যারা বুর্জোয়া বলে গণতান্ত্রিক শক্তিকে গালি দেন শ্রেণিগত অবস্থানে তারা কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণি হতে নিজেকে পৃথক করতে পারেননি। শ্রেণি বৈশিষ্ট্যে তারা প্রায় অভিন্ন। আদর্শগত কারণের কথা যতই বলা হোক না কেন তাদের আদর্শ ছিল ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। সময় তা প্রমাণ করেছে। বঙ্গবন্ধরু শাসন আমলের প্রথম সাড়ে তিন বছর গণতন্ত্র বিকাশের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে তার বিরোধিতা করে প্রকৃত অর্থে দেশকে অস্থিতিশীল করা ও বঙ্গবন্ধুর শাসনকে অজনপ্রিয় করার এবং ব্যর্থতায় পর্যবসিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল সেই সময়ের জাসদ।

জাতির জনকের নেতৃত্বে গণতন্ত্র ও প্রগতিশীলতার ক্ষেত্রে যতটুকু অর্জন সম্ভব ছিল, স্বাধীন দেশের জনগণের যে প্রত্যাশা ছিল, জাসদের কারণেই তা বাস্তবায়িত হতে পারেনি। বরং দেশ প্রতিবিপ্লবীদের হাতে পড়ে প্রায় প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানের কাছে চলে যায়। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে শেখ হাসিনা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। কাকে, কোথায়, কোন দায়িত্ব দিতে হবে, কার অবস্থান কোথায় হবে, সহযোগিতার প্রকৃতি কিরূপ হবে, কাকে দিয়ে কতটুকু অর্জন করা সম্ভব হবে, কাকে কোথায় রাখলে ঐক্য ঘনীভূত হবে, ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনী কৌশল কী হবে, এর সবকিছুই নির্ধারক বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় দু’দশক রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত থেকে তিনি জনগণের এমন একটা আস্থা অর্জন করেছেন, যা আওয়ামী লীগের আর কোনো নেতার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি।

পরিশেষে বলতে হয়, প্রগতিশীল বামপন্থিরা নিশ্চয়ই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি নয়, তারাও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছে। তারাও স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি। একসময় বিভাজনের রাজনীতিতে রাষ্ট্রের মারাত্মক সর্বনাশ হয়েছে। আবার নতুন করে সে অবস্থায় যেন আমরা ফিরে না যাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে এবং বাংলাদেশ বিনির্মাণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে বিশ্বাসী সব রাজনৈতিক শক্তি এক হয়ে চেতনাবিরোধীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে-এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist